7222
Published on মে 21, 2018সুভাষ সিংহ রায়ঃ
১৯৮১ সালের ১১ মে তারিখে বিশ্বখ্যাত ‘নিউজউইক’ পত্রিকায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ‘বক্স আইটেম’ হিসেবে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় : ১৯৭৫ সালে সামরিক চক্র কর্তৃক ক্ষমতা দখলকালে নিহত পিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারিণী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শেখ হাসিনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শেখ হাসিনা বলেন, তিনি নিহত হওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত নন; এমনকি যে-সরকারের মোকাবিলা করবেন তার শক্তিকে তিনি বাধা বলে গণ্য করবেন না। তিনি বলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেসব কাজ অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য বলে আমি বিবেচনা করি তার মধ্যে থাকবে দেশের প্রত্যেকটি মানুষের পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’ নিজের কর্তব্য পালনে তার পিতার অবদান সহায়ক হবে বলে তিনি মনে করেন। ‘তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) প্রতি বাংলাদেশের জনগণের প্রীতি ও ভালোবাসা ছিল অপরিমিত’। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাকে (আওয়ামী লীগের) সভানেত্রী নির্বাচিত করে পরোক্ষভাবে তাঁকেই সম্মান দেখানো হয়েছে। আমি তাঁর অসমাপ্ত কর্মকা- সম্পন্ন করতে পারব।’ [নিউজউইক, ১১ মে ১৯৮১]
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হন তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ও ছোট কন্যা শেখ রেহানা তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। বিদেশে ছিলেন বলেই তারা রক্ষা পান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে তারা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে অবস্থানকালে শেখ হাসিনা ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সভানেত্রী নির্বাচিত হন। তার সন্তানদের অসুস্থতাবশত তিনি অবিলম্বে সভানেত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করতে পারেননি।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার কিছুকাল পর এক সাংবাদিক সাক্ষাতকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি শীঘ্রই দেশে ফিরে বাংলাদেশের নিহত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলবেন। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার বাবার হত্যাকারীগণ এবং তাদের সহযোগীদের প্রকাশ্য বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তিদানের দাবি উত্থাপন করাই হবে আমার প্রথম কাজ।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে ফেরা তার পক্ষে নিরাপদ হবে কি-না জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। আমি হয়তো একটু ঝুঁকি নিচ্ছি। কিন্তু আমার বাবা যে আদর্শের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন তা বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই ঝুঁকি নিতেই হবে।’
বঙ্গবন্ধুর সমালোচকরা দাবি করে তিনি নিজেকে জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেনÑ এ সম্বন্ধে মতামত জানতে চাইলে শেখ হাসিনা দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘তা হলে আমার বাবাকে হত্যা করার প্রয়োজন ছিল না। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁকে সরিয়ে দেয়া যেত।’
জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক অবস্থান সম্প্রতি দুর্বল হয়েছে কি-না জিজ্ঞেস করা হলে সম্মতিসূচক উত্তর দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তার (জিয়াউর রহমানের) শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিক, কর্মচারী, ছাত্র, কৃষক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং সরকারী অফিসারদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যে কয়েকজন সামরিক অফিসারকে পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে সে নিয়োগ করেছে এবং যারা শুরু থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছে, কেবল তারাই তাকে (জিয়াউর রহমানকে) সমর্থন করে।’
বাংলাদেশ সরকার তার প্রত্যাবর্তন কি চোখে দেখবে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘তা আমি কি করে জানবো? দেশে এখন সামরিক শাসন রয়েছে। যে কোনো কিছু ঘটতে পারে।’
১৯৭৫-এর আগস্ট মাসের ঘটনাবলীর পেছনে পাশ্চাত্যের কোনো শক্তি, আংশিকভাবে হলেও জড়িত কি-না জিজ্ঞেস করা হলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি কর্তৃক সমগ্র ব্যাপার সম্পর্কে তদন্ত করা উচিত। কে বা কারা এ ব্যাপারে জড়িত ছিল এখন তা বলা কঠিন।’
তার দল সম্পর্কে পাশ্চাত্যের শক্তিবর্গের কি অভিমত তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে আমার বাবার স্বঘোষিত হত্যাকারী কর্নেল রশীদকে ব্রিটেনে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এ ঘটনা থেকে এ ব্যাপারে তাদের মনোভাব অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু আমি তাদের মনোভাব জানি না। গত বছর (১৯৮০) আমি ব্রিটেনে সাত মাস কাটিয়েছি এবং বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছি। কয়েকজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমি আলাপ করেছি। তারা অত্যন্ত সহানুভূতিশীল।’
জিয়াউর রহমানের প্রতি জনসাধারণের বিরূপ মনোভাবের কারণ সম্পর্কে তিনি কি মনে করেন- এই প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বন্দুকের সাহায্যে সে দেশ শাসন করছে। যারাই প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছে তাদের নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে।’
বাংলাদেশের জনগণ তার প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে কি মনে করে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে আমি বহু চিঠি, তারবার্তা এবং ট্র্যাঙ্ককল পাচ্ছি। তারা সবাই চান আমি যেন দেশে ফিরে যাই।’ [দৈনিক মিলাপ, নয়াদিল্লী, মার্চ ১৯৮১]
‘দৈনিক সত্যযুগ’-এর দিল্লীর প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাতকারকালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশের কোন কোন মহল কর্তৃক যে অপপ্রচার শুরু হয় তার জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ায় আজ যারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, ক্ষোভের শিকার হয়ে আজ যারা আমার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা রকমের অপপ্রচার চালাচ্ছেন, সত্তর-একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ভূমিকা কি ছিল তা স্মরণ করুন। তা হলেই বুঝতে পারবেন, এসব অপপ্রচারকারীরা কারা এবং তাদের ক্ষোভের কারণটাইবা কি।’
॥ দুই ॥
শেখ হাসিনার বাংলাদেশে ফিরে আসার সংবাদ পরদিন (১৮ মে ১৯৮১) ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করা হয়। ‘দৈনিক সংবাদ’-এ প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, ‘লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয় তাদের নেত্রীকে।’
শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা যে অনন্য রূপ ধারণ করে সে সম্পর্কে এক রিপোর্টে বলা হয়-
রাজধানী ঢাকা গতকাল (১৭ মে) মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মিছিল। শুধু মিছিল আর মিছিল। প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি। সেøাগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের স্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে। গতকালের ঢাকা নয় বছর আগের কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে এসেছিলেন সেদিন স্বজন হারাবার ব্যথা ভুলে গিয়েও লাখ লাখ জনতা রাস্তায় নেমে এসেছিল নেতাকে এক নজর দেখার জন্য। গতকালও হয়েছে তাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য ঢাকায় মানুষের ঢল নেমেছিল। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলানগর পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। ফার্মগেট থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রাফিক বন্ধ ছিল প্রায় ছ’ঘণ্টা। [দৈনিক সংবাদ, ঢাকা, ১৮ মে ১৯৮১]
আর একটি রিপোর্টে বলা হয়-
তিনি বলেন, আমি বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ পরবর্তীকালের বিভিন্ন হত্যাকা-ের বিচার চাই। বিচার চাই বাংলার জনগণের কাছে, আপনাদের কাছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিচার করবে না। ওদের কাছে বিচার চাইব না। আপনারা আমার সঙ্গে ওয়াদা করুন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করব।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে ‘সিস্টেম’ (পদ্ধতি) চালু করতে চেয়েছিলেন তা যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলে বাংলার মানুষের দুঃখ আর থাকত না। সত্যিকার অর্থেই বাংলা সোনার বাংলায় পরিণত হতো।
শেরেবাংলানগরে অনুষ্ঠিত লাখো জনতার গণসংবর্ধনাটি ছিল আনন্দঘন ও হৃদয়বিদারক। দলীয় নেত্রীর আগমনে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ছিল আনন্দ, উল্লাস আর উচ্ছ্বাস। অন্যদিকে আপনজনহারা নেত্রীর দুঃখ আর বেদনার কথা আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের মধ্যে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি করে। বক্তৃতাকালে শেখ হাসিনা বারকয়েক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনদিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।
তিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ^াসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, ক্ষমতাসীনরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের হত্যা করে বলেছিল, জিনিসপত্রের দাম কমানো ও শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আজকে দেশের অবস্থা কি? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য আকাশচুম্বী। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দিনে-দুপুরে রাস্তায় মানুষ খুন করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশে^র দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ খেতে পায় না, আর এক শ্রেণীর লোক প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছে।
তিনি বলেছিলেন, ‘ক্ষমতার গদি পাকাপোক্ত করার জন্য ওরা আগামী দিনে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করবে। আবার বাংলার মানুষ শোষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হচ্ছে। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালী জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম করি।
বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেছিলেন, ‘আপনাদের ভালবাসা পাথেয় করে আমি আগামী দিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করে দেব।’ [দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা, ১৮ মে ১৯৮১]
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার কয়েকদিন পর নয়াদিল্লীতে এক সাংবাদিক সাক্ষাতকারে শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করেন, দীর্ঘদিন সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর রাজনীতিতে ফিরে আসাকে তিনি কিভাবে দেখছেন?
শেখ হাসিনা বলেন, ‘রাজনীতি আমার রক্তে মেশানো। ছাত্রীজীবনে আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। পরবর্তীকালে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম এটা ঠিক নয়। জন্মের পর থেকে আমি কর্মচঞ্চল রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে ছিলাম। আমার পুরো জীবনটাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাজনীতির জন্যই মা-বাবা, ভাই ও আত্মীয়স্বজন হারিয়েছি। আমি রাজনীতির সঙ্গেই আছি। নতুন করে রাজনীতিতে এসেছি বলতে পারেন না। নতুন করে রাজনীতিতে প্রবেশের প্রশ্ন ওঠে না।’
তার ভারতে অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে উল্লেখ করে এ ব্যাপারে সত্যিকার অবস্থা কী তা জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছি। বহু লোক (১৯৭৫ সালের) ১৫ আগস্টের পর বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছে। দেশ থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমার ভারতে অবস্থান নিয়ে কোন কথা হওয়ার কারণ নেই।’ [সাপ্তাহিক রাজনীতি, ঢাকা, ১৫ মে ১৯৮১]
শেখ হাসিনা সম্প্রতি তার রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাল্যকাল থেকে আমি দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমার বাবা ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের অপরিসীম নির্যাতনের আমি সাক্ষী। আমার বাবা তাঁর জীবনের বিরাট একটি অংশ জেলে কাটিয়েছেন। যখনই জেলের বাইরে ছিলেন, রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও দলের সাংগঠনিক কাজে নিজেকে তিনি ব্যস্ত রেখেছেন। আমার মাকে দেখেছি বাবার রাজনৈতিক সাথী হিসেবে এবং বাবার অনুপস্থিতিতে পর্দার আড়াল থেকে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে দলীয় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আমাদের পারিবারিক পরিবেশে আমার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়। ১৯৬২ সালের দুর্বার ছাত্র আন্দোলন এবং স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবির সমর্থনে দেশব্যাপী গণআন্দোলনের সময় আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। সারাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাÑ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও জনসাধারণ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবির সেøাগান নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। আমি বিক্ষোভ-মিছিল ও সভায় যোগ দিয়েছি, গণবিরোধী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছি। ষাটের দশকের উত্তাল দিনগুলোতে কোন রাজনীতি-সচেতন বাঙালীর পক্ষে রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্যুত থাকা সম্ভব ছিল না। কাজেই আমিও নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারিনি।’
’৬০-এর দশকের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন তখন তিনি ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে তার গোপন বার্তাবাহিকা হিসেবে ব্যবহার করতেন।
শেখ হাসিনা ছাত্র আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি ইডেন কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা মহাবিদ্যালয়) ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সহ-সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে তার জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেন। নিজের কলেজে তিনি ছাত্রলীগ শাখার সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে তিনি ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শাখার সদস্যা এবং রোকেয়া হল শাখার সেক্রেটারি হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তার মা, ভাই, বোন ও স্বামীসহ তাকে কারারুদ্ধ করে।
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভারত সরকার, বিশেষ করে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার শারীরিক নিরাপত্তা সম্পর্কে শঙ্কিত বোধ করেন। তারা উভয়ে আততায়ী কর্তৃক নিহত হতে পারেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর ওপর যে আস্থা স্থাপন করেছিল তা অতুলনীয়। তার হৃদয়বিদারক মৃত্যুর পর তারা সে ধরনের আস্থা স্থাপনের উপযুক্ত ব্যক্তির অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু থেকে শেখ হাসিনার সভানেত্রী পদে নির্বাচন পর্যন্ত প্রায় ছ-বছরকাল আওয়ামী লীগ জনগণের পূর্ণ আস্থাভাজন ব্যক্তির সন্ধান দিতে পারেনি। রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনার প্রবেশ উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল। বঙ্গবন্ধুর কর্মী ও সমর্থকরা আওয়ামী লীগ পার্টি এবং প্রবীণ ও প্রগতিশীল নবীন নেতৃবৃন্দের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর লন্ডনের কনওয়ে হলে বেগম রাজিয়া মতিন চৌধুরীর সভানেত্রীত্বে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের এক সম্মেলনে সর্বইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়। এই উপলক্ষে বাকশাল, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা আবার এক প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হন।
১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে লন্ডন অবস্থানকালে শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাঁকে গণসংবর্ধনা জ্ঞাপন এবং বঙ্গবন্ধুর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ১৬ আগস্ট পূর্ব লন্ডনের ইয়র্ক হলে বিপুল জনসমাগম হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামের পর প্রবাসী বাঙালিদের লন্ডনে এর চেয়ে বড় সমাবেশ আর অনুষ্ঠিত হয়নি। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি এবং স্যার টমাস উইলিয়ামস, কিউ সি, এমপি, প্রধান বক্তা হিসেবে যোগ দেন। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে আগত তিনজন আওয়ামী লীগ নেতা, ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ড. কন্রাড্ উড এবং দুজন শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য বক্তৃতা দেন। আরও দুজন শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্যÑ পিটার শোর ও জেমস্ লামন্ডÑ সমাবেশে উপস্থিত থাকতে অসমর্থ হওয়ার লিখিত বাণী পাঠান।
স্যার টমাস আরও বলেছিলেন, যাদের হাতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের রক্তের দাগ রয়েছে তাদের বিচার করতেই হবে। শুধু বিচার করলেই চলবে না, বিচার করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হওয়াও প্রয়োজন। জাতির পিতাকে হত্যার ফলে বাংলাদেশের বহু লোক লজ্জিতবোধ করেন বলে তিনি সুনিশ্চিত। হত্যাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই লজ্জা দূর করা যাবে না।
স্যার টমাস জোর দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর সম্মানহানি নাকচ করার জন্য হত্যাকারীদের উপযুক্ত বিচার হওয়া অবশ্য প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে তিনি ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জয়লাভ করে বঙ্গবন্ধুর কালিমালিপ্ত সম্মান পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মধ্যেই বাংলাদেশের অঙ্কুর নিহিত ছিল বলে তিনি মনে করেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে সন্ ম্যাকব্রাইড, শেখ হাসিনা, মোহাম্মদ সেলিম (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর পুত্র) এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র) উপস্থিত ছিলেন।
॥ তিন ॥
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। প্রেসিডেন্ট সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে সে সামরিক আইন জারি করে রাজনৈতিক কার্যকলাপ, বিক্ষোভ, সভা-সমিতি ও ধর্মঘট বেআইনি বলে ঘোষণা করে।
সভা-সমিতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালন করে। এই উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সভা জেনারেল এরশাদ ও সামরিক আইনবিরোধী সর্বপ্রথম জনসমাবেশে পরিণত হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাদদেশে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন : ‘এই সামরিক শাসন মানি না, মানবো না।’
১৯৮২ সালের ২৫ মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবিতে এক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভকারীরা শেখ হাসিনাসহ দলের নেতৃবৃন্দের নিরাপত্তা দাবি করেন। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিও তারা জনান। [সাপ্তাহিক জনমত, লন্ডন, ৪ এপ্রিল ১৯৮২]
১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। এদিন তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছিলেন কেবল একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জীবনযাপনের উদ্দেশে নয়, জাতীয় রাজনীতির হাল ধরতে, সেনাশাসনের কবল থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে। দেশের মাটিতে পা রাখার দিন থেকেই শুরু হয় তার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামী জীবন, সাড়ে তিন দশকের অধিক সময় ধরে যা বিস্তৃত। শেখ হাসিনা রাষ্ট্র, সমাজ, দেশ, বিশ্ব সম্পর্কে চিন্তাধারার উত্তরাধিকার আমাদের জন্য প্রতি মুহূর্তে রেখে চলেছেন। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফিরে না এলে ক্ষমতার মদমত্ততার ও আত্মম্ভরিতার অবসান হতো না। এ কথা মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নির্মীয়মাণ ইতিহাসে শেখ হাসিনা নিজের জায়গা নিজে করে নিয়েছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছিলেন, শেখ হাসিনা যখনই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন তখনই বুঝে নিয়েছিলেন, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু পথ’। তার পথে পথে পাথর ছড়ানো ছিল। শুধু পাথর নয়; এক পর্যায়ে দেখা গেল ‘পথে পথে গ্রেনেড ছড়ানো’। শেখ হাসিনা জেনে গিয়েছিলেন, চলার পথে অনেক বাঁক থাকে, চোরাস্রোত থাকে, অনির্দিষ্ট আর অলক্ষ অনেক উপাদানে জড়িয়ে থাকে ইতিহাসের অনির্ধারিত গতিপথে। অথচ শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩৭ বছর অতিক্রমের পর প্রশ্ন থেকে যায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তার যথাযথ মূল্যায়ন কি করেছেন? বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গানের কথা মনে পড়ে ‘শুনে তোমার মুখের বাণী/আসবে ঘিরে বনের প্রাণী/হয়তো তোমার আপন ঘরে/পাষাণ হিয়া গলবে না।’ বিশ্বসংসার জয় করে এলেও নিজের দেশের অনেকের পাষাণ হৃদয় গলাতে পারেননি। ওই গানেই বলা আছে, ‘তা বলে ভাবনা করা চলবে না।’ এভাবেই শেখ হাসিনার পথচলা। বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনা জরুরী ছিলেন, জরুরী থাকবেন।
Link 1- https://goo.gl/2WtW5D
Link 2- https://goo.gl/j4mHC4