3086
Published on মার্চ 21, 2019মো. রোকনুজ্জামান বাবুলঃ
১৯৭১ এর আগস্ট মাস। সারাদেশের ন্যায় দালাল রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজছে। এমনই একটি দিন আগস্ট মাসের ২৭ তারিখ। মাত্রই দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এমনই সময় খুলনা জেলার দেয়ারা গ্রামে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে হামলা করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা খালিশপুরের পিপলস্ জুট মিলের খেয়াঘাট পার হয়ে এপারে আসে। এরপর সেনহাটি গ্রাম হয়ে তারা দেয়ারা এসে পৌঁছায়। ভোর রাতেই কয়েকশ রাজাকার, বিহারি ও পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা গোটা দেয়ারা গ্রামটি ঘিরে ফেলে। তারা মুক্তিযোদ্ধা আবদারের নাম ধরে খুঁজতে থাকে। সে কোথায় আছে জানতে চায়। তাকে বের করে দিতে বলে। কিন্তু কোথাও মুক্তিযোদ্ধা আবদারকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হানাদার বাহিনী প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদারের পিতা ডা. মতিয়ার রহমান ও অন্যদের ধরে শুরু করে এলোপাতাড়ি গুলি।
সে এক ভয়ানক অবস্থা। চিৎকার-চেঁচামেচি, মারধর, গুলি, ধারালো অস্ত্রের আঘাত, প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে পালানো সব মিলিয়ে এক অরাজক আতঙ্কজনক পরিস্থিতি। এরই মাঝে আক্রমণকারীরা ডা. মতিয়ার রহমানের বাড়ি থেকে ছয় জনকে ধরে ফেলে। রাস্তায় এনে তাদের পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে সেখানেই তাদেরকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে।
হানাদাররা আরও কিছু মানুষকে ধরে এক জায়গায় জড়ো করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে। হানাদারদের আক্রমণের খবর সারা গ্রামে ছড়িয়ে পরলে মানুষ যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। গোটা গ্রামে তখন ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদ, চিৎকার, গুলির শব্দ, আক্রমণকারীদের উল্লাস ধ্বনিতে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির তৈরি হয়।
আক্রমণের মুখে কেউ কেউ পালাতে সক্ষম হলেও ঐদিন পাকিস্তানী হায়েনাদের হাতে মোট ৬১ জন যুবক-বয়স্ক মানুষ ধরা পড়ে। যারা পালানোর চেষ্টা করেছিল তাদেরকে মুরগি ধরার মতো করে ওরা পিছন পিছন ছুটে আসছিল। আর ধরে ফেলে শিকার বধ করার মতো মাটিতে ফেলে বিহারী রাজাকারগুলো ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে কুপিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। অন্যদিকে পাকিস্তানী সেনার গুলি করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারদের হাতে ধরা পরা ৬১ জনের মধ্যে ৬০ জন ঘটনাস্থলেই শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। এদেও মধ্যে ৩৮ জন শহীদেও লাশ ওই পাষ- রাজাকারের দল ভৈরব নদীতে ছুঁড়ে ফেলে। বাকি ২২ জনকে তিনটি গণকবরে মাটিচাপা দেয়। বাকি একজন সারা শরীরে ধারালো অস্ত্রের ১৯টি আঘাত সয়েও বেঁচে যান। আজও তিনি সেই ভয়ঙ্কর দিনকে স্মরণ করে শিউরে ওঠেন।
শরীরে হায়েনাদের ১৯টি আঘাত নিয়ে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিটি হলেন স্থানীয় সৈয়দ আবুল বাশার (৮৪)। ঐদিনের ঘটনার বীভৎসতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন-“বিহারি রাজাকারগুলো ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। পাকিস্তানী সেনারা গুলি করেছে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ মেরেছে। খুনিদের কি উল্লাস, তা চোখে না দেখলে বিশ^াস করা যায় না। আমি হতবিহবল হয়ে রাস্তার পাশে একটু আড়ালে ছিলাম। ভেবেছিলাম আমাকে কেউ কিছু বলবে না। এমন সময় তাদের হতে ধরা পড়া একজন দৌড়ে পালায় আসে। সে আমাকে রাস্তায় দেখেই জড়িয়ে বলে, ‘বাশার ভাই, আমাকে বাঁচাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলল।’ মুরগি ধরার মতো করে পেছন পেছন ওরা ছুটে আসে। আমাকে জড়িয়ে ধরা মানুষটিকে টেনে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে কোপাতে শুরু করে। প্রথমে আমার দিকে ওরা লক্ষ্য করেনি। কে যেন বলে ওঠে, ‘এটিও মুক্তি হায়।’ ওমনি একজন আমাকে কোপাতে শুরু করে। আমি মাটিতে উপর হয়ে পড়ে যাই। তারা ফিরে যায়। আমি ওই ভাবে মরার মতো ভান করে পড়েছিলাম।
ওরা ফিরে যেতে থাকে। কে যেন বলে ওঠে, ‘এই বাশারের শরীর থেকে রক্ত বেরোয়নি।’ তারা আবারও ফিরে আসে। একজন আমাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। একটানা কতকগুলো কোপ দিয়ে ওরা চলে যায়। অদূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার ছেলে হিরু সবই দেখে। ওরা চলে গেলে হিরুসহ আরও কয়েকজন মিলে আমাকে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখে এবং পরে হাসপাতালে নিলে আমি চিকিৎসা নিয়ে আত্মগোপনে চলে যাই। কারণ, রাজাকাররা আমার বেঁচে যাওয়ার খবরে মাঝে মাঝেই আমাকে ধরতে আসতো। সেদিনের সেই স্মৃতি মনে এলে কুঁকড়ে উঠি, কথা বলতে পারি না। কিভাবে বেঁচে আছি তা বুঝতেই পারি না। আমার তো বেঁচে থাকার কথা নয়, উনিশটি ধারালো অস্ত্রের আঘাত সয়েও কি কেউ বেঁচে থাকতে পারে!’
দেয়ারা গ্রামে নৃশংসতায় পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে বিহারি (অবাঙালী) এবং স্থানীয় রাজাকারদের মধ্যে গোয়ালপাড়া গ্রামের শেখ শওকত হোসেন ও ব্রহ্মগাতি গ্রামের শেখ জাফর ঘটনাস্থলেই ছিল। এছাড়াও এদের সহযোগী ছিল ব্রহ্মগাতি গ্রামের গনি, আবু বকর ও শেখ আব্দুল গফুর। পাকিস্তানী সেনা এবং অবাঙালীদের কেউ চিনতে পারেনি।
এদিনের ঘটনায় যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন- মোজাম শেখের ছেলে মতিয়ার রহমান, ইউসুফ শেখের ছেলে শেখ ইসমাইল হোসেন ওরফে ছোট খোকা, হেলাল উদ্দিন শেখের দুই ছেলে আব্দুল বারেক ও আবদুল জলিল, শরিয়াতুল্লাহ শেখের দুই ছেলে শেখ রহমত আলী পিরু ও শেখ মোশারফ আলী, হোসেন সরদার, আজিম হোসেন, ছাত্তার শেখ, জয়নাল হাওলাদার, ওয়াহেদ চৌকিদার, মোকছেদ মীর ও তার ছেলে মোসলেম মীর, পরামানিকসহ আরও অনেকে।
সেই ভয়াল দিনটির স্মৃতি আঁকড়ে আজও বেঁচে আছেন শহীদ ও নির্যাতনের শিকার পরিবারের সদস্যরা। ডা. মতিয়ার রহমানের ছেলে আফজাল হোসেন আজও এই রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। শেখ ইসমাইল হোসেন ওরফে ছোট খোকার স্ত্রী রোকেয়া বেগম আজও নীরবে অশ্রু ফেলে চলেছেন। এছাড়াও আবদুল বারেক, আবদুল জলিল, শেখ রহমত আলী পিরু, শেখ মোশারফ আলী, হোসেন সরদার, আজিম হোসেন, ছাত্তার শেখ, জয়নাল হাওলাদার, ওয়াহেদ চৌকিদার, মোকছেদ মীর ও মোসলেম মীরের পরিবারের সদস্যরা স্বজন হারানো বেদনা নিয়ে আজও নীরবে চোখের পানি ফেলেন।
এই গণহত্যা নিয়ে আরও জানতে পড়ুন ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র’ থেকে প্রকাশিত গণহত্যা নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালায় গৌরাঙ্গ নন্দী রচিত দেয়াড়া গণহত্যা গ্রন্থটি।
লেখক : উপ-পরিচালক, গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা
প্রকাশঃ দৈনিক জনকণ্ঠ