4926
Published on মার্চ 21, 2018হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের আরেকটি বড় অর্জন লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রির (এলডিসি) পর্যায় থেকে ডেভেলপিং কান্ট্রি হিসেবে ঘোষিত হওয়া এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ। এই সরকার আরেক মেয়াদে শাসন ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ যে কিছুকালের মধ্যে ডেভেলপড কান্ট্রিতে উন্নীত হবে, সে বিষয়ে অনেকেরই সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক দোষত্রুটি থাকতে পারে; কিন্তু তার অর্জনগুলো যে বিশাল, তা এখন জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করে।
একটা মজার ব্যাপার এই যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের অর্জন বাড়ে। আর বিএনপি ক্ষমতায় অথবা বিরোধী দল হিসেবে থাকুক তার নেতাদের কণ্ঠে শুধু গর্জন শোনা যায়। বর্তমানে বিএনপি হঠাৎ পরম গণতন্ত্রপ্রেমী হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার নেতাদের কণ্ঠে এখনও যে কথা শোনা যায়, তা গণতন্ত্র সম্মত কথা নয়। তা পতিত স্বৈরাচারের গর্জন। সম্প্রতি খুলনার জনসভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম যা বলেছেন, তা কোনো গণতান্ত্রিক বক্তব্য নয়। রীতিমতো হুঙ্কার অথবা গর্জন।
দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের প্রতিপক্ষ। বর্তমানে বিএনপি মাঠে বিরোধী দল। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে পরাজিত করে ক্ষমতায় যাওয়া। আওয়ামী লীগকে একেবারে দেশ ছাড়া করা নয়। প্রতিপক্ষকে দেশ ছাড়া করার রাজনীতি অবশ্যই গণতান্ত্রিক রাজনীতি নয়। ফ্যাসিবাদী রাজনীতি। বিএনপি এখনও এই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির চর্চা করতে চায় বলেই মির্জা ফখরুলের খুলনা-বক্তৃতা থেকে অনুমিত হয়।
খালেদা জিয়া এতদিন ছিলেন বিএনপির নেত্রী। এখন তাকে দলের জননী বানানো হয়েছে এবং মির্জা ফখরুলও তাকে ‘আমাদের মা’ ডেকে চোখের পানি ঝরিয়েছেন। তাতে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু ‘মা জননীর’ রাজনীতি সম্পর্কে যা বলেছেন, তা গণতন্ত্রসম্মত কথা নয়। তারা ক্ষমতায় এলে কি ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি করবেন, তার প্রকাশ্য ঘোষণা রয়েছে মির্জা ফখরুলের ভাষণে।
মির্জা ফখরুল খুলনার জনসভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনের মাঠে নামেন, তিনি যদি আবার মাঠে মাঠে চারণ-কবির মতো রাজনীতি শুরু করেন, তাহলে এই স্বৈরাচারী সরকারকে, যারা জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, তাদের শুধু এই দেশ থেকে নয়, উপমহাদেশ থেকে চলে যেতে হবে।’ মির্জা ফখরুল এককালে চীনপন্থী বাম রাজনীতিক ছিলেন। শাখামৃগের মতো তিনি বাম ডাল থেকে ডান ডালে ঝম্প প্রদান করে তার অবস্থান পরিবর্তন করলেও দেশে বারবার কারা বন্দুকের জোরে জনগণের ভোটাধিকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছিলেন, তা কি তার জানা নেই?
কোনো দল ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই যদি ঘোষণা দেয়, তাদের রাজনীতির ফলে প্রতিপক্ষকে দেশ ছাড়তে হবে, সেটা কোন ধরনের গণতান্ত্রিক রাজনীতি? অনেকেই আশঙ্কা করেন, বিএনপি এবার যে কোনো উপায়ে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসতে পারলে দেশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি মাত্রা ছাড়াবে। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নয়, সেক্যুলারপন্থী যে কোনো দল ও তাদের নেতাকর্মীদের দেশ ছেড়ে পালাতে হবে, নয় নির্যাতনের শিকার হতে হবে। বিএনপির ছত্রছায়ায় বসে প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্র জামায়াত তাদের নেতা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য দেশ রক্তে ভাসাবে। আবার হিংস্র মৌলবাদ মাথা তুলবে। সংখ্যালঘু ও নারী নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ভাঙবে।
দেশের এক বিরাটসংখ্যক মানুষ বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এই অবস্থার উদ্ভব হওয়ার আশঙ্কা করছেন। আমি তাতে বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু খুলনায় মির্জা ফখরুলের বক্তৃতা ঢাকার কাগজে পাঠ করে অনুমান হচ্ছে, বিএনপি আগামী নির্বাচনে জয়ী হলে মানুষের মনের এই আশঙ্কা সত্য হতে পারে। মির্জা ফখরুল হয়তো তার বক্তৃতায় সেই আভাসই দিচ্ছেন। গ্রেফতার হওয়ার আগে বেগম জিয়া বলেছিলেন, ‘দেশের প্রশাসন বিএনপির পক্ষে। কিন্তু এই প্রশাসনেরই বহু লোক তারেক রহমান দেশে ফিরে ক্ষমতায় বসলে কী করবেন, তা ভেবে শঙ্কিত। এই শঙ্কা কি অমূলক?
আওয়ামী লীগকে দেশ ছাড়া করার হুমকি বিএনপি আজ যে নতুন দিল, তা নয়। কয়েক বছর আগে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতি অভ্যুত্থানের সময় বেগম জিয়া রুদ্রমূর্তি ধারণ করে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশত্যাগের আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। শুধু হুমকি নয়, এই হুমকি কার্যকর করার জন্য অতীতে বহুবার চেষ্টা হয়েছে। কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টারের মতো শীর্ষ পর্যায়ের বহু আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে অনেকবার। তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল গ্রেনেড হামলা। একদিনের হামলাতেই আইভী রহমানসহ অনেককে হত্যা এবং দেড় শতাধিক মানুষকে জখম করা হয়।
তারপরও ২০১৪ সালের নির্যাতনের আগে ও পরে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার উচ্ছেদের আন্দোলনের নামে দেশব্যাপী যে পেট্রলবোমা হামলা চালিয়ে নিরীহ নর-নারী শিশুকে পর্যন্ত হত্যা করেছে, সেই সন্ত্রাসের কথা কি দেশের মানুষ এত শিগগির ভুলে গেছে? ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাস পর্যন্ত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতারা এবং বর্তমান নেতারা আওয়ামী লীগকে দেশের রাজনীতি থেকে নির্মূল করার জন্য যত চেষ্টা করেছেন, তা সফল হয়নি। বর্তমানে হুমকি দিয়ে কি তা সফল করা যাবে?
কোনো রাজনৈতিক দল যত বড়ই হোক রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারে না, যদি তার পেছনে জনসমর্থন না থাকে। ভারতের হিন্দু মহাসভা, পাকিস্তানের কনভেনশন মুসলিম লীগ ও মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ইতিহাস সেকথাই বলে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বেলাতেও সেকথা সত্য হবে, যদি তারা জনসমর্থন হারায়। কেবল নির্বাচনে পরাজিত হলেই কি প্রতিপক্ষ দলকে দেশছাড়া করা যায়? তাহলে বিএনপি দলটি এখনও দেশে টিকে আছে কি করে? দলের বর্তমান চেয়ারম্যান তারেক রহমান তো বহুকাল দেশছাড়া। তাতে দল তো দেশছাড়া হয়নি।
২০০১ সালের নির্বাচনে জিতে বিএনপি আওয়ামী লীগ সমর্থক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে, আওয়ামী লীগারদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে এই দলকে দেশছাড়া করতে পারেননি। তারা আবার ক্ষমতায় এসেছে এবং এখনও দেশ শাসন করছে। বরং বিএনপিই এখন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে বলে মাতম জুড়ে দেশের মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন কুড়োবার চেষ্টা করছে।
এসব নির্যাতনের অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে বিএনপি তা জনগণের সামনে তুলে ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে তার প্রতিকার করতে পারে। তার বদলে মাঠে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগকে দেশছাড়া করার আগাম ঘোষণা তো বিএনপির অতীতের প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতির পুনরাবৃত্তি করার আশঙ্কাই মানুষের মনে জাগিয়ে তুলবে। সেজন্যই বিএনপি-জোট আগামী নির্বাচনে জয়ী হলে দেশে কি ঘটতে পারে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে এত আশঙ্কা।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে, এটা দলীয় গৌরব নয়, জাতীয় গৌরব। এজন্য বিএনপির উচিত দেশের এই গৌরবে নিজেরাও গর্বিত হওয়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে অভিনন্দন জানানো। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারেরও উচিত, বিএনপি যাতে টালবাহানা না করে নির্বাচনে আসে তার পরিবেশ তৈরি করা। দলটির শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বাধা না দেয়া, তাদের কর্মী ও নেতাদের পুলিশের দ্বারা হেনস্তা না করা।
বিএনপির উচিত হুমকি-ধমকি দেয়া ও সন্ত্রাসের পথ ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করা এবং আগামী সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ দ্বারা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। আওয়ামী লীগ জন্মাবধি রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার। এই নির্যাতন দ্বারা দলটিকে কেউ ধ্বংস করতে পারেনি, বরং দলটির জনসমর্থনের শিকড় আরও শক্ত হয়েছে। এই দলের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এমন দলের একটি নির্যাতক চেহারা দেশের মানুষ দেখতে চায় না। আওয়ামী লীগ যদি এ সম্পর্কে সতর্ক হয় এবং বিএনপিও হুমকি-ধমকির অতীতের অভ্যাস বর্জন করে, তাহলে সব দলের অংশগ্রহণে দেশে এবার একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস।
সৌজন্যেঃ দৈনিক যুগান্তর
প্রকাশঃ ১৮ মার্চ, ২০১৮