’৭৫ থেকে ’৮১- কেমন ছিল বাংলাদেশ?

33092

Published on আগস্ট 14, 2018
  • Details Image

গোলাম কুদ্দুছঃ

পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশ ঘোর অমাবশ্যায় ডুবে থাকা এক জনপদের নাম। একটা সময় পর্যন্ত অবস্থা এমন ছিল যে, কোন আশা নেই, ভালবাসা নেই, আছে শুধু লোমহর্ষক হত্যা আর ষড়যন্ত্রের জাল বুননের নানা কাহিনী। প্রতি মুহূর্তেই দৃশ্যপটের পবির্তন ঘটেছে আর মৃত্যু হয়েছে আমাদের স্বপ্নগুলোর। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বপ্নগুলোকে হায়েনার দল ক্ষতবিক্ষত করে যেন প্রতিশোধের উন্মত্ততায় মেতে উঠেছিল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর সংবিধানকেও কাটাছেঁড়া করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগুলোকে বিদায় করতে চেয়েছিল ক্ষমতা দখলকারী অপশক্তি। নতুন প্রজন্মের তরুণদের কাছে সে সময়গুলো যেন অনেকটা অস্পষ্ট-ধোঁয়াশা। ভবিষ্যত পথচলা নির্ধারণে ষড়যন্ত্র আর মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মোচনে সহায়ক হতে পারে ভেবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী দহনকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে এ নিবন্ধ রচনা।

ক.

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা তখন স্বামীর সঙ্গে ছিলেন ব্রাসেলসে। সঙ্গে শেখ রেহানাও। সে কঠিন দুঃসময়ে এ পরিবারটিকে আগলে রেখেছিলেন ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া। জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর পরামর্শে সেদিন জীবন রক্ষার জন্য আশ্রয় মিলেছিল বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে ড. ওয়াজেদ মিয়া ভারত সরকারের কাছে লিখলেন,‘শ্যালিকা রেহানা,স্ত্রী হাসিনা,শিশু ছেলে জয়,শিশু মেয়ে পুতুল এবং আমার নিজের কেবল ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের নিকট কামনা করি রাজনৈতিক আশ্রয়।’ [সূত্র : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, লেখক : এমএ ওয়াজেদ মিয়া, পৃষ্ঠা : ২৬]

তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত জানালে ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার জাম্বো জেটে দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে এসে পৌঁছুল শেখ হাসিনা ও পরিবারের জীবিত সদস্যরা। প্রথমে তাদের দিল্লীতে ডিফেন্স কলোনির একটি ফ্ল্যাটে এবং পরবর্তীতে ‘ইন্ডিয়া গেট’ সংলগ্ন পাণ্ডারা রোডস্থ একটি সরকারী বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ভারত সরকার ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়াকে ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশনে ‘পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ’ প্রদান করে। ফেলোশিপের শর্তানুযায়ী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়াকে বাসা ও অফিস যাতায়াতের সুবিধা ছাড়াও দৈনিক বাষট্টি রুপী (ভারতীয় মুদ্রা) পঞ্চাশ পয়সা ভাতা দেয়া হতো। এভাবেই কেটেছে জাতির জনকের দু’কন্যার সাদামাটা শঙ্কিত জীবন। দেশ-বিদেশের সংবাদ জানার জন্য ছিল একটিমাত্র ট্র্যানজিস্টার।

খ.

১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। বিপথগামী খুনী মেজরচক্র ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করে। খেয়াল-খুশি মতো আদেশ-অধ্যাদেশ জারি করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা চালায়। ২৩ আগস্ট মোশতাক সরকার গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান, শেখ আবদুল আজিজ, আবদুস সামাদ আজাদ, এম কোরবান আলী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, হাশেম উদ্দিন পাহাড়ীসহ আরও বেশ কয়েকজন নেতাকে। তাঁদের গ্রেফতারের পরদিন ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহকে অপসারণ করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সারাদেশে সামরিক বিধি জারি করে বেশ কয়েকটি সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত গঠন করা হয়। ৩০ আগস্ট এক সরকারী আদেশে সকল রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ৬ সেপ্টেম্বর জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এবং কয়েকদিনের ব্যবধানে আমির হোসেন আমু, গাজী গোলাম মোস্তফা, এমএ জলিল, এমএ মান্নান, সরদার আমজাদ হোসেন, নুরুল হক, এম শামসুদ্দোহা, এম মতিউর রহমানসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের নামে নির্যাতন-নিপীড়ন, বাড়িঘর ভাঙচুর, গ্রেফতার চালানো হয় দেশব্যাপী। অনেকে আশ্রয় নেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, শেখ সেলিম, ওবায়দুল কাদের, ইসমত কাদির গামা, মো. নাসিম, মোস্তফা মহসিন মন্টু, শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, লতিফ সিদ্দিকী, পংকজ ভট্টাচার্য, ডাঃ এসএ মালেক, এসএম ইউসুফ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, খোকা রায়, রবিউল মুক্তাদিরসহ অসংখ্য নেতৃস্থানীয় সংগঠক। কাদের সিদ্দিকী বেশকিছু অনুসারীসহ মেঘালয়ে আশ্রয় নেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ ও খুনীদের বিতাড়িত করার জন্য প্রতিরোধের ডাক দেন। এ সময় খুনীচক্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বোস প্রফেসর আবদুল মতিন চৌধুরী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মযহারুল ইসলামকে পদত্যাগে বাধ্য করে।

 

ক্ষমতা দখলকারী খুনীচক্র এ সময় বন্দুকের জোরে বিভিন্ন অধ্যাদেশ জারি করতে শুরু করে। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করা হয় কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’। এই অধ্যাদেশের মূল উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের রক্ষা করা। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত কারো বিরুদ্ধে দেশের কোন আদালতে অভিযোগ পেশ করা যাবে না।

১৬ অক্টোবর এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বীরউত্তমকে বিমানবাহিনী প্রধানের পদ থেকে অপসারণ করে পাকিস্তানপন্থী এমজি তাওয়াবকে বিমান বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৬ সালের ৫-৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এক সিরাতুন্নবী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন এমজি তওয়াব। সে সমাবেশে স্লোগান উঠেছিল ‘তাওয়াব ভাই তওয়াব ভাই, চাঁদ তারা মার্কা পতাকা চাই।’

গ.

এ সময় সেনাবাহিনীতে চরম বিশৃঙ্খলা চলতে থাকে। খন্দকার মোশতাক এবং জেনারেল জিয়ার প্রশ্রয়ে খুনী ফারুক-ডালিম-রশীদ চক্রের ঔদ্ধ্যত্বপূর্ণ আচরণ সেনাবাহিনীর অনেকেই পছন্দ করেনি। এমনি পরিস্থিতিতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ জেনারেল জিয়ার নিজস্ব বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪৬ ব্রিগেডের কিছু তরুণ অফিসার দিয়ে জিয়াকে গৃহবন্দী করে সেনাবাহিনীর পদ থেকে অবসরের কাগজ স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেন। পাল্টা অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে সে রাতেই খুনী মোশতাক ও মেজরচক্র কারাভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী যারা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের হত্যার পরিকল্পনা করে। ৩ নবেম্বর শেষরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সকল নিয়মনীতি ভঙ্গ করে খুনীর দল কারাভ্যন্তরে প্রবেশ করে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এইচএম কামরুজ্জামানকে একটি কক্ষে জড়ো করে ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে।

জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার পর সর্বত্র আতঙ্ক, বিশৃঙ্খলা ও গুজব প্রচার হতে থাকে। ৪ নবেম্বর আওয়ামী লীগ ধানমণ্ডি ৩২নং সড়ক পর্যন্ত এক শোক মিছিল বের করে এ মিছিলে খালেদ মোশাররফের মা, ভাই রাশেদ মোশাররফ অংশ নেন। সর্বত্র প্রচার হতে থাকে যে, ভারতীয় সহযোগিতায় খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করেছে। এমনি পরিস্থিতিতে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ ও গণবাহিনীর নামে লিফলেট বিতরণ এবং বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যাই হোক, পাল্টা অভ্যুত্থানে জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিহত হন এবং জিয়া পুনরায় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাসদের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং দেশী-বিদেশী চক্রান্তে জিয়া সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন।

এর মধ্যে জেনারেল ওসমানীর মধ্যস্থতায় খুনী মেজরচক্র নিরাপদে দেশত্যাগ করে। খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে ৩ নবেম্বর রাত ৮টায় খুনী মেজরচক্রকে ব্যাংকক পাঠিয়ে দেন। সে রাতে যারা দেশত্যাগ করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ১. লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ, ২. মেজর শরিফুল হক ডালিম, ৩. মেজর আজিজ পাশা, ৪. মেজর মহিউদ্দিন, ৫. মেজর শাহরিয়ার ৬. মেজর বজলুল হুদা ৭. মেজর রাশেদ চৌধুরী ৮. মেজর নূর ৯. মেজর শরফুল হোসেন ১০. লেফটেন্যান্ট কিসমত হোসেন ১১. লে. খায়রুজ্জামান ১২. লে. আবদুল মাজেদ ১৩. হাবিলদার মোসলেউদ্দিন ১৪. নায়েক মারফত আলী ১৫. নায়েক মো. হাসেম।

ব্যাংকক পৌঁছেই এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করার কথা স্বদম্ভে ঘোষণা করে। 

ঘ.

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। সামরিক আইনের বিধি সংশোধন করে সুপ্রীমকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিকট মোশতাক ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ৬ নবেম্বর। ওইদিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের পর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বেতারে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘... গত ১৫ আগস্ট কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত এবং চাকরিচ্যুত সামরিক অফিসার এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের হত্যা করে। খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে সামরিক আইন জারি করেন। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনার সঙ্গে সামরিক বাহিনী সংশ্লিষ্ট ছিল না।

দেশবাসী আশা করেছিল, দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরে আসবে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু আমরা সবাই নিরাশ হয়েছি। দেশে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমনকি সম্প্রতি কারাগারে অন্তরীণ কিছু বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ...দেশে সামরিক আইন জারি রয়েছে। আমি একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ন্যূনতম সময়ের মধ্যে অবাধ নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। আমরা এই দায়িত্ব ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, অথবা সম্ভব হলে তার পূর্বেই পালন করতে বদ্ধপরিকর।’ [সূত্র : বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলো লেখক, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, পৃষ্ঠা-৫৭] 

ইতোমধ্যে জিয়াউর রহমান বন্দীদশা থেকে কর্নেল তাহেরের আনুকূল্যে মুক্তিলাভ করেন। ৭ নবেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব প্রথম দিকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনীর নেতা কর্নেল তাহেরের নিকট থাকলেও দ্রুতই দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়। মুক্ত হয়েই জিয়া দ্রুত দেশী-বিদেশী শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করে কর্নেল তাহের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন এবং ক্ষমতার মূল কেন্দ্রের কর্তৃত্ব নিয়ে নেন। যার কারণে প্রেসিডেন্ট সায়েম জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রথম ভাষণের ২৪ ঘণ্টা পরই দ্বিতীয় ভাষণ দিতে বাধ্য হন। এ ভাষণে তিনি বলেন, ‘... পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনার জন্য আমরা কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠু পরিচালনার জন্যে দেশে সামরিক আইন প্রশাসন কাঠামো গঠন করা হয়েছে। এই কাঠামোতে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হবেন। এতে তিনজন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকবেন। তাঁরা হচ্ছেন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, নৌবাহিনী প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এমজি তাওয়াব। দেশের চারটি বিভাগে চারজন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক থাকবেন।’ [সূত্র : প্রগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫৯]

বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি হলেও বস্তুত সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় জেনারেল জিয়ার হাতে। ৮ থেকে ১০ নবেম্বরের মধ্যে জাসদ নেতা এমএ জলিল, আ.স.ম রব প্রমুখ জেল থেকে বেরিয়ে এলেও ২৩ ও ২৪ নবেম্বর পুনরায় এমএ জলিল, হাসানুল হক ইনুসহ জাসদ ও গণবাহিনীর অধিকাংশ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। ২৪ নবেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সলিমুল্লাহ হলের এক হাউস টিউটরের বাসা থেকে কর্নেল তাহের গ্রেফতার হন। কর্নেল তাহেরের মুক্তির লক্ষ্যে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করার উদ্যোগ নেয় বিপ্লবী গণবাহিনী। দলের ছয় সদস্য ঢাকার ধানমণ্ডিতে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন দখলে নিতে গেলে আসাদ-বাচ্চু-মাসুদ-হারুন নামে চারজন গেরিলা নিরাপত্তা রক্ষীর গুলিতে নিহত হন এবং অবশিষ্ট দু’জন বেলাল ও সবুজ আহতাবস্থায় গ্রেফতার হন। এদের একজন ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর ও আল শামস্ বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি এক অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী দালালদের বিচারের জন্য সারাদেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত এই আইনে ৩৭৪৭১ জনকে গ্রেফতার এবং অনেককে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকার এক আদেশে দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে যারা খুন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশ নিয়েছিল তাদের ছাড়া অন্যদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। অবশ্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে সরকার জুলাই ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট ১৯৭৩ বাংলাদেশ সংসদে পাস করিয়ে নেয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি এবং ক্ষমতালোভী চক্রের সরকার ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এক আদেশে দালাল আইন বাতিল করে দেয়। এর ফলে সমস্ত যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার এবং অভিযোগ থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়। শহীদদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে বুক ফুলিয়ে চলতে শুরু“করে রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ বাহিনীর সদস্যরা।

১ মে ১৯৭৬ ঢাকায় এক শ্রমিক সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু সরকারের সমালোচনা করে বলেন, সে সময় মানুষকে অবাধে ধর্ম পালন করতে দেয়া হয়নি। তার ঠিক দু’দিন পর ৩ মে ১৯৭৬ সরকার এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮নং অনুচ্ছেদ বাতিল করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল জেনারেল জিয়া সংবিধানের ৯ সংশোধনীর মাধ্যমে তা আইনে পরিণত করেন। এর ফলে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, পিডিপি, নেজামে ইসলামসহ অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহ আবার তাদের তৎপরতা শুরু“করে। রাষ্ট্র-সমাজ আর রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয় যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ বাহিনীর সদস্যরা।

অপরদিকে ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই এক বিশেষ সামরিক আদালতে ‘সরকার উৎখাত ও সেনাবাহিনীকে বিনাশ করার চেষ্টা চালানোর’- অভিযোগে জাসদনেতা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড এবং এমএ জলিল, আ.স.ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনু, তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানসহ আরও অনেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি প্রদান করা হয়। কথিত আছে যে, জিয়াউর রহমানের অনমনীয় সিদ্ধান্তের কারণে আন্তর্জাতিক সকল আইনকানুন লঙ্ঘন করে ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। 

ঙ.

১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই বিচারপতি সায়েমের সামরিক সরকার রাজনৈতিক দলবিধি জারি করে। ৩০ জুলাই থেকে শুরু“হয় ঘরোয়া রাজনীতি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ২৫ আগস্ট ১৯৭৬ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্যসহ নেতৃবৃন্দের আনুষ্ঠানিক বর্ধিতসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’Ñ নামে দল পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পূর্বোক্ত কমিটির সভাপতি এএইচএম কামরুজ্জামান ৩ নবেম্বর কারাগারে নিহত হন। সাধারণ সম্পাদক জিল্লুুর রহমান এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক কারাগারে বন্দী। এমনি পরিস্থিতিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়।

 

খুনী খন্দকার মোশতাকের নবগঠিত ডেমোক্র্যাটিক লীগ এবং স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সরকারী অনুমোদন পেলেও আওয়ামী লীগ নিয়ে টালবাহানা করা হয়। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাদ দেয়ার জন্য পত্র দেয়া হয়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত বিচারপতি সায়েমের সরকার ১৯৭৬ সালের ৪ নবেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে অনুমোদন প্রদান করে।

বিএনপির নেতৃবৃন্দ প্রায়ই বলে থাকেন, জেনারেল জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা এবং আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল করার অনুমতিদাতা। এ কথাটি সর্বৈব মিথ্যা। কারণ, সে সময়ে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন বিচারপতি সায়েম।

পঁচাত্তরপরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও ক্ষমতার মধ্যকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণকারী সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক অভিলাষ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। সামরিক সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলসমূহ যখন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল- ঠিক সেই সময়ে ২১ নবেম্বর ১৯৭৬ রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এএসএম সায়েম এক ঘোষণার মাধ্যমে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ সালে প্রতিশ্রুত সাধারণ নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হন। সরকারী আদেশের প্রতিবাদ করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং অবাধে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ দাবি করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ নবেম্বর সেনাপ্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদ গ্রহণ করেন এবং তার চাপের কারণেই ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েম পদত্যাগে বাধ্য হন এবং জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি হন। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ৩ ডিসেম্বর ১৯৭৬ লন্ডনের বিখ্যাত ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় বলা হয়, ‘প্রশাসন ক্ষেত্রে সায়েমের (প্রেসিডেন্ট) কোন ভূমিকা ছিল না এবং কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে পরামর্শও করা হতো না। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি পীড়াপীড়ি করছিলেন এবং শাসনক্ষমতা থেকে সামরিক বাহিনীকে বিদায় দেয়ার জন্য তিনি ঘরোয়াভাবে শলা-পরামর্শ শুরু“করেছিলেন। এখন তাঁকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হবে। সায়েমকে অসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে এতদিন রাখা হয়েছিল (মে.জে.) জিয়ার সামরিক শাসনের চেহারা ঢেকে রাখার জন্য।’

জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করে সেদিনই গ্রেফতার করেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেক উকিল, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজেদা চৌধুরী, আবদুল মোমেন তালুকদার, সালাউদ্দিন ইউসুফ, মোজাফফর হোসেন পল্টু, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া এবং ন্যাপ নেতা মতিয়া চৌধুরীসহ আরও অনেককে।

চ.

বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, গ্রেফতার-নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্যেও এ সময় আওয়ামী লীগ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় এবং দেশব্যাপী সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করে। ১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল ঢাকার হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের দু’দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন বেগম মনসুর আলী। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী ও মোল্লা জালালউদ্দিন। সম্মেলনে ১৪০০ কাউন্সিলর ও ১৪০০ ডেলিগেট অংশ নেন। উক্ত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু সরকার ঘোষিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাকে আওয়ামী লীগের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে পরবর্তী সম্মেলন না হওয়া পর্যন্ত বেগম জোহরা তাজউদ্দীনকে অন্তর্বর্তী আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে সাংগঠনিক কমিটির ৪৪ সদস্যের নাম নির্বাচনের দায়িত্ব তাঁকে দেয়া হয়। ১৫ এপ্রিল বেগম জোহরা তাজউদ্দীন ৪৪ জনের নাম ঘোষণা করেন। তাঁরা হলেন :

আহ্বায়ক : সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, সদস্য : ১. মোল্লা জালালউদ্দিন আহমদ, ২. ফণীভূষণ মজুমদার, ৩. কাজী জহিরুল কাইয়ুম, ৪. মতিউর রহমান, ৫. মিজানুর রহমান চৌধুরী, ৬. আব্দুল মান্নান, ৭. আব্দুল মোমিন, ৮. সোহরাব হোসেন, ৯. আসাদুজ্জামান খান, ১০. মনোরঞ্জন ধর, ১১. দেওয়ান ফরিদ গাজী, ১২. অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, ১৩. ডাঃ ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল, ১৪. মো. ময়েজউদ্দিন আহমেদ, ১৫. মফিজুল ইসলাম খান কামাল, ১৬. ফজলুল করিম, ১৭. মোঃ হানিফ, ১৮. আনসার আলী, ১৯. ওমর আলী, ২০. শামসুর রহমান খান (টাঙ্গাইল), ২১. ব্যারিস্টার শওকত আলী, ২২. মহিউদ্দিন আহমদ (বরিশাল), ২৩. আহাম্মদ আলী (কুমিল্লা), ২৪. আলী আজম ভূঁইয়া, ২৫. নুরুল ইসলাম, ২৬. এ.বি.এম তালেব আলী (ফেনী), ২৭. অধ্যাপক মোঃ হানিফ (নোয়াখালী), ২৮. অধ্যাপক হাকিম (ময়মনসিংহ), ২৯. খন্দকার আবুল কাশেম (পটুয়াখালী), ৩০. কামরুজ্জামান (যশোর), ৩১. হাদিউজ্জামান, ৩২. আজিজুর রহমান আক্কাস (কুষ্টিয়া), ৩৩. খন্দকার আবু তালেব (পাবনা), ৩৪. ডাঃ আলাউদ্দিন (রাজশাহী), ৩৫. এ.কে মজিবুর রহমান (বগুড়া), ৩৬. লুৎফর রহমান (রংপুর), ৩৭. আবদুর রহিম (দিনাজপুর), ৩৮. সিরাজুল ইসলাম, ৩৯. মোহাম্মদ মহসীন (খুলনা), ৪০. সৈয়দ কামাল বখত, ৪১. নুরুন্নবী (ফরিদপুর), ৪২. এম.এ ওয়াহাব (চট্টগ্রাম), ৪৩. বেগম মাহমুদা চৌধুরী (ঢাকা) ও ৪৫. রওশন আরা মোস্তাফিজ (রংপুর)।

ছ.

২১ এপ্রিল ১৯৭৭ অকস্মাৎ বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি থেকে পদত্যাগ করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া প্রসঙ্গে বিচারপতি সায়েম বলেন,

‘... যেহেতু জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছেন, এবং আমার মনে হয়েছে যে, উপদেষ্টা কাউন্সিলের অধিকাংশ সদস্যই তাঁকে সমর্থন করেছেন, তাই আমি তাঁকে আবার জিজ্ঞেস করি যে, তিনি নিজে কোন হুমকির সম্মুখীন না হয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বাবলী সামলাতে পারবেন কি না। তিনি হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। ... প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার আগ মুহূর্তে আমি জিয়াকে বলি, আমি যেহেতু নির্বাচন করে যেতে পারলাম না, আমি তাঁকে অনুরোধ করব তিনি যেন নির্বাচন দেন। তিনি আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন যে, তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন। শুনে আমি খুশি হই। কিন্তু আমি তখন বুঝতে পারিনি যে, নির্বাচনে তিনি নিজেই অংশ নেবেন। সেরকম ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এবং সামরিক আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবেও, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি নির্বাচন করবেন এবং সেই নির্বাচনে নিজে অংশগ্রহণ করবেন এমন চিন্তা তখন আমার মাথায় আসেনি।’

[সূত্র : বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলো, লেখক- আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, পৃষ্ঠা-৩৬]

জিয়াউর রহমান কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে সকল ক্ষমতা গ্রহণ করার পরদিনই সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে বাহাত্তরের সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে আদর্শিক পরিবর্তন আনে। সংবিধানের শিরোনামে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লিপিবদ্ধ করা হয়। ‘জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’-এর পরিবর্তে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার কথাগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়। এ অধ্যাদেশের ফলে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সকল মানুষের সমান অধিকার এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় এক প্রচণ্ড ঝাঁকি লাগে।

২২ এপ্রিল ১৯৭৭ রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং একই সঙ্গে সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল জিয়া এক বেতার ভাষণে ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। একই ভাষণে তার ওপর জনগণের আস্থা আছে কি না তা যাচাইয়ের জন্য ৩০ মে ১৯৭৭ দেশব্যাপী গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। সে সময় দেশে ভোটারের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৩ হাজার ৮৫৬ জন। অবিশ্বাস্যভাবে সরকারী ঘোষণায় বলা হয় ৮৮.৫% ভোটার গণভোটে অংশ নিয়েছেন এবং জিয়াউর রহমানের পক্ষে ‘হ্যাঁ’সূচক ভোট পড়েছে ৯৮.৮৮%। বিএনপির কথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়াউর রহমানের ‘ভোটারবিহীন বাক্স পূর্ণ’ এ নির্বাচনকে তরুণ প্রজন্মের বিএনপি সমর্থকরা কি বলবেন?

এ নির্বাচন প্রসঙ্গে বিচারপতি সায়েম বলেন,

“বস্তুত জিয়া তাঁর অবস্থান সংহত করার উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে একটা গণভোট করে ফেলেন। তাঁর প্রতি এবং তাঁর ঘোষিত নীতি ও কর্মসূচীর প্রতি ভোটারদের আস্থা আছে কি না তাই ছিল গণভোটের বিষয়। কিন্তু সেই গণভোটে হ্যাঁ বাক্সে এত বেশি ভোট পড়ে যে, জনগণ সেই ফলাফলকে হাস্যকরভাবে অবিশ্বাস্য মনে করে।”

[সূত্র : বঙ্গভবনের শেষ দিনগুলো, লেখক- আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, পৃষ্ঠা-৩৭]

 

আওয়ামী লীগ এবং জাসদ ‘হ্যাঁ-না’ ভোট বর্জন করে। সিপিবি ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর) আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও ‘হ্যাঁ’ ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরবর্তীতে ময়মনসিংহ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী খননে জিয়াউর রহমানের কর্মসূচীতে যোগ দেয়। সিপিবি তখন জিয়াউর রহমানের সরকারকে- “সীমাবদ্ধ হইলেও মূলত দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী” হিসেবে আখ্যায়িত করে।

[সূত্র : কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের সময় হইতে কেন্দ্রীয় কমিটির মূল নীতি ও কার্যাবলী পর্যালোচনা ২৮/৯/১৯৭৯ পৃষ্ঠা-১৮/১৯]

বাকশালের অন্যতম অংশীদার সিপিবি-ন্যাপ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারীদের দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী মূল্যায়ন করা কত বড় রাজনৈতিক ভুল ছিল তা নিশ্চয়ই আজ দলের নেতৃত্ব উপলব্ধি করছেন। কারণ, সেই সরকারই দালাল আইন বাতিল করে দেয়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে, সমাজতন্ত্র শব্দটিকে সংবিধান থেকে ছেঁটে ফেলে। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। পরে জিয়াউর রহমানের সরকার সিপিবি সভাপতি মণি সিং এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদকে গ্রেফতার করে।

জ.

এ সময় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে অনেক ক্যু, পাল্টা ক্যু সংঘটিত করার তৎপরতা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ বিমান বাহিনী দিবসে একটি ক্যু করার পরিকল্পনার কথা জানা যায়। কিন্তু এর একদিন আগে ২৭ সেপ্টেম্বর জাপান এয়ারলাইন্সের একটি ডি-সি-৮ বিমান ১৫৬ জন যাত্রীসহ হাইজ্যাক হয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। জাপানী রেড আর্মির ‘হিদাকা কমান্ডো ইউনিট’-এর পাঁচজন সদস্য ৬ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ ও জাপানের কারাগারে আটক তাদের সহযোদ্ধাদের মুক্তির দাবিতে এ ছিনতাই করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কুদেতারা তারিখ পরিবর্তন করে। দু’দিন পিছিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর ২২ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা দু’জন অফিসারকে হত্যা এবং ৯৩ ব্রিগেড কমান্ডারসহ কয়েকজন অফিসারকে বন্দী করে কারাগারে আটক ১৭ সৈনিককে মুক্ত করে দেয়। একই সময় ঢাকায় আর্মি ফিল্ড সিগন্যাল ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা সিগন্যালম্যান শেখ আবদুল লতিফের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তাদের সঙ্গে কুর্মিটোলা এয়ার বেইসের সিপাহীরা যোগ দেয়। ভোররাতে বিদ্রোহীরা রেডিও স্টেশন দখল করে এবং বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়। কয়েক শত সৈন্য এয়ারপোর্ট দখল করে নয় জন অফিসার এবং বিমানবাহিনীর দুই জন পাইলটকে হত্যা করে। ইতোমধ্যে জেনারেল জিয়ার অনুগত সৈন্যরা বিমানবন্দর এবং রেডিও স্টেশন পুনর্দখল করে নেয়। সংঘর্ষে কয়েকজন সৈন্য নিহত হয়। জিয়াউর রহমান এক বেতার ভাষণে বিদ্রোহ দমন করার কথা ঘোষণা করেন। এই ক্যু এবং পাল্টা ক্যু প্রচেষ্টায় কিছু অফিসার ও সৈনিকের মৃত্যু হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সামরিক আদালতে ১১৪৩ জনকে ফাঁসি এবং কয়েকজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করে জিয়াউর রহমান তার অবস্থান সুদৃঢ় করেন।

ঝ.

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৭ জেনারেল জিয়া এক বেতার ভাষণে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি ফ্রন্ট গঠনের কথা বলেন। অতঃপর তার ইচ্ছানুযায়ী উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে আহ্বায়ক করে জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী দল (জাগদল) গঠন করা হয়।

১৯৭৮ সালের ৩-৫ মার্চ ঢাকায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর এটিই ছিল সামরিক শাসনের অধীনে প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাউন্সিল। এ কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নতুন করে উজ্জীবিত ও সংগঠিত হয়। উক্ত কাউন্সিল অধিবেশন থেকে অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া কারাগারে আটক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মুক্তি এবং ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং জেলহত্যার বিচার দাবি করা হয়। সম্মেলনে পরবর্তী দু’ বছরের জন্য আবদুল মালেক উকিলকে সভাপতি এবং আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করার নানা উদ্যোগের কথা শোনা যায়। খুনী মোশতাকের নেতৃত্বে গঠিত হয় ডেমোক্র্যাটিক লীগ। ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট মিজানুর রহমান চৌধুরী ঢাকায় নিজ বাসভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন। সাংবাদিক সম্মেলনে নিজেকে আহ্বায়ক ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের নামে একটি কমিটি ঘোষণা করেন। একজন প্রবীণ নেতা হিসেবে তাঁর এ ঘোষণায় দেশবাসী বিস্মিত হলেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিভ্রান্ত হয়নি। তাঁরা জানে কোনটি তাদের প্রকৃত ঠিকানা।

৫ এপ্রিল ১৯৭৮ জেনারেল জিয়ার সরকার বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে এক অধ্যাদেশ জারি করে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্বাধীনতা বিরোধীরা এবং বিদেশে পালিয়ে থাকা আলবদর-রাজাকারদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যার ফলাফল পরবর্তীতে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে।

রাজনৈতিক দলসমূহের দাবির মুখে জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার ২১ এপ্রিল ১৯৭৮ এক ঘোষণার মাধ্যমে ৩ জুন ১৯৭৮ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। স্বল্প সময়ের প্রচারণার সুযোগ রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা সরকারের এক ধরনের চাতুরী ছাড়া আর কিছু নয়Ñ জনগণ এটি বুঝে নেয়। ২২ এপ্রিল অপর এক ঘোষণায় বলা হয় ১ মে থেকেই রাজনৈতিক তৎপরতা চালানো যাবে। ২৮ এপ্রিল জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার ইতোপূর্বে জারিকৃত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অধ্যাদেশ সংশোধন করে একটি নতুন অধ্যাদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে একমাত্র সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন এবং রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। বন্দুকের জোরে গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতার অপব্যবহারের এ ধরনের নজির সারা বিশ্বে বিরল। যাই হোক, জেনারেল জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত উপ-রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন জাগদল, মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বাধীন ভাসানী ন্যাপ, কাজী জাফরের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই) এবং বাংলাদেশ লেবার পার্টির সমন্বয়ে ১৯৭৮ সালের ১ মে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’Ñ গঠিত হয়। এ ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, রাষ্ট্রপতি ও সেনাবাহিনীপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

অপরদিকে সংসদীয় গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলসমূহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট’ গঠন করে। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর), সিপিবি, জনতা পার্টি, গণআজাদী লীগ ও পিপলস লীগ কৌশলগত কারণে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সামরিক সরকারের গণতন্ত্রের লেবাসের স্বরূপ উন্মোচন ছিল ‘গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট’-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মূল উদ্দেশ্য। এ নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট মনোনীত রাষ্ট্রপতি প্রার্থী জেনারেল জিয়া প্রদত্ত ভোটের ৭৬.৭% এবং গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট মনোনীত জেনারেল ওসমানী ২১.৭% ভোট পেয়েছেন বলে সামরিক সরকার মনোনীত নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে।

২৯ জুন ১৯৭৮ রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ৩০ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ২৮ জন পূর্ণমন্ত্রী এবং ২ জন প্রতিমন্ত্রী। নীলনক্সার নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি নতুন রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ সংক্ষেপে বিএনপি গঠন করে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮-এ দলের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করেন।

ঞ.

১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া এক ফরমান জারি করে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে প্রেসিডেন্টের হাতে প্রায় সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর নির্বাচনী প্রচারের স্বল্প সুযোগ দিয়ে ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৯ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলসমূহ আপত্তি জানায়। এ সময় জাসদ, ইউপিপি, আতাউর রহমানের জাতীয় লীগসহ ১০টি দলের সমন্বয়ে একটি জোট গঠিত হয়। এই ১০ দলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবিÑ সামরিক আইন প্রত্যাহার, সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য কিছু দাবি উত্থাপন করে। ৪ জানুয়ারি ১০ দলীয় জোটের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের এ সংক্রান্ত আলোচনা ব্যর্থ হলে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর পরদিন নির্বাচন কমিশন এক ঘোষণায় ২৭ জানুয়ারির পরিবর্তে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পুনঃতফসিল ঘোষণা করে। সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ায় এবং নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু থেকেই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় থাকলেও সামরিক সরকারের মুখোশ উন্মোচন এবং আন্দোলনের অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলসমূহ এ নির্বাচনে অংশ নেয়। ক্ষমতাসীন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন নবগঠিত বিএনপি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করে।

বহু আলোচিত সে নির্বাচনের ফলাফল ছিল এ রকম (সূত্র : নির্বাচন কমিশন) :

৩১ মার্চ জেনারেল জিয়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে যোগদানকারী শাহ্ আজিজুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।

৫ এপ্রিল ১৯৭৯ নবগঠিত জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাস করিয়ে নেয়া হয়। এর ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের মধ্যে সামরিক আইনের মাধ্যমে জারিকৃত সকল ফরমান, সংবিধানের সকল সংশোধনী নিয়ে আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অপর কোন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রশ্ন তোলার অধিকার রহিত করা হলো।

১৯৭৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গেজেট নোটিফিকেশন নং- ৭/৮/১৭৫-১৬০ অনুযায়ী তৎকালীন সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান নিজেকে মেজর জেনারেল পদ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করেন। কিন্তু একই বছরের ৯ এপ্রিল তারিখের গেজেট নোটিফিকেশন নং- ৭/৮/২৭৫/২৭০ অনুযায়ী পূর্বে ইস্যুকৃত নোটিফিকেশন বাতিল করে নতুন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়, যা ১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে কার্যকর করা হয়। ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ জারিকৃত আরেকটি নোটিফিকেশন নংÑ ৭/৮/১৭৫-২৭০ অনুযায়ী জিয়াউর রহমান লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন, যা ১৯৭৮ সালের ২৯ এপ্রিল তারিখ থেকে কার্যকর করা হয়। এসব সিদ্ধান্তের কোন কারণ জানা না গেলেও এটা স্পষ্ট এবং দালিলিকভাবে প্রমাণিত যে, ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জেনারেল জিয়া সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। ব্যাক ডেটে কেন তিনি পদোন্নতি নিয়ে আবার অবসরে যাবার জন্য ব্যাক ডেটকে ব্যবহার করেন তা আজও বোধগম্য নয়।

ট.

জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও ক্ষমতার ভিত্তিকে পাকাপোক্ত করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যাকারী মেজরচক্র পুনরায় ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তাদেরই আনুকূল্য এবং যোগসাজশে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পাওয়া জেনারেল জিয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতাকে মেজরচক্র পুরো মেনে নিতে পারেনি। আর সে কারণেই পাল্টা ক্যুর মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জাল বুনতে থাকে। দেশে-বিদেশে অবস্থান করে নানা বৈঠক শেষে ১৭ জুন ১৯৮০ সিপাহি বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অফিসাররা দ্বিমত পোষণ করায় ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। অনেকে অভিযুক্ত থাকার কথা শোনা গেলেও সর্বশেষ পাঁচজনকে সশস্ত্র অভ্যুত্থান সংঘটিত করার ষড়যন্ত্রের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। অভিযুক্তরা হলেন : লে. কর্নেল দিদারুল আলম, লে. কর্নেল নুরুন্নবী খান, লে. কর্নেল আনোয়ার আজিজ পাশা, মেজর কাজী নূর হোসেন এবং সে সময় কৃষি ব্যাংকে প্রশিক্ষণরত অফিসার মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন বীর প্রতীক। বিচারে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে লে. কর্নেল দিদারুল আলমকে ১০ বছর, মোশাররফ হোসেন বীর প্রতীককে ২ বছর এবং লে. কর্নেল নুরুন্নবী খানকে ১ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। খুনী মেজর চক্রের দুই সদস্য লে. কর্নেল আনোয়ার আজিজ পাশা এবং মেজর কাজী নূর হোসেন দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ায় তাদের কোন শাস্তি না দিয়েই জিয়াউর রহমানের সরকার আংকারা এবং তেহরানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে পূর্বের চাকরিতে ফেরত পাঠান। এভাবে প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনীদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়।

খুলনা কারাগারে আটক কয়েদিরা কিছু সুনির্দিষ্ট দাবী আদায়ের জন্য ১২ অক্টোবর ১৯৮০ ডেপুটি জেলারসহ ২৪ জন ব্যক্তিকে জিম্মি হিসেবে আটক করে। ২১ অক্টোবর পুলিশ বাহিনী কারাগারে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৩৫ জন কয়েদিকে হত্যা করে আটক জিম্মিদের উদ্ধার করে।

ঠ.

এ সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটো বড় ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি। একটি হলো জাসদের ভাঙন এবং আরেকটি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচন। স্বাধীনতার পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সংক্ষেপে জাসদের প্রতিষ্ঠা এবং উত্থান সকলেই প্রত্যক্ষ করেছি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তরুণ নেতৃত্বের একটি অংশ স্বাধীনতার পর ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে। সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে তারা নতুন দল জাসদ গঠন করেন। বিভক্ত হয়ে যায় ছাত্রলীগ।

এ সংগঠন গড়ার মূল নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ, মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, মো. শাহজাহান, নূরে আলম জিকু, খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, আবদুল্লা সরকার, আ ফ ম মাহবুবুল হক, এ্যাডভোকেট হাবিবুল্লাহ চৌধুরী, মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, কামরুজ্জামান টুকু, একরামুল হক, মমতাজ বেগম, বিধানকৃষ্ণ সেন, মোশাররফ হোসেন, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখ। ১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রছাত্রী সংসদ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ প্যানেল থেকে মাহমুদুর রহমান মান্না ভিপি এবং আক্তারুজ্জামান জিএস নির্বাচিত হন।

১৯৮০ সালে এসে জাসদ বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর জন্ম হয়। এ সংগঠনটির নেতৃত্বে আসেন খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, আবদুল্লা সরকার, মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, আ ফ ম মাহবুবুল হক, এ্যাডভোকেট হাবিবুল্লা চৌধুরী, মমতাজ বেগম, সুভ্রাংশু চক্রবর্তী, মাইনুদ্দিন খান বাদল, একরামুল হক প্রমুখ। মাহমুদুর রহমান মান্না, আক্তারুজ্জামান, জিয়াউদ্দিন বাবলুর নেতৃত্বে জাসদ ছাত্রলীগের বড় অংশই বাসদের সঙ্গে যুক্ত হয়।

১৯৭৬ সালে সামরিক সরকারের রাজনৈতিক দলবিধি অনুযায়ী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) অনুমোদন লাভ করে। এ সময় তারা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আহ্বানে ‘খালকাটা’ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দল কর্তৃক সামরিক শাসকের কর্মসূচী বাস্তবায়নে এ ধরনের উদ্যোগ নজিরবিহীন।

ড.

১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ইডেন হোটেলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে দলের নেতৃত্ব এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। এ নির্বাচনের পেছনে দুটি কারণ বিদ্যমান ছিল বলে সর্বমহল থেকে বলা হয়েছে। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে দক্ষিণপন্থীদের হাতে চলে যাচ্ছে তাকে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। এক সময়কার প্রগতিশীলদের এক বড় অংশই ক্ষমতার লোভে সামরিক শাসকের সহযোগী হয়ে সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। এমনই পরিস্থিতিতে দলের নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের কাছে শতভাগ আস্থাশীল নেতৃত্বের প্রয়োজন দেখা দেয়। এছাড়া পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং বাস্তব অবস্থার নিরিখে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে দলের দায়িত্ব প্রদানের দাবী ওঠে দেশের সর্বস্তরে।

নেতা-কর্মীদের আকাঙ্ক্ষা এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করে বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং বিশ্বস্ত নেতৃত্বের অনেকেই দিল্লী গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে মতবিনিময় করে তাঁকে রাজি করাতে সমর্থ হন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শেখ সেলিম, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, ডা. এসএ মালেক এবং দলীয় নেতাদের মধ্যে জিল্লুর রহমান, আইভি রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, আবদুর রাজ্জাক, কোরবান আলী, সাজেদা চৌধুরী প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে দিল্লী গিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার খোঁজ-খবর নেন এবং রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করেন। অবশেষে ভারতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে প্রথমবারের মতো সভাপতিমণ্ডলী গঠন করা হয়।

কমিটির মূল কাঠামো হলো সভাপতি : শেখ হাসিনা

সভাপতিমণ্ডলী : আবদুল মালেক উকিল, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, ড. কামাল হোসেন, আবদুল মান্নান, কোরবান আলী, জিল্লুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, মহিউদ্দিন আহমদ, আবদুল মমিন তালুকদার, ফণিভূষণ মজুমদার।

সাধারণ সম্পাদক : আবদুর রাজ্জাক

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক : বেগম সাজেদা চৌধুরী ও আমির হোসেন আমু

সম্পাদক মণ্ডলী :

সাংগঠনিক : তোফায়েল আহমদ

প্রচার : সরদার আমজাদ হোসেন

দফতর : সৈয়দ আহমদ

শিক্ষা ও গবেষণা : এস এম ইউসুফ

সমাজকল্যাণ : মফিজুল ইসলাম কামাল

মহিলা : আইভি রহমান

শ্রম : এস এম তালেব আলী

কৃষি : অধ্যাপক মোঃ হানিফ

যুব : মোঃ নাসিম

আন্তর্জাতিক : আবদুল জলিল

সাংস্কৃতিক : শফিকুল আজিজ মুকুল

কোষাধ্যক্ষ : ফজলুল করিম

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ, দেশে প্রত্যাবর্তনসহ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকা থেকে দিল্লী আসেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, ড. কামাল হোসেন, আবদুল মান্নান, আবদুস সামাদ আজাদ, জোহরা তাজউদ্দীন, এম কোরবান আলী, বেগম সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আইভি রহমান প্রমুখ। পূর্ব থেকেই ছিলেন ডাঃ এসএ মালেক। এ সময় দিল্লীতে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ড. কামাল হোসেন এবং সাজেদা চৌধুরীকে রেখে বাকিরা সবাই দেশে ফিরে যান। এদের দু’জনের ওপর দায়িত্ব ছিল শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা। ঠিক হলো ১৭ কিংবা ২৬ মার্চ শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু পরবর্তীতে ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষা এবং কন্যা পুতুলের জলবসন্ত দেখা দেয়ায় শেখ হাসিনার দেশে ফিরে যাওয়া বিলম্বিত হয়।

অবশেষে ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর নির্ধারিত হয় ১৭ মে ১৯৮১ শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে আসবেন। সে এক উত্তেজনাকর আবেগময় ঘটনা। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য দলের পক্ষ থেকে দিল্লী এলেন আবদুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী। ১৬ মে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে দিল্লী থেকে কলকাতা এলেন শেখ হাসিনা, কন্যা পুতুল এবং আবদুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী। ১৭ মে বিকেলে ঢাকায় বিমান থেকে নামেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই প্রথম এলেন। পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা, তিন ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই আর জীবিত নেই। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট খুনীদের উন্মত্ততায় নিহত হলেন তারা সবাই। ৩২ নং সড়কের সেই বাড়িটি এখন এক মৃত্যুপুরী। জেনারেল জিয়ার সরকার বাড়িটিতে তালা মেরে পুরো বাঙালী জাতিকে শৃঙ্খলিত করতে চেয়েছেন। সেদিন আকাশে ছিল মেঘ, ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। প্রকৃতি যেন শোকের চাদর গায়ে মলিন বদনে শেখ হাসিনার জন্য প্রতীক্ষা করছিল। বিমান থেকে নামার পর শুরু হলো অঝোর ধারার বৃষ্টি যেন শেখ হাসিনার অশ্রু জল হয়ে ভরিয়ে দিল বাংলার প্রতিটি প্রান্তর। লাখ লাখ বঙ্গবন্ধুপ্রেমির সেøাগানের মাঝে তিনি খুঁজে ফেরেন স্বজনের মুখ। আবেগজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই’। মুহূর্তের মধ্যে সে ধ্বনি প্রকম্পিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চৌষট্টি হাজার গ্রামের প্রতিটি লোকালয়ে। বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনাস্থল মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ পর্যন্ত পুরো রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। ১০-১৫ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল সে সংবর্ধনায়।

এরপর শেখ হাসিনার শুরু হলো এক নতুন জীবন। দলকে পুনর্গঠন আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী তখনও কারাগারে বন্দী। মিথ্যা মামলা আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনকে ধ্বংস করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তাকে রুখে দিতে হবে। ভয়ভীতি প্রদর্শন আর অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে দল ভাঙা, নেতাকর্মীদের ক্ষমতাসীন দলে ভেড়ানোর চেষ্টা এবং কখনও কখনও দলীয় কার্যক্রম থেকে নিষ্ক্রিয় রাখার ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করতে হবে। সারাদেশে দলকে পুনর্জীবিত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি।

একই সঙ্গে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রামও শুরু করেন। সামরিক শাসন ও স্বৈরশাসনের ফলে যে সমস্ত অবৈধ নির্দেশ ও কালাকানুন জারি করে পরবর্তীতে সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে তা বাতিল এবং পরিবর্তনের দাবি জানান শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সংবিধানের চার মূলনীতি পুনর্¯’াপনের দাবিও উত্থাপন করেন তিনি। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী এবং জেলহত্যাকারীদের বিচার করার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার ও অভিযোগ থেকে মুক্তি, চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তকরণ এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতি করার সুযোগদানের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম শুরু করেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, ঘুষ-দুর্নীতি এবং অবৈধ ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও তিনি দেশবাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।

ঢ.

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের রাজনীতির যে সূত্রপাত হয়েছিল তা ধীরে ধীরে আরও প্রকট হতে থাকে। ক্ষমতার লোভ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আদর্শের লড়াই, বিশ্বাস-অবিশ্বাস সব মিলিয়ে এক অস্থির অবস্থা বিরাজ করে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে। ক্যু ও পাল্টা ক্যু ইত্যাদি ঘটনায় সংঘর্ষ এবং ফাঁসিতে কয়েক হাজার সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। পঁচাত্তরপরবর্তী ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। সেনাবাহিনী প্রধান, উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে তিনি তাঁর অবস্থানকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তীতে বিএনপি গঠন করে তিনি রাজনীতিকে পরিচালিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

এতদসত্ত্বেও জেনারেল জিয়া প্রতিরক্ষা বাহিনীতে তাঁর পুরো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের নানা কারণে হত্যা, মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল যা জেনারেল জিয়া পুরো উপলব্ধি কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি।

এ সময়ে ২৯ মে ১৯৮১ চট্টগ্রাম সফরে এসে সার্কিট হাউসে উঠলেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান। সঙ্গে আছেন বিএনপির মহাসচিব ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ৩০ তারিখ ভোরে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের একদল সৈনিকের হাতে নিহত হলেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে তার আট দেহরক্ষী। এটি শুধু জিয়াকে হত্যা নয়, ক্ষমতা দখল করার একটি পরিকল্পনার অংশ ছিল বলেই পরবর্তীতে প্রতীয়মান হয়। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, একটি ক্যু সংঘটিত করার লক্ষ্যে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্রোহী অফিসাররা চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী কালুরঘাটে ৩০ মে রাতে জড়ো হতে শুরু করে। লে. কর্নেল মতিউর রহমান, মেজর মোজাফফর, ক্যাপ্টেন সৈয়দ ও ক্যাপ্টেন মনির সবার আগে সেখানে পৌঁছান। এর কিছুক্ষণ পরই একটি এক্স জীপ ও দুটি এক্স পিকআপে আসেন ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ হোসেন খান, ক্যাপ্টেন মোঃ আবদুস সাত্তার, ক্যাপ্টেন রফিকুল হোসেন খান, লে. মোসলেউদ্দিন আহমদ এবং সুবেদার সাফদার রহমান। একই সময়ে ষষ্ঠ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল ফজলে হোসেন ক্যাপ্টেন জামিল হককে নিয়ে সেখানে পৌঁছান। সেই গভীর রাতে একে একে অন্যান্য সেনা অফিসাররাও এই কালুরঘাটে এসে জড়ো হন। দুটি এক্স জীপ ও একটি পিকআপে আসেন ১৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার মেজর গিয়াসউদ্দিন, ২৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর কাজী মনিরুল হক এবং ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন। সবশেষে পৌঁছান ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার মেজর এসএম খালেদ, ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর ফজলুল হক এবং ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের স্টাফ ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এ্যাডজুটেন্ট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। বিদ্রোহী দলের সিনিয়র অফিসার লে. কর্নেল মতিউর রহমান তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্রিফিং প্রদান করেন। অতঃপর কালুরঘাট ত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সেনাবহর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের দিকে রওনা হয়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে আনুমানিক রাত ৪টার দিকে লে. কর্নেল মতিউর রহমান একদল সৈন্য নিয়ে গ্রেনেড ছুড়তে ছুড়তে অতর্কিতে সার্কিট হাউসে প্রবেশ করে দ্রুত উপরতলায় চলে যান। প্রথমেই তারা প্রেসিডেন্টের ৮ জন দেহরক্ষীকে হত্যা করে। জেনারেল জিয়া সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে যাবার চেষ্টা করলে কয়েকজন সৈন্য তাকে গুলি করে এবং তিনি বারান্দায় পড়ে যান। সৈন্যদের স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে তাঁর শরীর, মুখমণ্ডল ও মাথা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। আধা ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত কাজ শেষ করে বিদ্রোহীরা সার্কিট হাউস ত্যাগ করে। আনুমানিক সকাল ৮টার দিকে বিদ্রোহীরা ৫টি জীপে সার্কিট হাউসে এসে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া, প্রধান নিরাপত্তা অফিসার লে. কর্নেল এহসান এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশ নিয়ে যায়। রাঙ্গুনিয়ার একটি পাহাড়ের পাদদেশে এ তিনজনকে সমাহিত করা হয়। পার্শ¦বর্তী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তিনজন ছাত্র এ ঘটনা দেখে ফেলে এবং পরবর্তীতে তা জানাজানি হয়ে যায়।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর অপর একটি দল ভোর রাতেই বাংলাদেশ বেতারের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের দখল নিয়ে নেয়। সকাল ১০টা থেকেই এই বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠনের কথা প্রচার করতে থাকে। দুপুরের দিকে চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন জেনারেল মঞ্জুর সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং সাংবাদিকদের উদ্দেশে জেনারেল মঞ্জুর ঢাকায় সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফ প্রধান মেজর জেনারেল নুরুদ্দীনের কাছে চার দফা দাবিনামা পেশ করেন। দাবিগুলো ছিল:

১. দেশব্যাপী সামরিক আইন জারি

২. দেশের প্রধান বিচারপতিকে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ

৩. জাতীয় সংসদ বাতিল এবং

৪. নবগঠিত বিপ্লবী পরিষদকে স্বীকৃতি প্রদান।

জেনারেল নুরুদ্দীন এ সকল দাবি প্রত্যাখ্যান করে অবিলম্বে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ প্রদান করেন। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে বিদ্রোহীরা চট্টগ্রামকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কুমিল্লা এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শুভপুর ব্রিজে একদল সৈন্য প্রেরণ করা হয়। কিন্তু এই সৈন্যদল স্বপক্ষ ত্যাগ করে সরকারী পক্ষ অবলম্বন করলে বিদ্রোহীদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। জেনারেল মঞ্জুর বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছে বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।

৩১ মে রাত তিনটার দিকে জেনারেল মঞ্জুর তার স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে এবং কর্নেল দেলোয়ারের স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়েসহ একটি জীপে করে চট্টগ্রামের পাইদং গ্রামে যান। সেখান থেকে পাহাড়ী ঢাল বেয়ে হেঁটে খৈয়াপাড়া চা বাগানে এক উপজাতীয় কুলির ঘরে আশ্রয় নেন। পরদিন বিকেলবেলা হাটহাজারী থানা সার্কেল ইন্সপেক্টর মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, এএসআইয়ের দুই কর্মকর্তা এবং ফটিকছড়ি থানার ওসি একদল পুলিশসহ সেখানে উপস্থিত হয়ে কুলির ঘর থেকে জেনারেল মঞ্জুরকে গ্রেফতার করে। বিকেল ৫টার দিকে মঞ্জুর এবং অন্যদের হাটহাজারী থানায় নেয়া হয়। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সাইফুদ্দিন আহমদ সদ্য দায়িত্ব গ্রহণকারী অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নির্দেশ মোতাবেক পুলিশকে অবিলম্বে বন্দী মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেডিয়ার আবদুল আজিজের নিকট হস্তান্তর করার আদেশ দেন। অতঃপর পুলিশ হাটহাজারী থানা থেকে ক্যান্টনমেন্টে যাবার পথে ক্যাপ্টেন ইমদাদুল হকের নিকট বন্দীদের হস্তান্তর করেন। ক্যাপ্টেন ইমদাদ জেনারেল মঞ্জুরের হাত-পা বেঁধে চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দেন। একটি জীপে মঞ্জুর এবং দেলোয়ারের পরিবারের সদস্যদের উঠিয়ে নিয়ে মঞ্জুরের বাসার দিকে পাঠানো হয়। আরেকটি জীপে জেনারেল মঞ্জুরকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দফতরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। মঞ্জুরকে বহনকারী জীপটি সেন্ট্রাল ডিপার্টমেন্টাল শপের সামনে পৌঁছামাত্রই ২০/৩০ জন সশস্ত্র সৈন্যের একটি দল জীপটিকে ঘিরে ফেলে এবং টেনেহিঁচড়ে মঞ্জুরকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নামিয়ে ফেলে। কালবিলম্ব না করে গুলি করে মঞ্জুরকে সেখানেই হত্যা করা হয়। বন্দী মঞ্জুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পূর্বেই হত্যা করার পেছনে বড় কোন রহস্য লুকিয়ে আছে কিনা তা আজও জানা যায়নি।

৩০ মে ১৯৮৯ জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর সেদিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশে জরুরী অবস্থা জারি করেন। ৩১ মে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচএম এরশাদ বেতারে প্রদত্ত এক ভাষণে বিচারপতি সাত্তারের অস্থায়ী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ১ জুন রাঙ্গুনিয়া থেকে জিয়াউর রহমানের মরদেহ ঢাকায় আনা হয় এবং ২ জুন জানাজা শেষে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেরেবাংলানগরস্থ চন্দ্রিমা উদ্যানে দাফন করা হয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তার দল বিএনপিই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হন এবং সংবিধান অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন ৪ জুন ১৯৮১। ২২ জুন বিএনপি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকেই প্রার্থী ঘোষণা করে। বিচারপতি আবদুস সাত্তারের প্রার্থী হওয়া নিয়ে আইনী জটিলতা এবং তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সরকার ৮ জুলাই সংবিধানে ষষ্ঠ সংশোধনী এনে বিচারপতি সাত্তারের প্রার্থিতা নিয়ে আইনী সঙ্কট দূর করেন।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত