অস্ত্র সমর্পণের এক টুকরো স্মৃতিঃ মনোয়ার হোসেন

3962

Published on জানুয়ারি 16, 2019
  • Details Image

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করার পর বিরাজমান পরিস্থিতি কোনভাবেই প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলাও স্বাভাবিক জীবনের জন্য সহায়ক ছিল না। সর্বত্র শঙ্কা ও উদ্বেগ লক্ষ্য করা যেত। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় ছিল বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের ওপর নতুন সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকা। যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাদের কাছে যেমন ছিল বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, আবার যারা সরাসরি যুদ্ধ করেননি তাদের কাছেও ছিল বিপুল অস্ত্র। ফলে সবাই প্রতীক্ষায় আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার। তিনি দেশে ফিরে আসলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকবে এই প্রত্যাশায় দিন গুনছিল সবাই।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর স্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য জনগণের প্রত্যাশা আরও বেড়ে যায়। পরিস্থিতি উপলব্ধিতে সরকারও পিছিয়ে থাকেনি। সরকার বুঝতে পারে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে সেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আবার অস্ত্রের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগ জড়িয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান এবং তাতে কার্যকরভাবে সাড়া আসতে পারে, যদি সে আহ্বান বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে আসে। কারণ, ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন।

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি পুরানা পল্টনে অবস্থিত স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী একটি শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করছিলাম। দুপুরের একটু পর বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) এবং ছাত্রলীগের প্রখ্যাত নেতা ও প্রশিক্ষক হাসানুল হক ইনু (সাবেক তথ্যমন্ত্রী) বড় আকারের কয়েক গুচ্ছ চাবি নিয়ে সেখানে এলেন। আমাকে বললেন, আগামীকাল (৩১ জানুয়ারি) ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করা হবে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন ইউনিটকে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। দুপুরের পর যে কোন সময় অস্ত্র সমর্পণ হবে। আমি মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিলাম। এবার চাবিগুলো আমার হাতে দিয়ে তিনি বললেন, ‘স্টেডিয়ামের দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হলো। ইতোমধ্যে স্টেডিয়ামে প্রচুর গোলাবারুদ ও বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র জমা পড়েছে। আপনাকে অত্যন্ত সজাগ ও সাবধান থাকতে হবে, যেন সেখান থেকে কোন অস্ত্র বা গোলাবারুদ খোয়া না যায়। আগামীকাল সকালে দেখা হবে।’

কথাগুলো বলে তিনি চলে গেলেন। আমি বুঝতে পারলাম বিএলএফের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে এ ব্যাপারে অনুমোদন রয়েছে। এ ফোর্সের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে রয়েছেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ।

তিনজন সঙ্গী নিয়ে আমি স্টেডিয়ামে গেলাম। আমি ছাড়া তারা প্রত্যেকেই অস্ত্র সজ্জিত। প্রথমে স্টেডিয়ামের বাইরে দিয়ে একটা চক্কর দিলাম। দেখলাম স্টেডিয়ামের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকের তিনটে গেট খোলা আছে। বাকি সব গেটে তালা লাগানো। খোলা গেটের সামনে পরিচিত-অপরিচিত কয়েকজন অস্ত্রসহ দাঁড়িয়ে আছেন। স্টেডিয়ামের ভেতরের মাঠে বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদের কাঠের বাক্স রাখা আছে। যে কয়টি গেট খোলা ছিল সন্ধ্যার দিকে সেগুলোতে তালা লাগিয়ে পুনরায় পুরানা পল্টনের শ্রমিক লীগ অফিসে গেলাম। সারারাত জেগে থেকে মাঝে-মধ্যেই পরিস্থিতি দেখতে আসতে হয়েছে।

সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সঙ্গী-সাথীসহ চাবিগুলো নিয়ে স্টেডিয়ামে গেলাম। ইতোমধ্যে বিএলএফের বিভিন্ন গ্রুপের (ইউনিট) সদস্যরা অস্ত্র, গোলাবারুদসহ স্টেডিয়ামের বাইরে উপস্থিত হয়েছে। চাবি দিয়ে গেটগুলো খুলে দিতেই ¯্রােতের মতো তারা স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে লাগল এবং দেখতে দেখতে স্টেডিয়ামের ভেতরের মাঠের প্রায় অর্ধেকটাই গোলাবারুদের বাক্স ও অস্ত্রে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধুর স্টেডিয়ামে প্রবেশ করা অবধি এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের স্টেডিয়ামে প্রবেশ অব্যাহত ছিল। বিএলএফের সর্বোচ্চ পর্যায়ের চার নেতা ছাড়াও তার পরের পর্যায়ের নেতা বা অধিনায়কেরাও উপস্থিত হতে শুরু করলেন। যাদের নাম মনে আছে তাদের মধ্যে রয়েছেন- হাসানুল হক ইনু, নুরে আলম জিকু, কামরুল আলম খান খসরু, কাজী আরেফ আহমেদ, শ্রমিক নেতা আব্দুল মান্নান এবং রুহুল আমিন ভূঁইয়া। বিএলএফ সদস্য ছাড়াও মুক্তিবাহিনী এবং শ্রমিক সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত বহু সদস্যও সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন।

স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইউনিটগুলোর সশস্ত্র সদস্যরা মাঠেই বসে পড়েন। আর সাধারণ দর্শকদের জন্য স্টেডিয়ামের গ্যালারি নির্ধারণ করে রাখা ছিল। অতি অল্প সময়েই তাও পরিপূর্ণ হয়ে যায়। স্টেডিয়ামের মাঠের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে ছোট একটি ডায়াস বা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দেবেন। আর পতাকা উত্তোলনের জন্য ডায়াসের সামান্য দূরে একটা ফ্ল্যাগ পোল স্থাপন করা হয়েছিল। পতাকা উত্তোলনের জন্য তার সঙ্গে সংযুক্ত দড়ি ও পুলি কয়েকবার পরীক্ষা করে দড়িতে পতাকা বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কারণ পতাকা উত্তোলনের জন্য দড়ির যে অংশ টানতে হবে তা বঙ্গবন্ধুর হাতে ধরিয়ে দিতে হবে। মাইক ঠিকমতো কাজ করছে কিনা কয়েকবার তাও পরীক্ষা করতে হলো। যতদূর মনে পড়ে ওই অনুষ্ঠানে তাহের কোম্পানির মাইক লাগানো হয়েছিল।

দুপুরের ঠিক পর পর (সময়টা মনে নেই) বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এলেন। তাঁর দুই পাশে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি এবং আব্দুর রাজ্জাক। আশপাশে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারীরাও ছিলেন। সেই সময় অবশ্য বর্তমানের মতো নিরাপত্তা ও প্রোটোকলের বিশাল ব্যবস্থা ছিল না বা বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর আসার আগে এবং তাঁর সঙ্গে মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্যই স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেন। ওই সময় আওয়ামী লীগের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ডায়াসের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িযে ফ্ল্যাগ পোলের কাছে আসলেন। স্টেডিয়ামে স্থাপিত লাউডস্পিকারে ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল। তিনি কাছে এলে আমি দুই হাতে পতাকার সঙ্গে সংযুক্ত দাঁড়ির প্রান্ত দুটি তাঁর দিকে এগিয়ে ধরলাম। তিনি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন্টা টানব’। আমি দড়ির একটি প্রান্ত এগিয়ে দিলাম। শুরু হলো জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া। উপস্থিত সকল মুক্তিযোদ্ধা তাতে কণ্ঠ মেলালেন।

পতাকা উত্তোলনের পর তিনি ডায়াসে উঠলেন। মাইকের ঘোষণা অনুযায়ী অস্ত্র সমর্পণ পর্ব শুরু হলো। প্রথমে শেখ ফজলুল হক মনি বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে একটি অস্ত্র রেখে তার পদধূলি নিলেন। তারপর একে একে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শ্রমিক লীগের আব্দুল মান্নান অস্ত্র রাখলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর পদধূলিও নিলেন। পরে তিনি আবেগময় একটি ভাষণ দিলেন। তাঁর ওই ভাষণে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ গড়ার কাজে সঠিকভাবে নিয়োজিত করার বিষয়টি বেশ স্পষ্টভাবেই উল্লেখ ছিল। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের মধ্য দিয়েই শেষ হলো সেদিনের সেই অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠান।

প্রকাশঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত