5130
Published on জানুয়ারি 8, 2019১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শনিবার একালের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানি কারাগার হতে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করবেন বলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সেই সময় ঢাকা টিভি ছাড়া আর কোন টিভি ছিল না। রাজউক ভবন হতে তা সম্প্রচার হতো। দশ কিলোমিটারের বাইরে তা দেখার কোন সুযোগ ছিল না। খবরের একমাত্র বাহন রেডিও। তখনো একটি রেডিও’র মালিক হওয়া তেমন একটা সহজ ছিল না। মানুষ খবরের জন্য ছুটতো গলির মোড়ের পানের দোকানে। বেশীর ভাগ দোকানেই একটা রেডিওছিল। ৮ তারিখেই খবর হয়েছে পাকিস্তানের নব নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে লন্ডনগামী একটি বিমানে তুলে দিয়েছেন। জেল হতে ছাড়া পাওয়ার পর শেখ মুজিবের জন্য দেশে আসার সবচেয়ে সহজ পথ ছিল ভারত হয়ে ফেরা। একজন স্টেটসম্যান সুলভ নেতার পরিচয় দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন ভারত নয় লন্ডন হয়ে তিনি তাঁর দেশের মানুষের কাছে ফিরবেন। ভারত হয়ে ফিরলে দুর্জনরা তার অপব্যাখ্যা করতে পারে। বলতে পারে তিনি ভারতের একজন বশংবদ নেতা হিসেবেই হয়ে দেশে ফিরেছেন। আজীবন যিনি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তিনি তো নতুন ইতিহাসের শুরুতেই একজন বশংবদ নেতা হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হতে পারেন না। ঠিক করলেন আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার লন্ডন হয়েই তিনি দেশে ফিরবেন। ইসলামাবাদ হতে লন্ডন আর সেখান হতে ঢাকা ফিরতে তিনি কিছু বাড়তি সময় পাবেন। জানতে পারবেন তাঁর দেশে ঘটে যাওয়া নয় মাসের ঘটনাপঞ্জি। সাথে তিনি তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থ ড. কামাল হোসেনকেও সহযাত্রী করলেন। ড. কামাল হোসেন কী প্রেক্ষাপটে একাত্তরের ২৬ মার্চ সস্ত্রীক আটক হয়েছিলেন তা এখনো কিছুটা রহস্যাবৃত। ৮ তারিখ খুব ভোরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমান যখন লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে পৌঁছায় তখন বাইরে কনকনে শীত। ব্রিটিশ ফরেন অফিসকে আগেই পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধুর লন্ডন আগমনের সংবাদটি পৌঁছে দেয়। ব্রিটিশ ফরেন অফিস লন্ডনে বসবাসরত বাঙালি কূটনীতিকদের এই সংবাদটি আলো ফোটার আগেই জানিয়ে দেয়। সেই সৌভাগ্যবানদের মাঝে ছিলেন রেজাউল করিম, মহিউদ্দিন আহমেদ আর মহিউদ্দিন জায়গিরদার। এই তিনজনই বঙ্গবন্ধুকে হিথরো বিমান বন্দরে রিসিভ করতে যান। ব্রিটিশ ফরেন অফিস থেকেও একজন প্রতিনিধি বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন। মহিউদ্দিন আহমেদ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নেমে লাউঞ্জে প্রবেশ করলে তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরে আবেগে ডুকরে কেঁদে উঠলে বঙ্গবন্ধু তার পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন ‘ভয় নাই, আমি এসে গেছি’।লন্ডনের হোটেল থেকে বঙ্গবন্ধু ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে দেখা করতে গেলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্র্ড হীথের সাথে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার ও জনগণ অভূতপূর্ব সমর্থন যুগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দেশের জনগণকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না।
পরদিন ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় তাদের রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে লন্ডন হতে ঢাকায় পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে স্বল্প যাত্রা বিরতি করেন। সেই সকালে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতাকে সকল প্রটোকল ভেঙে দিল্লির পালাম বিমান বন্দরে রিসিভ করতে ছুটে এসেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি.ভি গিরী আর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দিল্লিতে জানুয়ারি মাসের হাড় কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে বিমান বন্দরে আরো জড়ো হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। যাত্রা বিরতিকালে বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি এবং তাঁর সরকার ও জনগণের সাহায্য ও সহায়তার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ভারত নেত্রীকে একটি মাত্র প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ভারতীয় সেনা বাহিনীকে কখন আপনি বাংলাদেশ হতে ফেরত আনছেন?’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত উত্তরে জানালেন যখন তিনি (বঙ্গবন্ধু) চাইবেন। বঙ্গবন্ধু কোন বিলম্ব না করেই বললেন ‘আমাদের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের আগেই’। অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চের আগে। কথা মতো ১২মার্চ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে বিদায়ী সালাম জানিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিন ১৭ মার্চ তেজগাঁও বিমান বন্দরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সালাম জানিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের নব গঠিত সেনাবাহিনী। প্রায় ষাট বছরের বেশি সময় আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও ইউরোপ ও জাপানে এখনো মিত্র শক্তির সেনা বাহিনী অবস্থান করছে।
দিল্লি হতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী হলেন কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান কখন আসবে সেই অপেক্ষায় ঢাকার বিমান বন্দরে তখন লাখো জনতার ভিড়। ব্রিটিশ চালক ঠিক বুঝতে পারছিলেন না তিনি কেমন করে সেই পরিস্থিতিতে বিমানবন্দরে তার বিমান নিয়ে অবতরণ করবেন। বিমানের সিটে বসা বঙ্গবন্ধু তখন মাথায় হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। ফারুক চৌধুরী তাঁর কাছে গিয়ে বললেন জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে। ফারুক চৌধুরী তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেন বঙ্গবন্ধু বাইওে তাকিয়ে শুধু একটি বাক্য উচ্চারণ করলেন, ‘এতো মানুষকে আমি খাওয়াবো কোথা থেকে?’ জনমানুষের নেতার কী অসাধারণ চিন্তা। দেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি সেই দেশের মানুষ না খেয়ে থাকে। ভারত স্বাধীন হলে সেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা গিয়েছিল। তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টি আওয়াজ তুলেছিল ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।’ নানা দেশ হতে খাদ্য সাহায্য আর কিছু ক্রয় করে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মানুষের অন্নের ব্যবস্থা করেছিলেন। কাউকে তিনি অনাহারে মরতে দেন নি। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর এই অসাধারণ কীর্তি বাংলাদেশের শত্রুদের সহ্য হয় নি। ষড়যন্ত্র করে সৃষ্টি করা হয়েছিল চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। বঙ্গবন্ধু সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. নূরুল ইসলাম। তিনি তার বাংলাদেশের শুরুর সময়ের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ-দি মেকিং অব এ নেশন’-এ সেই ষড়যন্ত্রের কথা বিস্তারিত লিখেছেন। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে যে বাংলাদেশ চুয়াত্তরে সাড়ে সাত কোটি মানুষ খাদ্যাভাবের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেই বাংলাদেশ এখন ষোল কোটি মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করে। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এই মুহূর্তে বিশ্বে চতুর্থ। মাঝে মাঝে সেই দেশ চাল রপ্তানিও করতে পারে। এই সবই হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার শাসনামলে।
তেজগাঁও বিমান বন্দর হতে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী খোলা ট্রাক রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) যেতে প্রায় দু’ঘণ্টা সময় লেগেছিল। পথের দু’ধারে তখন হাজার হাজার জনতা। একনজর তারা তাদের মহানায়ককে দেখতে চায়। রমনা রেসকোর্স মাঠের ঠিক যেই স্থানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, ঠিক সেই স্থানেই বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারির পড়ন্ত বিকেলে স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর প্রথম বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। কাকতালিয় ভাবে ঠিক একই স্থানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর পূর্বাঞ্চলিয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলিয় সেনা প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার কাছে আত্মসমর্পন করেছিলেন । বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সে দেশের জনগণ এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে যাঁরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পাশে ছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী হতে পারে তাও তিনি ষ্পষ্ট করে দিয়েছিলেন।
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে জীবিত বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা নানাভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় বিশ্বের মানুষ এই যুদ্ধের যৌক্তিকতা বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি ও বাংলাদেশের অবস্থান জেনে। একাত্তরের ঠিক কিছুদিন আগে নাইজেরিয়া হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে বায়াফ্রা নামক একটি স্বাাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করার জন্য যুদ্ধ হয়েছিল। বিশ্বের মানুষ সেই যুদ্ধকে একটি গৃহযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। বায়াফ্রা যুদ্ধকে সফল করে তোলা সম্ভব হয় নি কারণ সেই দেশে বঙ্গবন্ধুর সমতুল্য কোন নেতা ছিলেন না। সেই গৃহযুদ্ধ ব্যর্থ হয়েছিল। আর বাংলাদেশকে একাত্তরের কয়েক বছর পরও বিশ্বের মানুষ ‘মুজিব কান্ট্রি’ বা মুজিবের দেশ হিসেবে চিনতো। একসময় বঙ্গবন্ধু তাঁর দল এমন কী নিজ দেশের চেয়েও বিশ্বের মানুষের কাছে বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে কোন সময় নষ্ট না করে দেশ গড়ার কাজে লেগে গিয়েছিলেন। ১২ তারিখ তিনি তাঁর মন্ত্রীসভাকে পুনর্গঠন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অনেক কাজই হয় কঠিন হতো অথবা সম্ভব হতো না। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভিতরেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল যা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খোন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বে কেউ কেউ শুরু করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাবাহিনীর একটি অংশ সব সময় মনে করতো মুক্তিযুদ্ধটা হচ্ছে তাদের একক অবদানের ফল। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করে সংবিধান হতে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি অপসারণ করে স্বাধীনতাযুদ্ধ শব্দটি প্রতিস্থাপন করেছিলেন। অথচ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ কোন সেনাবিদ্রোহের ফল নয়। এই যুদ্ধে বাঙালি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের আপামর জনগণ যুদ্ধ করেছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে দেশের সাতজন বীর শ্রেষ্ঠর সকলই সেনাবাহিনী অথবা ইপিআরের সদস্য। এই সাতজনের বীরত্বগাথা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অবস্যই স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। কিন্তু তাঁদের কাতারে দেশ মাতৃকার জন্য অসাধরণ বীরত্ব প্রদর্শন করে নিজের জীবন দিয়েছেন অনেক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা খুঁজলে পাওয়া যাবে। পদকপ্রাপ্তদের এই তালিকাটি তৎকালীন সেনাপ্রধান কর্ণেল ওসমানির তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল। এটি সত্য এতদিন পর এই সব বক্তব্যকে অনেকে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির সাথে হয়তো তুলনা করবেন। কিন্তু কিছু বিষয়ের বিতর্ক কখনো শেষ হয়ে যায় না। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যদি সত্যি সত্যি দলের ভিতর ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়ে যেত তা হলে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারতো। তেমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তা সম্ভব হতো না। জাতিসংঘের সদস্য হওয়াটা অধরাই থেকে যেতো। ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে হয়তো বায়াফ্রার ভাগ্য বরণ করতে হতো। ক্ষমতার লড়াইয়ে ভেঙে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে পারতো আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কারণে তা সম্ভব হয় নি। ১৯৫৭ সালে কাগমারি সম্মেলনে মাওলানা ভাসানি আওয়ামী লীগ হতে বের হয়ে ন্যাপ গঠন করেছিলেন। ভাসানি আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি আর বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বের সম্মোহনী শক্তির কারণে আওয়ামী লীগ তার পূর্বের অবস্থায় রয়ে গেছে। মাওলানা ভাসানির ন্যাপকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। একই অবস্থা হয়েছিল পঁচাত্তর পরবর্তীকালে। বেগম জোহরা তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে দলটিকে কোন রকমে ধরে রাখা গিয়েছিল কিন্তু দলে নেমে এসেছিল স্থবিরতা। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা নেত্রী প্রথমে বঙ্গবন্ধুর খুনি খোন্দকার মোশতাক ও পরবর্তীকালে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। সেই দলকে পুনরুদ্ধার করতে প্রবাসে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছিল ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি হতে ২০১৭ সালে ১০ জানুয়ারি অনেক দীর্ঘ সময়। চুয়াল্লিশ বছর। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই। যে দিন বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকরা হত্যা করে সে দিন বিবিসির সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানে ভাষ্যকার মন্তব্য করেছিলেন ‘বাংলাদেশে যা কিছুই ঘটুক না কেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সেই মানুষটি না হলে যে বাংলাদেশের জন্মই হতো না ’। জয়তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু-বাঙালি ও বাংলার বন্ধু ।