7775
Published on মার্চ 3, 2019ড. শফিক আশরাফঃ
বাংলায় ফাগুন এলেই প্রকৃতিতে আগুন জ্বলে। চারদিকে শিমুল-পলাশের মতো আগুন রঙা ফুল দেহ ও মনে একটি বিপ্লবী বার্তা ছড়ায়। মার্চ মাস এই ফাল্গুনকে বুকে নিয়ে গৌরব ও ইতিহাসকে জড়িছে রেখেছে। মার্চকে আমরা ডাকি স্বাধীনতার মাস বলে। মার্চ মাস প্রচুর ঘটনাবহুল। বিগত হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির যত জাগরণের কথা স্মরণ করা যায়, মার্চের জাগরণের সঙ্গে তার কোনো তুলনা চলে না। ধর্মভিত্তিক দেশ বিভাগের পর বাঙালি যখন বুঝতে পারে বড় একটি ভুল হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের মতো নয়, তাদের ভাষা, তাদের সংস্কৃতি, পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি আমাদের সঙ্গে মেলে না। আবার অদূরদর্শী পাকিস্তানের শাসকদের পক্ষ থেকে যখন ঘোষণা আসে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি ভুলে তাদেরটা গ্রহণ করতে হবে, তখন ধর্মের সূক্ষ্ম সুতার বন্ধন চট করে ছিঁড়ে যায়। স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায় বাঙালিকে। তারা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এই সময়ের হাতেই সৃষ্টি হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতার, যিনি ছিলেন বাঙালির জাগরণের অগ্রদূত। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়টিও ছিল ফেব্রুয়ারি ও মার্চে। বায়ান্নর মার্চে বাঙালি যে আগুন জ্বালিয়েছিল, একাত্তরের মার্চে এসে সেই আগুন চূড়ান্ত পরিণতিপ্রাপ্ত হয়।
আমাদের স্বাধীনতার মাস মানে পাকিস্তানিদের বিদায়ের মাস। পাকিস্তানিদের বিদায় ডঙ্কা বাজানোর আগে অনেক ইঙ্গিতবহুল ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনা থেকে স্বার্থান্ধ পাকিস্তানি শাসকরা কোনো শিক্ষা নিতে চেষ্টা করেনি কিংবা ইঙ্গিতও বুঝতে চেষ্টা করেনি। এ রকম একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ২ মার্চের স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন। প্রাথমিক অবস্থায় ঘটনাটি ছিল বিচ্ছিন্ন এবং এক দল উত্তেজিত ছাত্রনেতার আবেগ প্রকাশ। কিন্তু এটায় যে গোটা বাঙালির একনিষ্ঠ সমর্থন ছিল তা-ই নয়, বরং সব বাঙালির আবেগের বহিঃপ্রকাশও ছিল। আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, তোফায়েল আহমেদের মতো ছাত্রনেতারা বাঙালির হৃৎস্পন্দন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতার অনুসারীদের পক্ষে এটি খুব স্বাভাবিক ছিল। ২ মার্চ এখন আমাদের পতাকা দিবস।
সত্তরের নির্বাচনের আগে থেকেই মূলত বঙ্গবন্ধুর হাতে দেশ। তাঁর হাতে তখন কোনো শাসনভার ছিল না, ছিল না কোনো মিলিটারি বা পুলিশ, শুধু ছিল জনগণ! জনগণ মেনে নিয়েছিল তাদের একজন নেতাকে, আর সেই নেতার কথাই তখন দেশে আইন। তিনি যখন বলেছেন, ব্যাংক বন্ধ, শুধু বেতন দেওয়ার দিন খোলা থাকবে, তা-ই হয়েছে। তিনি বলেছেন, রেল বন্ধ, কারো সাধ্য ছিল না সেটি অমান্য করার। নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার এই বিস্ময়কর ঘটনা বাঙালির জীবনে দ্বিতীয়বার ঘটেনি। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর পাকিস্তানি শাসকদের টালবাহানায় বাঙালি শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। তারা তাকিয়ে ছিল তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে। এরই মধ্যে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণের ডাক দেন শেখ মুজিবুর রহমান। মার্চের সেই ডাকে মানুষের ঢল নামে রেসকোর্সের দিকে। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস-কবিতা লেখা হয়েছে, সেগুলোতে আবেগের প্রাধান্য বেশি। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর সময়কাল নিয়ে, ঘটনা নিয়ে এ সময়ের ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামাল ট্রিলজি লিখেছেন। ট্রিলজির শেষ পর্ব ‘অগ্নিপুরুষ’-এ এসে মার্চের সেই উত্তাল সময় ও গৌরবগাথাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরা হয়েছে অনেকটা ব্যক্তিনিরপেক্ষতায়। আর এই সময়টিকে ধারণ করতে লেখকের সময় লেগেছে ১৮ বছর। অবশ্য বাঙালির গর্ব করার মতো এ রকম ঐতিহাসিক ঘটনাও খুব সুলভ নয়।
শুধু একটি ভাষণ যে কত গভীর ও অর্থবহ হতে পারে, শুধু একটি ভাষণের ওপর নির্ভর করে একটি জাতি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে যেতে পারে, ৭ই মার্চের ভাষণে বাঙালি সেটি দেখিয়েছে। এ সময় আমাদের অনেক অর্জনের মধ্যে আরেকটি হলো স্লোগান। শুধু একটি স্লোগান অসম্ভব শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারে, জাগাতে পারে, সেটি দেখা গেছে। আর এই ‘জয় বাংলা’ শুধু স্লোগান ছিল না, ছিল শক্তি, ছিল বাঙালির মুক্তির বার্তা। একাত্তরের যুদ্ধকালীন গোটা সময়টা পাকিস্তানি হায়েনাদের দাবড়ে বেড়িয়েছে এই ‘জয় বাংলা’ শব্দটি। এ সময় পৃথিবীজুড়ে বাঙালিদের ‘জয় বাংলার লোক’ হিসেবে পরিচিতি বেড়েছিল। এখনো পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশি বাঙালিদের জয় বাংলার লোক হিসেবে ডাকা হয়। এই মার্চে বিভিন্ন স্লোগানে বাঙালি তার স্বকীয়তা খুঁজে পেয়েছিল। স্লোগান ছিল, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্ম-মেঘনা-যমুনা’ ইত্যাদি। তবে স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’ বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকার বহন করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আলোকবার্তা নিয়ে চলেছে, তার প্রমাণ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের ঘটনা। সেখানে এই প্রজন্ম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত করেছিল সারা দেশ। তরুণদের এই স্লোগানে বর্তমান পাকিস্তান পর্যন্ত চমকে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী দীর্ঘ সময় সামরিক শাসক, স্বৈরশাসকদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকাকালীন তারা এই ‘জয় বাংলা’ অস্পৃশ্য ঘোষণা করেছিল। ভেবেছিল বাঙালি এটি ভুলে যাবে। কিন্তু শাহবাগের তরুণ জাগরণ এবং তাদের কণ্ঠ প্রমাণ করে—রক্তে তারা আগুন নিয়েই হাঁটছে!
এই মার্চেই শোকে উথলে উঠি আমরা। ২৬শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু সেদিন কোনো যুদ্ধ হয়নি, হয়েছে হত্যাকাণ্ড, হয়েছে জেনোসাইড। কোনো প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরেক দল প্রশিক্ষিত বাহিনীর সংঘর্ষ হলো যুদ্ধ। কিন্তু কোনো প্রশিক্ষিত বাহিনী নিরীহ, সাধারণ ঘুমন্ত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা কোনো যুদ্ধ নয়, সেটি ভয়ানক কাপুরুষতা ও অবিচার। ২৫শে মার্চ রাতে আমাদের টাকায় প্রশিক্ষিত, আমাদের টাকায় কেনা অস্ত্রে আমাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ড দেখে নিশ্চয় আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। কারণ খুব অল্প সময়ের ভেতর সেই প্রশিক্ষিত বাহিনীকে পর্যুদস্ত অবস্থায় এ দেশ ছাড়তে হয়েছিল। শুধু সাহস আর বুকের আগুন দিয়েই একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলা যায়, বাঙালি সেটি প্রমাণ করে দেখিয়েছে।
সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর মার্চ আসে। তবে আমাদের মতো এত আবেগ নিয়ে কোথাও আসে না। আমরা মার্চ নিয়ে গৌরব করি, শোক পালন করি, বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানে, সভায় স্মৃতিচারণা করি। একাত্তরের মার্চ দেখা অনেকে এখনো জীবিত; কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই প্রৌঢ়ত্বের কোঠা অতিক্রম করতে চলেছে। আর কয়েক দশকের ভেতর মার্চের ঘটনায় অংশগ্রহণকারীরা শুধুই আমাদের স্মৃতি হয়ে যাবেন। কাজেই দেশের পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থেই সরকারি উদ্যোগে তাঁদের এই স্মৃতিময় দিনগুলোকে প্রযুক্তির সাহায্যে ধারণ করে জাদুঘরসহ বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা জরুরি। আর এতে মার্চের আগুনে পুড়ে পরিশুদ্ধ হবে দেশ ও দেশের ভবিষ্যৎ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ