5946
Published on মে 29, 2020অজয় দাশগুপ্তঃ
৫৪ বছর আগে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সে সময়ের অপেক্ষাকৃত ছোট পরিসরের ঢাকা ছিল অগ্নিগর্ভ। লোকসংখ্যা লাখ দশেক। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চার মাস দুই দিন আগে ৫ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী লাহোরে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সম্মেলনে বাঙালির প্রতি বঞ্চনার প্রতিকারের জন্য স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেছিলেন। সেখানে উপস্থিত নেতাদের সমর্থন মেলেনি এ দাবির প্রতি। বরং পাকিস্তান ভাঙার অভিলাষ পোষণের জন্য জুটেছিল ধিক্কার।
এই লাহোর নগরীতেই ১৯৬৬ সালের ২৬ বছর আগে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ আরেক বাঙালি নেতা একে ফজলুল হক (যিনি শেরেবাংলা নামে অভিহিত) পেশ করেছিলেন ভারত ভেঙে পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব। সাত বছরের কিছু বেশি সময় পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বাঙালিরা দ্রুতই বুঝতে পারে- বঞ্চনার নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। তাদের ক্ষোভ-রোষ প্রথম বড় আকারে প্রকাশ পায় ভাষা-সংস্কৃতির ইস্যুতে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর ১৪ বছর পর ফেব্রুয়ারি মাসেই শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচিতে সামনে নিয়ে আসেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইস্যু। এ ভূখণ্ডের জনগণ বুঝে যায়- পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনতা আর নয়; স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তি নেই। সেই স্বাধীনতা এলো ছয় দফা পেশের পাঁচ বছরের মধ্যেই; ১৯৭১ সালে। এ জন্য ৩০ লাখ মানুষের রক্ত ঝরেছে, অগণিত নারীর সল্ফ্ভ্রম গেছে। কোটি কোটি মানুষ আত্মত্যাগ করেছে।
ছয় দফা উত্থাপনের পরপরই শেখ মুজিবুর রহমান গোটা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ জেলা-মহকুমাগুলোতে জনসভা করতে থাকেন। প্রচুর লোকসমাগম হয় প্রতিটি সমাবেশে। অথচ দলের প্রবীণ নেতাদের অনেকে (যেমন, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, সহসভাপতি আবদুস সালাম খান) ছয় দফার বিরোধিতা শুরু করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে কেবল দলের তরুণ নেতারা। আর রয়েছে ছাত্রলীগ। তিনি মার্চ মাসে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন ৪৬ বছর বয়সে; সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের বয়স ৪১ বছর। মাস তিনেকের মধ্যে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর স্থান হয় কারাগারে। বামপন্থি দল ন্যাপ ও নিষিদ্ধ মণি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টি এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ছিল ছয় দফার প্রতি নমনীয়। তাদেরও অনেক নেতা গ্রেফতার হয়ে যান। এ অবস্থাতেই ডাকা হয় ৭ জুনের হরতাল। সেদিন দলের কর্মী-সমর্থকরা পিকেটিং করেছিল। তবে মূল শক্তি হয়ে উঠেছিল আদমজী-তেজগাঁওয়ের শ্রমিক এবং দরিদ্র-নিম্নবিত্ত মানুষ। সর্বাত্মক হরতাল বলতে যা বোঝায়, সেটাই দেখেছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী।
সাধারণ মানুষের এমন মনোভাবের প্রভাব পড়েছিল সরকারি অফিসার-কেরানিদের মধ্যে। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব হিসেবে কাজ করেছেন, এমন এক ব্যক্তি ২০০০ সালে আমাকে বলেছিলেন সেদিনের ঘটনা এভাবে- পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান নির্দেশ দেন- পরদিন পত্রিকায় সরকারি প্রেসনোট ছাড়া কিছু ছাপা যাবে না। আমরা যারা প্রেসনোট লেখার দায়িত্বে ছিলাম, তারা আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিই- এমনভাবে এটা লেখা হবে যাতে সহজেই বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা অগ্নিগর্ভ ছিল। আমাদের লেখা প্রেসনোট অনুসারেই ইত্তেফাক ৮ জুনের লিড নিউজের শিরোনাম দেয়- 'ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে পুলিসের গুলীতে ১০ জন নিহত'।
দৈনিক 'সংবাদ' তখন বামপন্থিদের সমর্থক। আহমদুল কবিরের মালিকানাধীন (জহুর হোসেন চৌধুরী ছিলেন সম্পাদক) এ পত্রিকা ৭ জুন গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ৮ জুন পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ রাখে। ৯ জুন বন্ধ রাখার কারণ হিসেবে প্রথম পাতায় বক্স নিউজ করে এভাবে- আমাদের নীরব প্রতিবাদ :যে মর্মান্তিক বেদনাকে ভাষা দেওয়া যায় না, সেখানে নীরবতাই একমাত্র ভাষা। তাই গতকাল 'সংবাদ' প্রকাশিত হইতে পারে নাই। আমাদের এই নীরব প্রতিবাদ একক হইলেও ইহাতে আমাদের পাঠকরাও শরীক হইলেন, ইহা আমরা ধরিয়া লইতেছি।
৭ জুনের হরতাল কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়। কয়েক দিনের মধ্যে ছয় দফার সমর্থক দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তের দায়ে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' দায়ের করা হয়। যদিও তিনি মনে করতেন, মুষ্টিমেয় সামরিক অফিসার ও সৈনিকরা কয়েকটি ক্যান্টনমেন্ট দখলে নিলেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে না। এ জন্য চাই জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস। এ লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অবিচল এবং তারই পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
স্বাধীনতার পর ৪৯ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ১৯৭১ সালের কয়েক বছর পরও যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যাংকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে করতেন- স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের টিকে থাকা কঠিন। কারণ এ দেশের খনিজ সম্পদ নেই। খাদ্যে ঘাটতি প্রকট। শিল্প-কারখানা হাতেগোনা কয়েকটা। বেশিরভাগ লোক নিরক্ষর। নারীদের প্রায় সবাই অবরোধবাসিনী। যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নির্ভর করতে হয় বিদেশি ঋণ-অনুদানের ওপর। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য। এমন দেশটিকে পরিহাস করে বলা হতে থাকে 'বাস্কেট কেস' বা ভিখারির দেশ। আমাদের দেশের কিছু লোক অবশ্য বাস্কেট কেস-এর তর্জমা করেছিল 'তলাবিহীন ঝুড়ি' হিসেবে, যার ইংরেজি করা হয় 'বটমলেস বাস্কেট'।
স্বাধীনতার সময়ের বাংলাদেশের সঙ্গে এখনকার বাংলাদেশের কতই না পার্থক্য! বছর দশেক আগে এ দেশেরই অর্থনীতির পণ্ডিতদের কেউ কেউ বলতেন, বাংলাদেশ ৭-৮ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে- এমন প্রত্যাশা না করাই ভালো। বাস্তবে এটা সম্ভব নয়। এখন তারা এটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন- কেন বাংলাদেশ উন্নতি করছে? পাজল বা ধাঁধাটি কী? তারা খুঁজে বের করছেন কয়েকটি উত্তর- যেমন তৈরি পোশাক শিল্প, প্রবাসে কোটিখানেক বাঙালির কর্মসংস্থান এবং তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি প্রভৃতি। তবে সন্দেহ-বাতিকদের নিয়ে বড় বিপদ। তাদের অনেকেই নিজেকে ফেলে রাখতে চান সেই দলে, যারা গরিবের ছেলে স্কুলে ফার্স্ট হলেও বলে- চাকরি তো পাবে না। আর চাকরি পেলে বলে- দেখ, বেতন পায় কি-না! এমন 'বিশেষজ্ঞরা' হাল আমলে ব্যস্ত নতুন তত্ত্ব নিয়ে- উন্নয়ন হলেই চলবে না; সেটা টেকসই হওয়া চাই।
উন্নয়ন যে টেকসই হওয়া চাই, সেটা নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, যে বাঙালি স্বাধীন দেশ প্রত্যাশা করেছে এবং সেটা অর্জনও করেছে, তারা কেন উন্নয়নের ধারাকে টেকসই করতে পারবে না? শ্রমজীবী মানুষই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ পথে অবশ্যই বাধাবিঘ্ন আছে এবং সেটা অবশ্যই জয় করতে হবে। বিঘ্ন কারা সৃষ্টি করে? পাকিস্তান আমলে ছয় দফা কর্মসূচি প্রদানের পর একটি প্রশ্ন জোরালোভাবে সামনে এসেছিল এভাবে- এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে সেটা বাঙালি ধনীদের যতটা তুষ্ট করবে, শ্রমিক-কৃষক-দিনমজুরদের ততটা করবে না। ১৯৬৯ সালের ছাত্র-জনতার ১১ দফা আন্দোলনে কল-কারখানা জাতীয়করণসহ কৃষক-শ্রমিকের কিছু দাবি যুক্ত করে এ বিষয়টির প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতির পরও কিন্তু সেই প্রশ্নটি উঠছে- মুষ্টিমেয় ধনবান লোক বাংলাদেশ থেকে যে সুবিধা পাচ্ছে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক-কৃষক-দিনমজুর সে তুলনায় কেন বঞ্চিত? অর্থমন্ত্রী টানা ১০ বছর বাজেট দিচ্ছেন। বাজেটের আকার এখন অনেক বড়- সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। কিন্তু এটাও বলা হচ্ছে, ধনবানরা যে পরিমাণ কর ফাঁকি দেয়; ব্যাংক ও শেয়ারবাজার ব্যবহার করে যে পরিমাণ লুটপাট চালায়, সেটা সামান্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই তো বাজেটের আকার বর্তমানের অন্তত দ্বিগুণ করা সম্ভব। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে হতাশা, বিশেষভাবে ধনবান ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা যে কোনোভাবে উন্নত দেশে চলে যাওয়ার জন্য যে তাড়নায় থাকে তার অবসানের বিষয়টিও আমাদের গভীর ভাবনায় থাকা চাই। দেশ এগিয়ে চলেছে; কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের যারা চালিকাশক্তি হবে, তারা কেন ভরসা করতে পারছে না?
রাজনৈতিক অঙ্গনে ধনবানদের আধিপত্য নিয়েও প্রশ্ন কম নেই। সংসদ নির্বাচনে জয়ী হতে হলে অঢেল সম্পদ চাই। কেবল সংসদে নয়; সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদেও ধনবানদের মনোনয়ন দিতে ব্যগ্র প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। কাউন্সিলর-মেম্বার পদেও চাই ধনী প্রার্থী। রাজনীতির মাঠে ১০-২০ বছর সক্রিয় কোনো স্কুল বা কলেজ শিক্ষক কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জন্য কোনো পর্যায়েই জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসা অলীক কল্পনা বৈ কিছু নয়। অচিরেই পরিবর্তন ঘটবে পরিস্থিতির- সেটা সুখ-স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। সংসদ সদস্য পদে বড় দল দুটি এমন প্রার্থীও খোঁজে, যারা দলের আরও কিছু নেতাকে জয়ী হওয়ার মতো অর্থের জোগান দেবে। 'মনোনয়ন বাণিজ্য' শব্দযুগল এ ক্ষেত্রেই জুতসই। অঢেল অর্থ ঢেলে যারা জয়ী হবেন, তারা দ্রুতই মনোযোগী হবেন বিনিয়োগ তুলে নিতে। এটাই স্বাভাবিক।
ধনবানরা, উদ্যোক্তা শিল্প-বাণিজ্যের অগ্রপুরুষরা অর্থনীতির রূপান্তরে বড় অবদান রাখছেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া কাম্য হতে পারে না। একই গোষ্ঠীর হাতে পোশাক শিল্প, আমদানি বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, গণমাধ্যম, রিয়েল এস্টেট- সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকার পরিণতি ভালো হয় না। এই গোষ্ঠীর কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে আপামর জনগণের ত্যাগ-তিতিক্ষার খুব একটা মূল্য নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, ধর্ষিত নারীর কথা নিছকই সভা-সমাবেশের সময়ে উচ্চারিত কিছু শব্দ। জাতীয় বাজেট পেশের আগে মাসের পর মাস যে আলোচনা চলে, তখন ধনবানরা তাদের স্বার্থ-সুবিধার কথা যতটা বলে; সে তুলনায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা কিছুই উচ্চারিত হয় না। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং তার পূর্বসূরিরা সবার স্বার্থ সমন্বয়ের কথা বলেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, তারা প্রত্যেকেই সেই হোটেলের মালিকের মতো কৌশল অনুসরণ করছেন- এক হোটেলের মেন্যুতে ছিল ঘোড়া ও খরগোশের মিক্সচার। এক ক্রেতা খেতে গিয়ে কেবল ঘোড়ার মাংসই পাচ্ছে; অতি স্বাদের খরগোশের টুকরো মিলছে না। ম্যানেজারকে ডেকে জানতে চাইলেন তিনি- কেমন মিক্সচার দিয়েছেন? উত্তর মিলল- এক অনুপাত এক; একটি ঘোড়া ও একটি খরগোশ। অর্থমন্ত্রী তার দশম বাজেট পেশ করতে গিয়ে এমন গৎ থেকে বের হতে পারবেন কি?
সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল