শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে বঙ্গবন্ধু

8111

Published on আগস্ট 12, 2018
  • Details Image

বাহালুল মজনুন চুন্নূঃ

শত শত বছরের শোষণ-বঞ্চনার অধীনে থেকে, বাঙালি যখন নিজস্ব পরিম-ল থেকে ক্রমে পেছনে সরে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় পেছনের সব মহাপুরুষের কীর্তিগাথাকে মøান করে দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ঘুমিয়ে পড়া বাঙালিকে পুনরায় জাগালেন, একত্রিত করলেন। করলেন নবধারায় উজ্জীবিত। শোষণ-বঞ্চনার ঘেরাটোপ থেকে বাঙালি নতুন সূর্যের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল তারই নেতৃত্বে। তিনি আত্মবিশ্বাসহীন এবং শোষিত-বঞ্চিত জনগণের মাঝে জাগিয়েছিলেন আশা। নীরব দুর্দশামাখা কণ্ঠগুলোকে, নির্বাক কণ্ঠগুলোর মাঝে করেছিলেন জাগরণের ভাষাসঞ্চার। যে হতাশা গোটা জাতির ওপর ভর করেছিল, সেই হতাশা কাটাতে তিনি নিজে প্রস্তুতি নিয়েছেন, সহ্য করেছেন নানা ঘাত-প্রতিঘাত এবং ক্রমে এগিয়ে গেছেন শোষণ-বৈষম্যহীন কাম্য এক সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে। তিনি তার কাজের মধ্য দিয়েই কেবল একজন ব্যক্তির পরিবর্তে পরিণত হয়েছেন একটি প্রতিষ্ঠানে, একটি বিপ্লবে, জাতি নির্মাণের কারিগরে। এসব কিছুর মূলেই ছিল মানুষের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা, এই ভালোবাসা কেবল বাঙালিদের জন্যই নয়, গোটা মানবজাতির জন্যই ছিল উৎসারিত। তিনি দেখেছিলেন, হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন বিশ্বজুড়েই বিদ্যমান শোষণ, নির্যাতিন-নিপীড়ন, বৈষম্য। অল্পকিছু মানুষের হাতে জিম্মি অধিকাংশ মানুষ। একদিকে চলে অপরিমেয় ভোগবিলাস আর অন্যদিকে কেবলই হাহাকার। মানবতাবাদী বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা এই অন্যায়-অবিচার, বৈষম্য, শোষণ মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না, নিলেনও না তা। নিজ জীবনের পরোয়া না করে আমৃত্যু চালিয়ে গেছন শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। অন্নদাশংকর রায় তাই বলেছেন, বিশ্বমানবতা ও স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী মহান নেতা আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের একই নাম। তাত্ত্বিক দিক বিবেচনায় আমরা দেখি, সেইন্ট সাইমন, চার্লস ফুঁরিয়ে, ওয়েন প্রমুখ যেখানে সামাজিক অসাম্য, শোষণকে দূর করতে চেয়েছিলেন সমাজ সংস্কারের মাধ্যেমে, সেখানে কার্ল মার্কস, প্রুধুন, বুকিনিন, ব্লাঙ্কুই প্রমুখদের কেউ কেউ নৈরাজ্যবাদী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যেমে, আবার কেউ কেউ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যেমে তা করতে চেয়েছেন। তাদের মতাদর্শ অনুসরণ করে দেশে দেশে সংঘটিত হয়েছে নানা বিপ্লব, নানা লড়াই-সংগ্রাম। কার্ল মার্কস, লেনিন, মাও সে তুং, ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা প্রমুখ ব্যক্তিরা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তপাতের অনিবার্যতাকে বেছে নিয়েছিলেন। তাদের কাছে বিপ্লব ও রক্তপাত ছিল যেন একই সূত্রে গাঁথা। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি হেঁটেছেন রক্তপাতহীন বিপ্লবের পথে।

বঙ্গবন্ধু কোনো রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ছিলেন না, তিনি শিখেছিলেন জীবন থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে, রাজপথের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই শোষণ-বঞ্চনা-লাঞ্ছনা-বৈষ্যম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে বঙ্গবন্ধু এই দেশের মানুষকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন, বাঙালিকে বিশ্বের বুকে অধিষ্ঠিত করিয়েছিলেন গর্বিত জাতি হিসেবে। ঔপনিবেশিক শোষণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি শুরু করেন দেশের অভ্যন্তরে শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই। তবে এ লড়াই সহজ ছিল না। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক নানা জটিলতায় এই লড়াই বারবার হয়েছে বাধাগ্রস্ত। তবে তিনি থেমে যাননি, থমকে যাননি, বীরদর্পে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন শোষণমুক্ত আলোকিত এক সমাজ গঠনের প্রত্যেয়ে। স্বাধীনতার পর এই দেশে সংকট ও অভাবের শেষ ছিল না। মানুষের বুকে ছিল অজস্র মৃত প্রিয়জনের জন্য শোক, অসংখ্য লাঞ্ছিত নারীর জন্য যন্ত্রণা, দেশ ভরা ছিল বিলাপ ও আর্তনাদে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশ দাঁড়িয়ে ছিল ধ্বংসস্তূপের মাঝে। ভেঙে পড়েছিল সম্পূর্ণ অর্থনীতি। রাষ্ট্রীয় কোষাগার ছিল শূন্য। প্রায় কোটি মানুষ গৃহহীন, আশ্রয়হীন হয়েছিল ভারতের শরণার্থী শিবিরে। লাখ লাখ মানুষের নেই খাবার, নেই পোশাক। দারিদ্র্যপীড়িত সাব-সাহারার কয়েকটি দেশের সঙ্গে উচ্চারিত হতে লাগল বাংলাদেশের নাম। ছিল না অর্থ, অবকাঠামো, দক্ষ জনশক্তি, শিল্প-কারখানা, রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও বিদেশি মুদ্রার মজুদ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে টিকে থাকার এক তীব্র লড়াই করতে হয়েছে। অনেকেরই হাতেই ছিল বেআইনি অস্ত্র। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘটেছিল চরম অবনতি। অনেকেরই যেন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল দেশকে গড়া নয়, দেশকে নিঃশেষ ভোগ করা। এ রকম দুর্দশাগ্রস্ত বিশাল জনপদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য দেশ পরিচালনার ভার নিলেন বঙ্গবন্ধু। তাকে মাড়াতে হলো কঠিন পথ। দেশের অভ্যন্তরীণ খ্যাদ্যাভাব, বিশ্বব্যাপী খ্যাদ্যাভাব, পেট্রলের মূল্যবৃদ্ধি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি কারণে দেশজুড়ে নেমে এসেছিল তীব্র অন্ধকার। তৈরি হয়ে গিয়েছিল বিপদসংকুল পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধু এসব পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য গ্রহণ করেছিলেন নানা যুগোপযোগী পদক্ষেপ। কিন্তু তার পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের আগে তাকে কোনো সময় না দিয়েই যৌক্তিক সমালোচনার পরিবর্তে জাসদসহ কিছু রাজনৈতিক দল কেবল কুৎসা রটনাই নয়, নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে দেশকে পেছনের দিকে টেনে ধরছিল। মননে পাকিস্তান ভাবাপন্ন কিছু কিছু কুচক্রী গোষ্ঠীও মেতেছিল নোংরা ষড়যন্ত্রে। তা ছাড়া পাকিস্তানসহ বিদেশি ষড়যন্ত্র তো ছিলই। আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়েও কিছু নেতাকর্মী মেতে উঠেছিল দুর্নীতির মহোৎসবে, সরকারি আমলারও তাতে ভাসিয়েছিল গা। পাকিস্তান আমলের মতোই গরিবরা হচ্ছিল শোষিত। সবর্ত্রই বিশৃঙ্খলা, সর্বত্রই অরাজকতা। মহান হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধু এসব সহ্য করতে পারলেন না। তাই দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, পটভূমিতে তিনি এমন এক শাসনব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন, যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবে না শোষণ-নির্যাতন। তিনি মনে করতেন এ দেশে সমাজতন্ত্রের উত্তরণ ঘটবে গণতন্ত্রের মাধ্যমে। এর জন্য প্রয়োজন দেশের সর্বস্তরের লোকের অংশগ্রহণ। শেখ মুজিবুর রহমান যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতেন, তা সশস্ত্র শ্রেণি-সংগ্রামের সমাজতন্ত্র নয়, তিনি চেয়েছিলেন বিনা রক্তপাতের শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার বিপ্লব। বিপ্লব বলতেই মনের পর্দায় ভেসে আসে রক্তপাত। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ মানুষের রক্তপাত ঘটেছে। তারপর এক নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় বিপ্লব ও রক্তপাত একই সূত্রে গাঁথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুই ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী এক বিপ্লবী, যিনি রক্তপাতহীন বিপ্লবের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে গেছেন।

বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন প্রচলিত ব্যবস্থায় দেশকে দ্রুত কাক্সিক্ষত উন্নতির পথে এগিয়ে নেওয়া এবং দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো দুরূহ। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। সমাজের কল্যাণকামী, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে এক প্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় পুনর্গঠনের মহাকর্মযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন। সর্বস্তরের জনসাধারণ, বেসামরিক প্রশাসন, সামরিক বাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। সবাই যেন জাতি গঠনের কাজে অভিন্ন রাজনৈতিক প্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং সবার মেধা-শ্রম যেন জাতীয় উন্নয়নে কাজে লাগে, সে জন্যই এই নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এই বিপ্লব নব্যপ্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের বিপ্লব, বিশেষ করে অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লব। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেই বিপ্লব ছিল এক অনন্য পদক্ষেপ। তিনি যে শাসনতন্ত্র চালু করেছিলেন, তা ছিল ক্ষমতালোভী চক্রের ক্ষমতা হ্রাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু সাম্য ও স্বাধীনতার আলোকে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি পাঁচসনা ভূমিব্যবস্থার পরিকল্পনা করেন। গ্রামে গ্রামে কো-অপারেটিভ সিস্টেম চালুর মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে চেয়েছেন। দুর্নীতির হাত থেকে দেশ বাঁচানো, উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে তিনি এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। এ জন্য তিনি বলেছিলেন, আসুন নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আমরা এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি তথা কৃষক, শ্রমিক মেহনতি জনতার ভাত, কাপড়, কাজ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের মধ্য দিয়ে এক সুখী সমৃদ্ধশালী আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলি।’ কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবেÑ ‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।’ বঙ্গবন্ধু সেই অসাধ্য সাধনই করতে চেয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু গড়তে চেয়েছিলেন বৈষম্যহীন-শোষণমুক্ত বাংলাদেশ। চেয়েছিলেন এমন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে, যে বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যে বাংলাদেশে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি হবে চিরস্থায়ী, যে বাংলাদেশ হবে চিরতরে ক্ষুধামুক্ত-শোষণমুক্ত, যে বাংলাদেশে মানবমুক্তি নিশ্চিত হবে, যে বাংলাদেশে নিশ্চিত হবে মানুষের সুযোগের সমতা, যে বাংলাদেশ হবে বঞ্চনামুক্ত-শোষণমুক্ত-বৈষম্যমুক্ত-সমতাভিত্তিক-অসাম্প্রদায়িক দেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করে যেতে পারলেন না বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের কালরাতে বত্রিশ নম্বরের বাড়ির প্রতিটি ঘরে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলার পথচ্যুত ঘৃণ্য কয়েক সন্তান। তারা বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে মেরে ফেললেও তিনি রয়ে যাবেন আজীবন বাঙালির হৃদমাঝারে। তাই তো শামসুর রাহমান তার ইলেকট্রার গান কবিতায় বলেন, ‘যতদিন আমি এই পৃথিবীতে প্রত্যেহ ভোরে/ মেলবো দু’চোখে, দেখব নিয়ত রৌদ্র-ছায়ার খেলা,/ যতদিন পাব বাতাসের চুমো দেখব তরুণ/ হরিণের লাফ, ততদিন আমি লালন করব শোক।’

লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত