1871
Published on মার্চ 24, 2018পাকিস্তানি পতাকা নয়, বাংলার আকাশে উড়ছে শহীদের রক্তে রাঙা লাল সূর্য ও শ্যামল বাংলার প্রতীক লাল-সবুজ পতাকা। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পূর্ববাংলার সর্বত্র ওড়ে লাল-সবুজে গড়া প্রিয় পতাকা। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তানের জাতীয় দিবস। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস নয়, পূর্ববাংলায় পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস। আর বর্তমানে ২৩ মার্চ জাতীয় পতাকা দিবস। এই দিন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম উত্তোলিত হয় বাংলাদেশের প্রিয় জাতীয় পতাকা।
এর আগে অবশ্য অনানুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল। মার্চের তিন তারিখে সারা পূর্ববাংলায় পূর্ণদিবস হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টন ময়দানের জনসভায় ওড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা। হরতালের সময় ঢাকার রাজপথে গাছ ও রেলের বগি দিয়ে ব্যারিকেড দেয় জনতা। মার্চ মাসের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে চলে অসহযোগ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরই স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে বাঙালি। অন্যদিকে ১৬ মার্চ থেকে ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সংকট নিরসনে আলোচনা বৈঠক চালালেও গোপনে গণহত্যার হীন ষড়যন্ত্র পাকা করতে থাকে। ২১ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টো বাহ্যত আলোচনার জন্য ঢাকায় এলেও প্রকৃতপক্ষে ষড়যন্ত্র পূর্ণ করতেই আসেন। এমনি পরিস্থিতিতে ২৩ মার্চে পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে পূর্ববাংলায় পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস। এই দিবসে পাকিস্তানের পতাকা নয়, পূর্ববাংলার অফিস-আদালত সর্বত্র ওড়ে বাংলাদেশের নতুন প্রস্তাবিত পতাকা। ছাত্রলীগ প্রতিরোধ বাহিনী ঢাকার পল্টন ময়দানে এক আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করে, যেখানে বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সংগীত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়ে পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের আনুষ্ঠানিক অভিবাদন গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। তার ধানম-ির বাসভবনে হাজারো জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগান। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেও আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের পতাকা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। যশোর ইপিআর সদর দপ্তরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঢাকায় ছাত্ররা চীনা দূতাবাস থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। অন্যান্য দূতাবাসেও এদিন পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করা হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। জনতা মিছিল করে সারাদিনই যায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তার দেখা পেতে। এই দিন বঙ্গবন্ধু বারবার মিছিলকারীদের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন ৭ কোটি মানুষের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা শেষে উদাত্ত কণ্ঠে বলেন, ‘জয় বাংলা, আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, জাগো জাগো বাঙালি জাগো, সংগ্রাম সংগ্রাম চলছে চলবে’।
১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরও পূর্ববাংলার মানুষের মুখপাত্র দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি। বাঙালির ন্যায্য দাবিকে অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানি সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আঁতাত করেন পশ্চিম পাকিস্তানি দল পিপিপির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে।
১৯৭১ সালের শুরু থেকেই তাই চলতে থাকে প্রতিবাদ, বিক্ষোভÑ যা পরে রূপ নেয় গণআন্দোলনে।
চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত নামে একটি জাহাজে অস্ত্র রসদ আসে পূর্ববাংলায় গণহত্যা চালানোর অভিপ্রায়ে। ডক শ্রমিকরা এই অস্ত্র ও রসদ খালাস করতে অস্বীকৃতি জানান। পাকিস্তানি সৈন্যরা এই অস্ত্র খালাস করতে গেলে শ্রমিকরা বাধা দেন। স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পূর্বনির্ধারিত বেতার ভাষণ বাতিল করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের দুদফা বৈঠক হয়। সেনা অফিসারদের সঙ্গেও বৈঠক করেন ইয়াহিয়া। এদিন জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেস কনফারেন্সে শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে যে ব্যাপক মতৈক্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তিনি আবার সাক্ষাৎকারের আশা রাখেন বলে জানান। এসবই ছিল ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার ভাঁওতাবাজি। আলোচনা ও সমঝোতার নামে কালক্ষেপণ করে তারা বিপুল পরিমাণে অস্ত্র আনেন পশিচম পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশ থেকে। বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করার নির্মম ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে নরপিশাচরা।
সৌজন্যেঃ আমাদের সময়