3801
Published on ডিসেম্বর 10, 2018‘গলাকাটির যুদ্ধের কথা মনে অইলে এহনও শরীলে কাঁটা দিয়া ওঠে। গুলি করতে করতে আমার হাত আগুনে পোড়ার মতো হইয়া গেছিল। এসএলআরের ব্যারেল লাল টুকটুকা অইয়া গেছিল। কোনো কিছুই তহন খেয়াল আছিল না। নেশা চাপছিল, পাকিদের মারতে হবে। পাকিরাও গুলি ছুড়ছিল। সামনাসামনি দুই পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে। মুহূর্তেই ১২ সেনা খতম। পাকি সেনারা তখন পিছু হটে যায়। আমরা ক্যাম্পে ফিরে এসে ফের ওই স্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর সাতটি গাড়িসহ রেশন, হাতিয়ার, গোলাবারুদ উদ্ধার করে নিয়ে যাই। ওই সব হাতিয়ার-গুলি দিয়াই পরে আমরা যুদ্ধ করেছি।’ একাত্তরের যুদ্ধদিনের স্মৃতির কথা এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধকালীন কম্পানি কমান্ডার মো. নুরল ইসলাম।
গত শুক্রবার বিকেলে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সিংগাবরুনা ইউনিয়নের কামারবাড়ী এলাকায় কাদের মেম্বারের বাড়িতে বসে কথা হয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে। তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া আরো অনেকগুলো যুদ্ধ করেছি। আমার সামনেই ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল তাহেরের (মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর) পা পাকি বাহিনীর শেলিংয়ে উড়ে গিয়েছিল। অনেকেই শহীদ হয়েছেন। কত ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন গেছে। এখন সেসব কল্পনাও করা যায় না।’
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই বকশীগঞ্জের ধানুয়া-কামালপুরে একটি শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল পাকিস্তান বাহিনী। এর প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে ছিল মুক্তিবাহিনীর ১১ নং সেক্টরের সদর দপ্তর। কামালপুর দুর্গের পতন মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ত্বরান্বিত করেছিল। কামালপুরে পাকিস্তান বাহিনীর গ্যারিসন অবরোধ করতে গিয়ে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। কামালপুর যুদ্ধেই কর্নেল তাহের একটি পা হারিয়েছিলেন। সেই কামালপুর যুদ্ধের একজন বীর যোদ্ধা নুরল ইসলাম।
মুক্তিযোদ্ধা নুরল ইসলাম বলেন, ‘একাত্তরের জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাকিস্তান বাহিনীর সাথে আমার কম্পানির ছোট-বড় ১০-১২টা যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে বেশ কিছু পাকি সেনা খতম হয়, আমাদেরও কয়েকজন শহীদ হন। মূলত ধানুয়া-কামালপুর ঘাঁটি ছিল আমাদের যুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য। ওই সময় ধানুয়া-কামালপুর ঘাঁটির সাথে যাতে অন্যান্য এলাকার পাকিস্তান বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায় সে জন্য বকশীগঞ্জ-শ্রীবরদী সড়কে আমরা সাত-আটজন করে ভাগ হয়ে গোপনে মাইন পুঁতে রাখার কাজ করি। এ ছাড়া টিকরাকান্দি ব্রিজ, ফুলকারচর ব্রিজ আমরা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দিই।’
নুরল ইসলাম বলেন, “মাসটা সম্ভবত নভেম্বর হবে, তখন শীতের দিন ছিল। আমরা মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে অবস্থান করছি। মেজর তাহের আমাদের ডেকে বললেন ‘আজ আমরা কামালপুর স্বাধীন করব। আমি তোমার কম্পানির সাথে থাকব।’ তখন সকাল ১০টার মতো হবে। তিনি আমাদের কামালপুরের বড় রোডের সাইড দিয়ে পজিশন করান। তিনি নিজে কোনো অস্ত্র সাথে না নিলেও তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল হাতের ‘আশা’ (ছোট লাঠি)। সেটা নিয়ে নিজেই ক্রলিং করে ধানক্ষেতের বাতর (আইল) ধরে একেবারে কামালপুর পাক বাহিনীর ক্যাম্পের কাছাকাছি হাই স্কুল পর্যন্ত চলে যান। পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্প থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একপর্যায়ে তিনি আমাদের বলেন, ‘আজকে মনে হয় বদর/পাকিরা বেশি নাই। অ্যাডভান্স করো।’ মহেন্দ্রগঞ্জের আমাদের ক্যাম্প থেকে তখন মর্টারের শেল মারা হয় পাকি ক্যাম্প লক্ষ্য করে। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্প থেকে কোনো জবাব না আসায় আমরা বড় রাস্তা ধরে এগোতে থাকি। উত্তর দিক থেকে রাস্তাটি পার হয়ে দক্ষিণ পাশে যাওয়ার পরপরই আকস্মিকভাবে পাকি সেনারা ক্যাম্প থেকে অনবরত শেলিং করতে থাকে। আমরাও তখন মর্টারের গোলা, এলএমজির গুলি ছুড়তে থাকি। এমন অবস্থায় মেজর তাহের আমাদের ব্যাক করতে বলেন। প্রায় আধাঘণ্টা গোলাগুলির একপর্যায়ে আমরা ফের রাস্তা পার হয়ে উত্তর দিকে চলে আসি। দুপুরের দিকে আমরা তখন ধানুয়া-কামালপুর রাস্তার উত্তর প্রান্তে নিজেদের অবস্থানে রয়েছি। মেজর তাহের একটি চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছিলেন। হঠাৎ পাকিস্তান বাহিনীর একটি শেল এসে তাঁর পায়ের ওপর পড়লে মাংস উড়ে হাড় বেরিয়ে আসে। ওই শেলের একটি স্প্লিন্টার মজিবর নামে আমাদের এক সহযোদ্ধার চোখে আঘাত করলে সে গুরুতর আহত হয়। কিন্তু মেজর তাহের তখনো অবিচল ছিলেন। ভারতীয় ফৌজদের তখন খবর দেওয়া হলো। একটি জলচৌকিতে ভাড় বেঁধে তাহেরকে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে নেওয়া হলো। ওই সময় তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বলেন, আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি যেন শুনতে পাই, তোমরা কামালপুর স্বাধীন করেছ।’ এরপর আর তাঁর সাথে আমাদের দেখা কিংবা কথা হয়নি।”
নুরল ইসলাম বলেন, ‘ওই ঘটনার কয়েক দিন পর ধানুয়া-কামালপুর কছমন্দিন চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে নঈম মিয়ার হাটের গলাকাটি এলাকা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাইল এলাকা আমার কম্পানির আয়ত্তে ছিল। আধামাইল পরপর একটি করে বাংকার করে ১০টি বাংকারে কম্পানির সহযোদ্ধাদের ১০-১৫ জনকে একেকটি বাংকারে অবস্থান করাই। সেদিন মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে আমাদের কম্পানির জন্য লুঙ্গি পাঠানোর কথা ছিল। আমরা কয়েকজন ক্যাপ্টেন আজিজের কাছ থেকে লুঙ্গি আনতে যাওয়ার পথে দেখি তিনি জিপগাড়ি নিয়ে আসছেন। তিনি বললেন, পাকিরা আসতেছে। আমরা বাংকার করে ঘেরাও করায় তাদের রেশন বন্ধ ছিল। পাকিরা সেদিন ফাঁকা গুলি ছুড়লে সব বাংকার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন আজিজসহ আমরা সবাই তখন ফিরে এসে বাংকারগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকি। কিন্তু তাঁদের কাউকেই বাংকারে পাইনি। সামনে অগ্রসর হতে হতে একপর্যায়ে গলাকাটি সীমানার কাছে দেখি পাঞ্জাবিদের রেশনের গাড়ি আসতেছে। সেখানে রাস্তার পাশের কয়েকটি বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখে শরীর শিউরে ওঠে। আমরা তখন দেখছিলাম, কিছু পাকি সেনা ধানক্ষেত থেকে বারবার আখক্ষেতে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন আজিজ, ওয়্যারলেস মাস্টার আবেদীনসহ আমরা তখন ১২ জনের মতো ছিলাম। আমাদের সাথে ছয়টা এসএলআর এবং সবার হাতে ছিল থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। আমরা আর স্থির থাকতে না পেরে পাকি সেনাদের লক্ষ্য করে এসএলআরের ব্রাশফায়ার করি। উত্তেজনায় একপর্যায়ে আমি দাঁড়িয়ে গুলি করতে থাকি। সামনাসামনি দুই পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে। মুহূর্তেই ১২ পাক সেনা খতম। আবেদীন শুধু ব্যারেল পাল্টাচ্ছিল আর আমি অনবরত গুলি করে যাচ্ছিলাম। পাক সেনারা তখন পিছু হটে যায়। আমরা ক্যাম্পে ফিরে এসে ফের ওই স্থান থেকে পাক বাহিনীর সাত গাড়ি রেশন, হাতিয়ার, গোলাবারুদ উদ্ধার করে নিয়ে যাই। ক্যাপ্টেন মান্নাও ছিলেন সেদিন আমাদের সাথে। এরপর থেকে আমরা আর ভারতে যাইনি। দেশের ভেতরেই বাংকারে বাংকারে থাকি। কামালপুরের পশ্চিম পাশে তখন অনেকগুলো খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয় পাকিদের সাথে। আমার ৪ নম্বর বাংকারে মজিবর নামে এক সহযোদ্ধা শহীদ হন।’
শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সিংগাবরুনা ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের মৃত ইমান আলী ও মৃত জহুরা খাতুনের দুই ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে সবার বড় মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরল ইসলাম। ১৯৫৪ সালে তাঁর জন্ম। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা চলার সময় ১৭ বছর বয়সে তিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
নুরল ইসলাম বলেন, ‘১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে যুদ্ধে যাই। আমার সাথে জয়নাল সিকিরি, ফরহাদ, বাছেদ, রুহুল আমিন, আব্দুর রহমানসহ আরো ১০-১২ জন ছিল। আমরা প্রথমে ভারত সীমান্তের চেংগাপাড়া যাই। দুই-তিন দিন সেখানে থাকার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় তেলডালা রেজিমেন্টে। সেখানে আলফা কম্পানি ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন মেজর আবু তাহের। আমরা সেখানে পাঁচ শর মতো যুবক মেজর তাহেরের আন্ডারে এক মাস প্রশিক্ষণ নিই। আমাদের কম্পানিতে তখন ১৫০ জন ছিলেন। এক মাস প্রশিক্ষণ শেষে জুলাই মাসের প্রথম দিকে আমাদের মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্তে পাঠানো হয়। মহেন্দ্রগঞ্জ আসার পর এলাকাভিত্তিক বিভিন্নভাবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ করা হয়। মেজর তাহের আমাকে কম্পানি কমান্ডার নিযুক্ত করে ১৪০ জনকে আমার আন্ডারে দেন। আমার নুরল কম্পানিতে তখন টু-আইসি নিযুক্ত করা হয় লাউচাপড়ার মান্নানকে।’ তিনি বলেন, ‘কামালপুর দুর্গের পতনের পর ১০ ডিসেম্বর আমরা জামালপুর পিটিআই ক্যাম্পে যাই। সেখানে অস্ত্র জমা দিই।’