বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার অদম্য যাত্রাপথ

2642

Published on মার্চ 19, 2019
  • Details Image

নাজনীন বেগমঃ

বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে বাঙালীর ঐতিহ্যিক সত্তায় চিরস্থায়ী ব্যক্তিত্বের শীর্ষস্থানে চলে আসলেন সেও যেন এক ঐতিহাসিক পথপরিক্রমা। প্রভাতের সূর্যোদয় সারাদিনের যে বার্তা দেয়, সেটা যেন জাতির জনকের জীবনযাত্রায় উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হয়ে আছে। তাই বাল্যকাল থেকেই দেশ, মাটি আর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম বোধ আর মমতায় চৈতন্যের যে আলো বিকিরণ সেটাই বঙ্গবন্ধুকে জীবনভর তাড়িত করে। শ্যামল বাংলার অপার প্রাকৃতিক সম্ভারে মুগ্ধ বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আবেগভরা ভাষায় বিধৃত করেন- প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে যায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ওই রকমই নরম, ওই রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যকেই আমরা ভালবাসি। নিরেট বাস্তববাদী, গণমানুষের অধিকার আদায়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এমন সুললিত ভাষায় মাতৃভূমির বর্ণনা দিয়েছেন, যা যথার্থই দেশনায়ক হয়ে ওঠার এক অনমনীয় বোধ। আবহমান বাংলার সবুজ প্রান্তর, নদ-নদী বিধৌত এদেশের নরম পলিমাটি তারই কোলে লালিত সন্তানদের এমন অভিভূত হওয়ার নান্দনিক রূপকার তো বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দ দাশ, তার সঙ্গে আরও অনেক সৃজন সাধক। যে শৈল্পিক সত্তায় বঙ্গবন্ধুও অনেক সময় আন্দোলিত হয়েছেন। আবার এই রকম সোঁদা মাটির আবহে সিক্ত হওয়া জাতির জনক গণমানুষের দুঃখ, দুর্দশা, আর বঞ্চনার আবর্তে পীড়িত হওয়াকে কোনভাবেই মানতে পারেননি। বজ্রকঠিন কণ্ঠে সমস্ত অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতেও তাঁর হৃদয় কাঁপেনি। সময়ে তা বহুবার এর প্রমাণও তিনি দিয়েছেন।

১৯২০ সালে জন্ম নেয়া এই মহানায়ক গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে যে পরিমাণ আন্দোলন আর সংগ্রামে তাঁর বিপ্লবী অভিগমনকে অবারিত করেছিলেন, তার পথযাত্রা শুরু হয় সেই বালক বয়সে। নিজের কথার স্পষ্টভাবে জানান দেন, পুরো পরিবার ছিল ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক বংশানুক্রমিক ধারা। তৎকালীন সম্পন্ন ঘরের সন্তান ছিলেন শেখ মুজিব। শেখ বংশ ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনতাকে সেভাবে মানতে পারত না। ইংরেজদের সঙ্গে ক্রমাগত অসহযোগিতায় এই শেখ পরিবারের সহায়-সম্পদ কমে যেতেও সময় লাগেনি। তারই অনিবার্য পরিণতিতে বংশানুক্রমিক সম্পদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা দেখতে দেখতে বড় হতে থাকা বঙ্গবন্ধুর ভেতরে ছিল এক অনমনীয় সংগ্রামী অভিব্যক্তি। এ তো গেল টুঙ্গিপাড়ার অপরূপ প্রাকৃতিক সম্পদের শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে বৈপ্লবিক মনস্তত্ত্বে নিজেকে গড়ে তোলা এক উদীয়মান কিশোরের মানবিক ও মানসিক জগত। আর অবিভক্ত বাংলা তথা পুরো ভারত উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক পরিম-লের সার্বিক অবয়ব কেমন ছিল? যা বঙ্গবন্ধুর মতো এক লড়াকু কিশোরকে ভেতর থেকে আলোড়িত করত! ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আছে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়াই শুধু নয়, কিভাবে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ভক্ত বনে যাওয়া। সেখানেও আছে ঘটনাপরম্পরা ঝড়-ঝঞ্ঝার এক উন্মত্ত প্রতিবেশ। শুধু তাই নয়, কিভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ উপ্ত হয়ে সারা ভারতবর্ষকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। সে সময় মনে হয়েছিল জমিদাররা প্রজাপীড়ন করেন না। হিন্দুরাই মুসলমানদের তাদের ভূমিতে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে শাসন-শোষণের খড়গ চালায়। এটাও ব্রিটিশ রাজণ্যবর্গের এক সূক্ষ্ম কূটকৌশল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ এদেশের ভূমি ব্যবস্থায় যে মালিকানার ভিত্তি তৈরি করে সেখানে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় জমিদারি পায় উঠতি হিন্দু বেনিয়া শ্রেণী। বিপরীতে হিন্দু অধ্যুষিত জায়গায় মালিকানা স্বত্ব¡ পায় মুসলিম উদীয়মান বণিকরা। ফলে জমিদার দ্বারা যে প্রজা শোষণ-পীড়ন তা হয়ে দাঁড়ায় হিন্দু দ্বারা মুসলমান কিংবা মুসলমান দ্বারা হিন্দু। অর্থাৎ শ্রেণী সংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাকে মোড় ঘোরানো হয় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের দিকে। যার রেশ আজও ভারত উপমহাদেশের অসংখ্য মানুষের জীবনকে কন্টকাকীর্ণ করে রেখেছে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার গড্ডলিকা প্রবাহে বঙ্গবন্ধুও একদিন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পাকিস্তানের সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। তবে ভেতরে কাজ করত স্বদেশী চেতনার অকৃত্রিম বোধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৩ সালে ঘোরতর মন্বন্তর সারা বাংলাকে কাঁপিয়ে দেয়। সে স্মৃতিও কখনও মন থেকে মুছে যায়নি। নিজের জবানিতে যখন সব কিছু সাবলীলভাবে লিখে যাচ্ছেন, তেমন স্মৃতিও তাঁকে কাতর করে দেয়। বলতে দ্বিধা করেননি যুদ্ধ করে ইংরেজ কিন্তু না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালীর কোন কিছুরই অভাব ছিল না। ১৯৩৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী বাংলাদেশে এলে এই উদীয়মান তরুণ দুই নেতারই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু যেমন সোহ্রাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ অনুগামী হলেন, একইভাবে এই বিচক্ষণ রাজনীতিকও জাতির জনকের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস স্থাপন করতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের পদচারণা শুরু হয় মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সরাসরি তাঁর জবানীই উল্লেখ করা যাক- তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি, খেলার দিকে আর নজর নেই। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নেই। এমন চেতনায় নিজেকে শাণিত করে দ্বিজাতিতত্ত্বের লড়াইয়ে শামিল হলেও সে মোহভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। এরই মধ্যে ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে শেখ মুজিব কোনভাবেই মানতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর ভাবতে সময় লাগেনি যে, এসব সংঘর্ষ জাতীয়তাবাদের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে ধর্মীয় উগ্রতা আর জঙ্গীবাদকেই উস্কে দেয়, যা কোন মানুষের কাছে চরম অধর্ম। পরবর্তীতে আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে সে সব দুঃসহ স্মৃতিও জাতির জনককে উদ্বেলিত করে। তাঁর মতে, যে উগ্র হিন্দু গোষ্ঠী মহাত্মা গান্ধীর মতো নেতাকে হত্যা করতে পারে তারা অন্য সম্প্রদায়কে সহ্য করতে পারবে কিনা? ফলে এক ধরনের মুসলিম স্বাজাত্যবোধ থেকে যে অনাকাক্সিক্ষত দেশ বিভাগ কালক্রমে সে স্বপ্নভঙ্গের হতাশায় মুষড়ে না পড়ে নিজের আত্মপরিচয় আর ঐতিহ্য অস্তিত্ব রক্ষায় সমর্পিত হলেন সেই ১৯৪৮ সাল থেকে। বিভাজনের উত্তাল সময়ে সাম্প্রদায়িক অগ্নিদাহ রাজনৈতিক অঙ্গনকে যে মাত্রায় দুর্বিপাকে ফেলেছিল, কোন ধরনের বাগ্বিত-ার সুযোগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেই চক্রব্যুহ থেকে সন্তর্পণে বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। অন্তরে চিরায়ত বাঙালিয়ানা, সবুজ বাংলায় রূপমুগ্ধ নিবেদিত প্রেমিক শুধু নন, আপামর বাঙালীর অবিস্মরণীয় দিকপাল বঙ্গবন্ধু আপন সংস্কৃতির বেড়াজালে নিজের পথপরিক্রমার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে কোন ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতির ধারে-কাছে যাননি। যেদিন থেকে নিঃসংশয় হলেন দ্বিজাতিতত্ত্বের কূটকৌশল, ধর্মের আবরণে আবহমান জাতিসত্তাকে নির্মূল করার দুরভিসন্ধি, সেদিন থেকে আপন গন্তব্যে নিজের ও দেশের মানুষের ঠিকানা স্থির করে নিয়েছিলেন। সেই অনমনীয় লক্ষ্যে অন্য কোনদিকে ফিরে তাকাবার সময় এবং সুযোগ কোনটাকেই আমলে নেননি। বীরদর্পে বাঙালীর চিরন্তন বোধ আর ঐতিহ্য সুরক্ষায় নিজের মূল্যবান জীবন, পরিবার, সুখ-শান্তি, অর্থবিত্ত সবকিছুকে অতিক্রম করে গেছেন নির্মোহ চেতনায়। নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জনে দেয়া রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর কাছে এক অসুস্থ কলুষিত পর্যায়, যাকে জীবনভর ঘৃণা করেছেন। অপরাজনীতির কূটকৌশল তাঁর কাছে ছিল এক ধরনের মানবিক বিপর্যয় এবং ক্ষমতালিপ্সার বিকৃত মনোবৃত্তি। প্রত্যেক মানুষের তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন তার ন্যায়-অন্যায়বোধ, সুস্থ রাজনৈতিক ধারার স্খলন, ক্ষমতার আসক্তি যেমন ব্যক্তি মানুষকে অনেক নিচে নামিয়ে দেয়, একইভাবে পুরো সমাজে তার বিষক্রিয়া ছড়াতে সময় লাগে না। এর অবধারিত পরিণতিতে রাজনীতির নিরাপদ গন্তব্য বিঘ্নিত হয়, সমাজ ও মানুষের সুশৃঙ্খল যাত্রাপথ অন্ধকারে ঢেকে যায়। বঙ্গবন্ধু সব সময়ই রাজনীতির এমন অপসংস্কৃতিকে পরিহার করে এসেছেন। তাঁর বর্ণনায় আছে রাজনীতিতে টাকার খেলা তিনি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। অনৈতিকতার বেড়াজালে ক্ষমতার আকাক্সক্ষা কিভাবে দুঃসহ যাত্রাপথ আলিঙ্গন করে সেটাও তাঁকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। তাই রাজনীতিকে সমস্ত কলুষ থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়াও ছিল বঙ্গবন্ধুর এক দূরদর্শী আকাক্সক্ষা। তাঁর এই দৃঢ় চৈতন্যের সর্বক্ষণিক সহযাত্রী ছিলেন চিরসাথী রেণু। মরণের কালেও যিনি একই সঙ্গেই ছিলেন। জীবন তৈরি করার আর্থিক সহযোগিতা আসে পিতার কাছ থেকে। লেখাপড়ার খরচ থেকে শুরু করে কলকাতার হোস্টেলে থাকা, রাজনৈতিক সংগঠনে জড়িত হওয়া সবকিছুর জন্য ব্যয়িত অর্থ বাবাই দিতেন। আর স্ত্রী রেণুকা স্বামীর অপেক্ষায় দিন-রাত প্রহর গুনতেন। রাজনৈতিকভাবে বিবদমান জীবনে স্ত্রীর সাহচর্য কত যে প্রয়োজনীয় সেটা ফজিলাতুনন্নেছা খুব ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে ছায়ার মতো আশপাশে ঘুরে বেড়াতেন। নিজের অতি সাধারণ জীবনকে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বে বিলিয়ে দিয়ে সেখানেই সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন। ১৯৬৮ সালের আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলায়, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে কিংবা ৭ মার্চে ঐতিহাসিক ভাষণের যুগসন্ধিক্ষণে বেগম মুজিবের নিভৃত কর্মপ্রেরণা, উৎসাহ, এমনকি দৃঢ়চিত্তে দেশ ও মানুষের পাশে থাকতে উদ্দীপ্ত করা বাংলার সংগ্রামী ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম পর্ব। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পর যে বিক্ষুব্ধ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সারা বাংলাকে উত্তপ্ত করে দেয়, সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অভাবনীয় নেতৃত্ব বাংলা এবং বাঙালীর জীবনদর্শনে যে দিকনির্দেশকের কাজ করে তাতে এসব ঐতিহ্যকে ঘটনার ঐতিহাসিক নায়কের অন্যদিকে তাকানোর ফুরসত ছিল না। সেই দুর্বিনীত পথপরিক্রমায় এক অনন্য নেতৃত্ব বাংলাদেশের সংগ্রামী অভিযাত্রায় যে অনমনীয় যোদ্ধার ভূমিকায় নিজের জীবনকে বাজি রেখেছিলেন তা আজ আবহমান বাঙালীর এক সমৃদ্ধ প্রেরণা। ১৯৬৯-এর বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলাকে তার আপন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে যে অতন্দ্র সেনানীর ভূমিকায় নেমেছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখান থেকে কখনও তিনি বিচ্যুত হননি। নিজের প্রতি উদাসীন এক দৃঢ়চেতা আকর্ষণীয় নেতৃত্ব সব সময় জনগণের দিকে নজর রাখতেন। দেশের প্রতি সর্বক্ষণিক মমত্ববোধে মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনও ছিল তাঁর চিরদিনের কর্মযোগ।

আলোকিত জীবনের অর্ধেকটা সময় কেটেছে কারাগারের গভীর অন্ধকারে। যে আঁধার জনগণের ভালবাসায় বারবার দ্যুতিও ছড়িয়েছে। জনগণের প্রতি পরম দায়বদ্ধতায় যে রাজনৈতিক কর্মপরিধি তৈরি হয়, সেখানে ব্যক্তিগত আর পারিবারিক জীবন ছিল একেবারে শূন্যের কোঠায়। জেল, জুলুম, নির্যাতন, পুলিশী হাঙ্গামা, শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিষোদগার সব মিলিয়ে জীবনটা কখনও সুস্থির আর নিরাপদ ছিল না। বিশেষ করে ষাটের দশকের উত্তাল কালপর্বে প্রতিদিনের ঘটনাপঞ্জি ছিল বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাসের ঐতিহ্যিক দলিল। দেশ কাঁপানো ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান নির্ধারণ করে দেয় ’৭০-এর নির্বাচন। সেখান থেকে তৈরি হতে থাকে আর এক নতুন লড়াকু পথপরিক্রমা। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই মুক্তির নিশানায় আপামর বাঙালীকে বঙ্গবন্ধু লাল সবুজের পতাকার নিচে সমবেত করতে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিলেন জন্মভূমিকে শত্রুমুক্তির দুর্দমনীয় আকাক্সক্ষায়। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়েও উদ্দীপ্ত বাঙালীকে দাবিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়। মার্চ মাসের ঘটনাপরম্পরায় এসে যায় সেই ঐতিহাসিক শুভক্ষণ, ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় বলিষ্ঠ বাক্য উচ্চারণ। নির্মম সামরিক বেষ্টনীর শৃঙ্খলে আটকে পড়া এই বীর বাঙালী কি অদম্য সাহসিকতায়, উপযুক্ত সময়ে এমন দুর্লভ বাক্য শৌর্যে সারা বাংলাকে হতবাক করে দিয়েছিলেন, তাও ইতিহাসের এক যুগান্তকারী বিস্ময়। এই বলিষ্ঠ প্রত্যয় শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথনির্দেশনাই নয়, সারা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের লড়াই-সংগ্রামের এক অনিবার্ণ অনুপ্রেরণা, যা দেশ ও কালের সীমানা ছাড়িয়ে আর কত দূর যাবে তা কেউ জানে না।

প্রকাশঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত