11578
Published on জুন 23, 2018একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ বর্ণনা করে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পথে মানুষের রায়কে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে তাই দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে ও ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন বলেছেন তিনি।
গণভবনে শনিবার আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা।
সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ ও জাতীয় কমিটির সদস্য, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, দেশের বিভিন্ন মহানগরের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সারা দেশের জেলা ও উপজেলা, পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন।
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। এরপর বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
সংবিধান অনুযায়ী, দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হতে হবে। সেই হিসাবে, আগামী নির্বাচন হতে হবে ৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে। সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
গণভবনের বর্ধিত সভায় শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও জয়ী হওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “আগামী নির্বাচন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে, যেনে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে পারে।”
নির্বাচনে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি পরিহার করার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা বদনাম নিতে চাই না, জনগণের মন জয় করেই কিন্তু ক্ষমতায় আসতে হবে।”
নেতাকর্মীদের দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “আওয়ামী লীগের দায়িত্ব অনেক বেশি। যাকে আমরা নৌকা মার্কা দেবে, যাকে আমরা নির্বাচনে প্রার্থী করবে তার পক্ষে সকলকে কাজ করতে হবে। আপনাদের এখন থেকে জনগণের কাছে যেতে হবে; নৌকা মার্কায় ভোট চাওয়ার জন্য। কে প্রার্থী, কে প্রার্থী না সেটা বড় কথা না। নৌকা মার্কায় ভোট চাওয়ার জন্য জনগণের কাছে যেতে হবে।
“সামনে নির্বাচন। এই কথাটা সব সময় মনে রাখতে হবে; নির্বাচন মানেই এটা চ্যালেঞ্জিং হবে। এটা কিন্তু আমাদের একটানা তৃতীয়বার…এই তৃতীয়বারের নির্বাচনে সকলকে কিন্তু এক হয়ে কাজ করতে হবে।”
সরকারের করা উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা তৃণমূলের উদ্দেশ্য বলেন, “এত কাজ আমরা করেছি, যে উন্নয়ন আমরা করেছি, এত উন্নয়ন করার ফলে মানুষ যে নৌকায় ভোট দেবে না, তা কিন্তু নয়। যদি না দেয়; তার জন্য দায়ী থাকবেন আপনারা তৃণমূল; এটাই আমার কথা। আপনারা সঠিকভাবে মানুষের কাছে যেতে পারেননি, বলতে পারেননি, বুঝাতে পারেননি, সেবা করতে পারেননি; সেইজন্যই.. নইলে এখানে হারার তো কোনো কথা না।”
বর্ধিত সভায় সভাপিতর বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, “এত উন্নয়ন কবে হয়েছে, কোন সরকার করতে পেরেছ? তবে কেন অন্য দল ভোট পাবে? যারা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত; সেই দল কেন ভোট পাবে, এই প্রশ্নের উত্তর আমি পাই না।”
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে শনিবার সকালে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিআইডি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে শনিবার সকালে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিআইডি বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসলে দেশকে ধ্বংস করে দেবে বলে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “দলের মধ্যে ঐক্য রাখতে হবে, ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।”
আগামী নির্বাচনেও মহাজোট থাকার ঈঙ্গিত দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা মহাজোট করেছি, নির্বাচনের স্বার্থে করেছি…আগামীতেও করব, আমরা বন্ধু হারাব না।”
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা প্রার্থী হওয়ার জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছেন তাদের সচেতন করে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করছি; অনেক স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রার্থী হয়ে গেছেন। তারা প্রার্থী হয়ে, বিএনপি কী সন্ত্রাস করল, দুর্নীতি করল, লুটপাট করল; সেটা বলে না। তার বক্তব্য এসে যায়, আমার আওয়ামী লীগের এমপির বিরুদ্ধে, সংগঠনের বিরুদ্ধে।
“আমি এখানে একটা ঘোষণা দিতে চাই; কেউ যদি আমার দলের.. প্রার্থী হওয়ার অধিকার সকলেরই আছে। কিন্তু, সে প্রার্থী হতে যেয়ে আমার দলকে বদনামে ফেলবে; কোনো মতেই এটা আমি মেনে নেব না। এটা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। যে উন্নয়নের কাজগুলো করছি সেগুলো না বলে, সেগুলো ভুলিয়ে দিয়ে.. কার বিরুদ্ধে কী দোষ আছে; সেইটা খুঁজে জনগণের কাছে যারা বলবেন, তারা কখনো আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাবেন না, পরিষ্কার কথা। তারা কখনো আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাবেন না।”
নিজের কর্মব্যস্ত জীবনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আপনারা বলেন, আমার কী আছে? কোনো বিয়ে-শাদিতে যাই না, কোনো উত্সবে যাই না। আমি সারা দিনরাত দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
দলীয় প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জাতির জন্ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান।ছবি: পিআইডি দলীয় প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জাতির জন্ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান।ছবি: পিআইডি “আমি রেকর্ড করছি.. আজ ডিজটাল বাংলাদেশ। যে যখন বক্তৃতা দেন মোবাইল ধরলেই কিন্তু আমি শুনি। ম্যাসেজ আমি পড়ি। কোনো ম্যাসেজ বাদ যায় না। এখনো আমার মোবাইল ফোনে মনে হয় দিনে চারশ-পাঁচশ ম্যাসেজ আসে। আমি যখনই সময় পাই বসে বসে পড়ি আর সমস্যা সমাধানের চেষ্টা আমি করি।”
একই প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা আরও বলেন, “আমি এটাই বলব, যারা আমার দলের বিরুদ্ধ কথা বলবে, দলের বদনাম করবে; সে কী এটা বোঝে না যে, তার ভোটও নষ্ট হবে। সে তাহলে কোন মুখে ভোট চাইতে যাবে। পাঁচ বছর দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সে যদি দলের বদনাম করে, জনগণ তো তাকেও ভোট দেবে না।”
বর্তমান সংসদ সদস্যদেরও তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সাবধান করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের যারা সংসদ সদস্য, তাদেরকে আমি বলব, একটা কথা মনে রাখবেন জনগণ কিন্তু খুব হিসাবী। কে দুর্নীতি করল, জনগণ কিন্তু সেটা মাথায় রাখে। কাজ করতে গেলে টাকা নিলে, এরপর ভোট চাইতে গেলে বলবে, ‘টাকা দিয়ে কাজ নিসি, ভোট দেব কেন?’ ”
নাগরিকদের বোকা না ভাবার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “জনগণের এখন কিন্তু চক্ষু খুলে গেছে। এখন ডিজিটাল যুগ। তারা এখন বিশ্বকে জানতে পারে। যারা সংসদ সদস্য…হাতে এখন খুব বেশি সময় নাই।”
তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের ওপরও আগামীতে মনোনয়ন নির্ভর করবে বলেও স্মরণ করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।
“আপনারা নমিনেশন পাবেন কী, পাবেন না; তা নির্ভর করে আপনার এলাকায় আপনারা কতটুকু জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছেন আর কতটুকু তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের নেতাকর্মীদের কতটুকু মূল্যায়ন করেছেন; সেটাও কিন্তু আমি বিবেচনা করে দেখব।”
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি ছোট বেলা থেকেই তো দেখেছি; আমার বাবা জেলের বাইরে থাকলে কী চেহারা আর ভেতরে থাকলে কী চেহারা। দুঃসময়ে আমার যারা নেতাকর্মী, দুঃসময়ে দলের হাল যারা ধরে রাখে, ওই দুঃসময়ের কর্মীরা তারা যেন অবহেলিত না হয়।”
নিজের পক্ষে জনসমর্থন বৃদ্ধিতে অন্য দলের নেতাকর্মীদের না ভেড়ানোর নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “এখন তো অনেকেই আসবে। আমি আরেকটা সার্ভে করে বের করছি; যেহেতু আমরা ক্ষমতায় বিভিন্ন দল থেকে অনেকেই ছুটে আসে, দলে আসতে। আর, গ্রুপ করার জন্য কোনো বাছ-বিচার নাই, যাকে পাচ্ছে তাকে নিয়ে নিজের শক্তি দেখাতে চায়।
“এরা আসে মধু খেতে, এরা আপনার সাথে থাকতে আসে না। এরা আপনার সাথে থাকতে আসে নাই, আপনার জন্য কাজ করতে আসে নাই। আর যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে; ভাবে যে এখানে আসলে মামলা থেকে বাঁচতে পারবে। আর, আসে কারা? যারা মনে করে ক্ষমতার সাথে থাকতে পারলেই তো পয়সা বানাতে পারব।”
মামলা থেকে রেহাই পেতেও অনেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
“একটা সার্ভে আমরা পুরো বাংলাদেশে করেছি; কাদের কাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে আর কারা আমার দলে আছে। সেই তালিকা কিন্তু আমার কাছে আছে। আমি বলব, কেউ যদি তাদের প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন, তাদের এখনই বিদায় করেন। কারণ তারা দুঃসময়ে থাকবে না। অনেকই আসবে আপনাদের মধ্যে কোন্দল করে খুন করবে.. নাম হবে দল দলকে খুন করেছে; এই দূরভীসন্ধি নিয়েও কিন্তু অনেকে আসে।
“এটা মনে করবেন; আপনার দলের লোক আপন না, বাইরের লোক আপন হয়ে গেছে, সে কিন্তু আপন হবে না। নিজের যারা তাদের চিনতে হবে। আওয়ামী লীগ সম্পদ গড়ার জন্য না, আওয়ামী লীগ জনগণের ভাগ্য গড়ার জন্য।”
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা আরো বলেন, “আমরা যে কাজ করেছি; তা তো বলতে হবে। ভোটের রাজনীতি করলে তো মানুষকে বলতে হবে, আপনার জন্য এই কাজ আমি করেছি, এই কাজ অব্যাহত রাখতে হবে।”
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “ওরা ক্ষমতায় আসা মানেই জনগণের জন্য দুর্ভোগ; এই কথাগুলো জনগণের কাছে বলতে হবে।”
মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে বলেও জানান তিনি।
“আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি; এই বাংলাদেশে কোনো জঙ্গিবাদের স্থান হবে না, সাথে সাথে এই মাদকেরও কোনো স্থান হবে না। এই মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
শেখ হাসিনা তার বক্তব্যের শুরুতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল হামিদ খান ভাসানী, প্রথম সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় চার নেতা, গণতান্ত্রিক সংগ্রামে যারা জীবন দিয়েছেন এবং জাতির জনককে শ্রদ্ধা জানান।
সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এর আগে সূর্যোদয়ের ক্ষণে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও সারা দেশের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর কর্মসূচি শুরু হয়।
শেখ হাসিনা সকালে ৯টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।