4297
Published on এপ্রিল 1, 2018বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন একবার, আর ‘মুক্তি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন পাঁচ বার। ‘স্বাধীনতার’ চেয়ে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ ‘মুক্তি’। মুক্তি বলতে সব বঞ্চনা, বৈষম্য, শোষণ, সংকীর্ণতা, ক‚পমণ্ড‚কতা, চেতনার দীনতা থেকে মুক্তি বুঝিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম চলছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সিঁড়িতে পা রেখেছে। ২০২৪ সালে চূড়ান্ত সমাবর্তন হবে। নির্দিষ্ট তিনটি মানদণ্ডের সবকটিতে উত্তীর্ণ হয়েই বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা, যে হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে এই উত্তরণ ঘটল এগুলো বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত কোনো পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে তৈরি হয়নি। সূচকগুলো জাতিসংঘের নিজস্ব পদ্ধতিতে তাদের সংগৃহীত পরিসংখ্যান নির্ভর। যদিও পরিসংখ্যান সব সময় সত্য কথা বলে না। ১৯০৬ সালে মার্ক টোয়েন তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘সংখ্যা কখনো কখনো আমাকে বিভ্রান্ত করে।’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেনজামি ডিজরেলি নাকি বলেছিলেন, ‘মিথ্যা তিন প্রকার : মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান।’ যার কারণে পরিসংখ্যান ব্যবহার না করেই বলা যায় বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ, বদলে গেছে বাংলাদেশ। ৭ মার্চ ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘৭ কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় রাজনীতির কবি (পোয়েট অব পলিটিক্স)। বঙ্গবন্ধু রচিত শ্রেষ্ঠ কবিতা তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ওপর গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা এবং ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যটি তৈরি করেছেন তাঁর কন্যা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতুর দিকে তাকালেই মনে পড়ে যাবে ‘৭ কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’র স্থাপত্য রূপ এটি।
উন্নয়নশীলতার পথে যাত্রার উদযাপন চলছে সারা দেশে, বেদনাদায়ক ঘটনা হচ্ছে তারও বিরোধিতা হচ্ছে। কারা এর বিরোধিতাকারী। বিরোধিতাকারী তারাই যারা যুগে যুগে বাঙালিত্ব ও বাঙালির অগ্রযাত্রার বিরোধিতা করেছিল। জামায়াত-বিএনপি-পাকিস্তানি অপশক্তির দোসররা। যারা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট দেশটাকে বদলে পূর্বপাকিস্তান কায়েম করেছিল। অনেকে বলেন, বিএনপি নামক দলটির কোনো আদর্শ নেই। তারা ভুল বলে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের চেতনার বিরোধিতাই এই দলটির আদর্শ। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল বাম-ডান-দক্ষিণপন্থি, মধ্যপন্থি, দলছুট, সুবিধাবাদী সব অপশক্তির প্লাটফরম হচ্ছে বিএনপি। পৃথিবীতে বেশিরভাগ সামরিক শাসকই দল গঠন করেছিলেন যাদের কোনো দলই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিএনপি নামক দলটি ভালোভাবেই টিকে আছে। আদর্শহীনভাবে কোনো দল দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না। বিএনপির আদর্শ বুঝতে হলে এর সঙ্গে যারা সংযুক্ত হয়েছিলেন তাদের চরিত্র বুঝতে হবে। ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি অংশ নেয়। ১৯৭৯ সালের বিএনপি মনোনয়নপ্রাপ্ত ৩০০ প্রার্থীর মধ্যে ২৫০ জন ছিলেন দালাল গোত্রের/শ্রেণির (অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাম, লেগাসি অব ব্লুাড : পৃ. ১৪২)।
অতএব সমগ্র জাতি যখন উন্নয়নশীল দেশের যাত্রাকে স্বাগত জানাচ্ছে, প্রেস ব্রিফিং করে পল্টন থেকে তার বিরোধিতা করছে বিএনপি। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকা ভুক্তির সার্টিফিকেটটি দিয়েছে জাতিসংঘ। এটি গ্রহণ না করে এ নিয়ে উচ্ছ¡াস না দেখিয়ে বাংলাদেশের আর কী করার ছিল। বিএনপি এবং সুশীল জাতীয় কিছু ব্যক্তির কথা মনে হচ্ছে শিক্ষক পরীক্ষা নিয়ে কোনো ছাত্রকে তৃতীয় শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে প্রমোশন দেয়ার পর ছাত্রের বলা উচিত, ‘না ভাই আমি চতুর্থ শ্রেণিতে উঠব না, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার চাপ বেশি, তাছাড়া তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ফ্রি টিউশন পাওয়া যায় স্কুলে, আমি তৃতীয় শ্রেণিতে থেকে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম।’ বিরোধী দল থেকে সরকারের পরিসংখ্যানকে বিশ্বাসযোগ্য নয়- বলা হচ্ছে। কিন্তু উন্নয়নের ছোঁয়াকে বুঝতে তো পরিসংখ্যানের প্রয়োজন নেই বিদ্যুতের যে লোডশেডিং নেই, রাস্তা পাকা, সবাই যে কর্মব্যস্ত তা তো সে নিজেই দেখতে পাচ্ছে। যে দেশে মহিলাদের পেশার ঘরে নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে লিখতে হতো গৃহিণী। এখন কেবলই গৃহিণী বলতে আর কেউ অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। গ্রামের প্রত্যেক মহিলাই কোনো না কোনো ইনকাম জেনারেটিং কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তীব্র অভাব অনাটন বলতে যা বুযায় তা এখন একেবারে নেই বললেই চলে।
মাথাপিছু আয় বেড়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে, পরিবারের জন্য পণ্য ও সেবা ক্রয়ের সংখ্যা ও পরিমাণ বেড়েছে। মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে, চিকিৎসাসেবা নাগালের মধ্যে এসেছে, ব্যয়ও বেড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে আয় না বাড়লে ব্যয় বাড়ল কীভাবে। তাছাড়া একজনের ব্যয় তো অন্য জনের আয়ও বটে। তবে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। আয় বাড়ার সঙ্গে আয়ের বৈষম্য কমাতে হবে। আমরা অসহনীয় মাত্রায় বৈষম্য রেখার একেবারে কাছাকাছি আবস্থান করছি। দুর্নীতির ব্যাপকতা আমরা কমাতে পারিনি। শিক্ষার পরিমাণগত ব্যাপকতা বাড়লেও মানগত গভীরতার দিকে আমাদের আরো অনেক মনোযোগী হতে হবে।
শিক্ষা খাতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বরাদ্দ হলো জিডিপির ৬ শতাংশ এবং বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে এ বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ আর বাজেটের ১৫ শতাংশের মতো। শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দিক থেকে আমাদের অবদান বিশ্বে ১৫৫তম। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অধিকতর বিনিয়োগ করে আমাদের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে আরো উন্নতি করতে হবে। ডেমোগ্রাফিক ডিভেডেন্টকে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে অধিকতর বিনিয়োগ করতে হবে। মানবসম্পদের উন্নয়ন ও সুশাসনই কেবল আমাদের ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের এনট্রান্স পরীক্ষা চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণের নিশ্চয়তা দেবে। মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্টের ভাষায় বলতে হয়, ‘বাট আই হ্যাভ প্রমিজ টু কিপ এন্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।'
সৌজন্যেঃ দৈনিক ভোরের কাগজ