5057
Published on মে 20, 2018মিল্টন বিশ্বাসঃ
গত ১৭ মে ছিল শেখ হাসিনার ৩৮তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৮১ সালের এই দিনে তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর ফিরে আসার সঙ্গে এদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সম্পর্ক গভীর। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় আজ যে বাংলাদেশের চিত্র বিশ্ববাসী দেখছে তারও অগ্রসেনা শেখ হাসিনা। সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় একই দলের দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস তিনিই সৃষ্টি করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে আরেকটি পাকিস্তানে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন দেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে এনেছে।
দেশে ফেরার প্রতিক্রিয়ায় আবেগসিক্ত বর্ণনা আছে তাঁর নিজের লেখা গ্রন্থগুলোতে। তুলে ধরছি একটি উদ্ধৃতি : ‘আমার দুর্ভাগ্য, সব হারিয়ে আমি বাংলাদেশে ফিরেছিলাম। লক্ষ মানুষের স্নেহ-আশীর্বাদে আমি সিক্ত হই প্রতিনিয়ত। কিন্তু যাঁদের রেখে গিয়েছিলাম দেশ ছাড়ার সময়, আমার সেই অতি পরিচিত মুখগুলি আর দেখতে পাই না। হারানোর এক অসহ্য বেদনার ভার নিয়ে আমাকে দেশে ফিরতে হয়েছিল।...’ আমরা জানি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। ১৯৬২-তে স্কুলের ছাত্রী হয়েও আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে নেতৃত্ব দিয়ে মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষে কলেজ ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের পথ চলা। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ও রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। রাজনীতির সঙ্গেই তাঁর আজীবন বসবাস।
কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, শেখ হাসিনা যখনই বঙ্গবন্ধু’র স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন তখনই বুঝে নিয়েছিলেন—তাঁর ‘পথে পথে গ্রেনেড ছড়ানো’। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে তাঁর সাক্ষাত্কার থেকে জানা যায়, জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেও তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসন জারির দুইদিন পর স্বাধীনতা দিবসে একমাত্র শেখ হাসিনাই সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি সামরিক শাসন মানি না, মানবো না। বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবোই করবো।’
বস্তুত শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের দিন থেকেই রাজনীতির মঞ্চে দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের পূর্বে সেই বছরই শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ফলে জিয়ার অভিসন্ধি ভেস্তে যায়। সেদিনের ঢাকায় লক্ষ মানুষের বাঁধভাঙা স্রোত তাঁকে কেন্দ্র করেই সমবেত হয়েছিল। তাদের কণ্ঠে ছিল প্রত্যয়দীপ্ত স্লোগান: ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ সেদিনের প্রত্যয় শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারই বাস্তব করে তুলেছেন। জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের কয়েকজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাকি পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে এনে শীঘ্রই রায় কার্যকর হবে বলে দেশবাসী আশা করে।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, শেখ হাসিনার ফিরে আসার আগে নৈরাজ্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল এদেশের মানুষ। পাকিস্তানি শাসক, দালাল-রাজাকার ও আন্তর্জাতিকভাবে কয়েকটি দেশের বাধা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং আপামর জনগণের অংশগ্রহণে ৯ মাসের মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংগ্রামকে সফল হতে দেয়নি খুনিরা। ফলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তীকালে দেশ অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়। দেশের প্রতিকূল এক সময়ে জননেত্রীকে আমরা রাজনীতির মঞ্চে পেলাম। তিনি দায়িত্ব নিলেন এবং লাখো জনতার সমাবেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন—‘...বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’
গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও হাজারো প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি জনগণের পাশেই আছেন; ভবিষ্যতে থাকবেনও। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৭ সালের সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল পর্যন্ত একাধিক বার বন্দি অবস্থায় নিঃসঙ্গ মুহূর্ত কাটাতে হয়েছে তাঁকে। তিনি লিখেছেন :‘দেশ ও জনগণের জন্য কিছু মানুষকে আত্মত্যাগ করতেই হয়, এ শিক্ষা-দীক্ষা তো আমার রক্তে প্রবাহিত। ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫-এর পর প্রবাসে থাকা অবস্থায় আমার জীবনের অনিশ্চয়তা ভরা সময়গুলোয় আমি তো দেশের কথা ভুলে থাকতে পারিনি? ঘাতকদের ভাষণ, সহযোগীদের কুকীর্তি সবই তো জানা যেত।’ দেশে তখন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, রাজনীতিবিদদের বিশেষ আইনে কারান্তরীণ করে রাখা হয়েছিল দিনের পর দিন। এমন এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের পথ সুগম হয় শেখ হাসিনার আগমনে।
মূলত শেখ হাসিনা এদেশে এসে ক্ষমতায় আসীন হয়ে বাংলাদেশবিরোধী শক্তির মূলোত্পাটন করেছেন। ইতোমধ্যে বিচারের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট রয়েছেন। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত সুশাসন নিশ্চিত করা। সেই চেষ্টা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর তাঁর সরকারের কার্যক্রমে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। এসবই মাটি ও মানুষের টানে শেখ হাসিনার ফিরে আসার কারণেই সম্ভব হয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক