6042
Published on জুন 3, 2018ড. মুহম্মদ মনিরুল হকঃ
২০১৮ সালের ১২ মে থেকে মহাকাশে শুরু হয়েছে ৩০ লাখ শহীদের লাল-সবুজ পতাকার স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও গর্বোজ্জ্বল পথচলা। বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে নতুন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রিয় বাংলাদেশের যুগান্তকারী সাফল্যের নিদর্শন ‘বঙ্গবন্ধু-১’ স্যাটেলাইট। দেশের অর্থে নির্মিতব্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুও আমাদের আরেকটি সাফল্যের নিদর্শন, যা দেশের মানুষকে নতুন করে উজ্জীবিত করছে এবং বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার চিত্র মেলে ধরেছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতীয় সংসদের ভাষণে (১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘...এখানে কে হিন্দু, কে মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এটা কোনো কথা নয়। আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছি এবং মানবিকভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছি।’ ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭২তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার হৃদয় আজ দুঃখে ভারাক্রান্ত। কেননা আমার চোখে বারবার ভেসে উঠছে ক্ষুধার্ত, ভীতসন্ত্রস্ত ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ছবি। ...আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই, অর্থনৈতিক উন্নতি চাই, মানবধ্বংস নয়, মানবকল্যাণ চাই।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন মানবিক মূল্যবোধ দেশের মানুষকে নতুন দীক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছে। এর আগেও বহু আন্তর্জাতিক ফোরামে মানবিক বাংলাদেশের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর প্রদত্ত ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ এবং ‘শান্তির সংস্কৃতি’ প্রস্তাব জাতিসংঘের অধিবেশনে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থনে পাস হয়েছিল ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর।
বর্তমানে মানবিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের চিত্র এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ভাবনী নেতৃত্ব-দর্শন অধিক পরিমাণে বর্ণিত হচ্ছে বিশ্বনেতৃত্ব ও গণমাধ্যমের কাছে। ব্রিটিশ মিডিয়া ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ নামে আখ্যায়িত করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমি মুগ্ধ, শেখ হাসিনার কাছে বিশ্ববাসীর অনেক কিছু শেখার আছে।’ শেখ হাসিনা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০০ জন বুদ্ধিজীবীর অন্যতম। তিনি বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ জন নেতারও অন্যতম। সিঙ্গাপুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা দ্য স্ট্যাটিসটিকস ইন্টারন্যাশনাল শেখ হাসিনাকে বিশ্বের ‘দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মাদার তেরেসা পদক, বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সেরেস পদক, ইউনেসকোর শান্তিবৃক্ষ পুরস্কার, জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ পুরস্কার এবং ডটার অব ডেমোক্রেসি পদক অর্জন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি পিপলস অ্যান্ড পলিটিকসের গবেষণায় বিশ্বের পাঁচজন সৎ সরকারপ্রধানের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশের বাইরে শেখ হাসিনার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। বেতন ছাড়া শেখ হাসিনার সম্পদের স্থিতিতে কোনো সংযুক্তি নেই। শেখ হাসিনার কোনো গোপন সম্পদ নেই। বাংলাদেশের ৭৮ শতাংশ মানুষ মনে করে, শেখ হাসিনা সৎ এবং ব্যক্তিগত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান জিম ইয়ং কিম বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বকে পথ দেখিয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের লিঙ্গবৈষম্য বিষয়ক প্রতিবেদন ‘দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৭’ অনুযায়ী লিঙ্গবৈষম্য দূর করার প্রতিযোগিতায় ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকে অনেক পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। ১৪৪টি দেশের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি এ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নারীর জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি ও অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। প্রাথমিক স্তর ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির সূচকে বাংলাদেশ এক নম্বরে। জন্মের সময় নারী-পুরুষ অনুপাতেও বাংলাদেশ এক নম্বরে। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে আছে এবং গত ৫০ বছরে সরকারপ্রধানের সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান এক নম্বরে। নারী উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন এবং এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও জাতীয় উন্নয়নে তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর শাসনামলে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারী উন্নয়নের বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদে তিনটি সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়নের পরিবর্তে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০১১ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি।
শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন লায়ন্স অ্যাসোসিয়েশনের রাষ্ট্রপ্রধান পদক এবং রোটারি ইন্টারন্যাশনালের পল হ্যারিস ফেলো পদক। পার্বত্য শান্তিচুক্তির জন্য ১৯৯৮ সালে পেয়েছেন ইউনেসকোর হুপে-বোয়ানি (Houphouet-Boigny) শান্তি পুরস্কার। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল এস বাক পদক এবং ২০১০ সালে এমডিজি অ্যাওয়ার্ড ও বিশ্বখ্যাত ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দূরদর্শী নেতৃত্ব ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে অনবদ্য অবদানের জন্য ইংল্যান্ডের হাউস অব কমনস কর্তৃক গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড এবং জাতিসংঘের সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড ২০১১ : ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট হেলথ পুরস্কার। ২০১২ সালে পেয়েছেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বিশেষ অবদানের জন্য আইএনইএসসিও কর্তৃক কালচারাল ডাইভারসিটি পদক। ২০১৩ সালে পেয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তা এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন পদক। জাতিসংঘের আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার এবং রাজনীতিতে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ভূমিকার জন্য উইমেনস ইন পার্লামেন্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন ২০১৫ সালে। বাংলাদেশসহ এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নারীর শিক্ষা, উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান এবং নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ হাসিনা গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেছেন ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিনিকেতনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্মিত ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন করেছেন ২০১৮ সালের ২৫ মে এবং পশ্চিমবঙ্গের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন ২০১৮ সালের ২৬ মে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতসহ বহু অর্জনের প্রেরণা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রিয় বাংলাদেশের এ অর্জন দেশপ্রেমিক ও নতুন প্রজন্মকে গর্বিত করে। অধিক প্রেরণা জোগায় দেশপ্রেম, সততা ও নিষ্ঠা দ্বারা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।
লেখক : জেন্ডার ও উন্নয়ন গবেষক এবং সহকারী পরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট
সৌজন্যেঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ