4440
Published on মার্চ 17, 2018স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, মহাকালের মহাপুরুষ বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির পিতা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাডায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
একজন ছাত্রকর্মী হিসেবে রাজনীতিতে মুজিবের প্রবেশ এবং ভারত বিভক্তির আগেই বাঙালি মুসলমান ছাত্র-যুবাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে তার আবির্ভাব। ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানের পূর্বদেশ পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন এবং সরকারি নির্যাতনের শিকার হয়ে যাত্রা শুরু করলেন। ১৯৪৬ সালে ছাত্র-যুবকর্মী মুজিব যে যাত্রা শুরু করলেন শেখ মুজিব হিসেবে, হয়ে উঠলেন মুজিব ভাই এবং মুজিব ভাই থেকে মুজিব সাহেব। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে মন্ত্রী, পরে দলের দায়িত্ব নিতে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ মুজিবকে যুব বাংলায় এক নতুন পরিচিতিতে অভিষিক্ত করে। বাংলার যুবমানসকে এক নতুন দিকদর্শন দেন। ক্ষমতা নয়, রাজনীতির লক্ষ্যার্জনে সংগঠন গড়ে তোলা অনেক বেশি জরুরি। লোভ নয়, আদর্শবাদিতা, নগদ প্রাপ্তি নয়, জনগণের কল্যাণ অনেক বড় বিষয় (আর এখন অবস্থাটা ঠিক বিপরীত। আগে প্রাপ্তি, পরে সময় পেলে মানুষের কথা ভাবা যাবে)। ত্যাগ-তিতিক্ষা আর দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সামনে পথ চলার অদম্য প্রয়াস ছাত্র-যুবাদের মুজিব ভাইকে অচিরেই জনতার শেখ সাহেবে পরিণত করে।
বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন কীভাবে বিশ্বনেতৃত্ব গড়ে উঠছে। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে প্রতিশ্রুতিশীল নেতৃত্ব আর আন্দোলন মার খেয়ে যাচ্ছে আর মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ছে। এসব থেকে তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন। সময়টা ছিল অন্যরকম। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তানরা তখন দুনিয়াব্যাপী নেতৃত্বে উঠে এসেছেন অথবা আসছেন। স্ট্যালিন, মাও সে তুং, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষ বসু, মাওলানা আযাদ, চার্চিল, হিটলার, রুজভেল্ট, আইজেক হাওয়ার, নাসের, নক্রুমা প্রমুখ নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্বের। সুবিশাল বিশ্বের এসব কুশলী নেতার জীবন আর সংগ্রাম ছিল তার চোখের সামনে। তিনি শিক্ষা নিয়েছেন তাদের জীবন থেকে। সময় তাকে পথ দেখিয়েছে। সময়ের হাত ধরে তিনি পথ চলেছেন অকুতোভয়ে। তিনি স্থির করেছিলেন তার লক্ষ্য এবং লক্ষ্যার্জনে এগিয়ে গেছেন দৃঢ় পদবিক্ষেপে। পেছন ফিরে তিনি হয়তো দেখেছেন, তা শুধু সামনে চলার পাথেয় সংগ্রহে। যারা পেছন ফিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, তিনি তাদের দলের নন।
শেখ মুজিবুর রহমান এক অন্য মানুষ। জীবনের প্রতীক তিনি। আর জীবন হচ্ছে সামনে পথ চলা। পশ্চাৎগামিতা তাকে কখনো ছুঁতে পারেনি। হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙার আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৪৮-এ বাংলা ভাষার জন্য উচ্চারিত দাবি, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোল, ’৫৪-এর নির্বাচন, ’৫৮-এর সামরিক শাসনের পর অ্যাবডো ইত্যাদি সত্ত্বেও আন্ডারগ্রাউন্ডে বাংলার স্বাতন্ত্র্যের জন্য সংগঠন গড়ার প্রয়াস, ’৬২-এর শিক্ষা (ছাত্র) আন্দোলন, সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন, ’৬৫-এর প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন, ’৬৬তে ছয় দফা দাবিনামা উত্থাপনের মধ্য দিয়ে তার নেতৃত্বের ও জীবনের প্রথম পর্যায়ের সফল সমাপ্তি। একজন এজিটেটর থেকে একজন পূর্ণাঙ্গ জাতীয় নেতায় তার সফল উত্তরণ। বয়স মাত্র ৪৬ বছর। এ পর্যন্ত পৌঁছতে তাকে অনেক বন্ধুরতা অতিক্রম করতে হয়েছে।
দলের ভেতরের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এবং হঠকারীদের সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করে এগোতে হয়েছে তাকে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে অনেকেই মনে করেছিলেন বুঝিবা মুজিবের রাজনীতির অবসান সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তা নয়। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে তিনি অভিভাবকহীন হয়ে নিজেই নিজের অভিভাবক হয়ে যান। তার মধ্যে যে স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তার নেতৃত্ব ঘুমিয়েছিল তা জেগে ওঠে। সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য শেখ মুজিব ইতিহাসের পাতায় উঠে আসেন এক অসাধারণ বাগ্মী হিসেবে, যা তাকে স্থাপন করে এডমন্ড বার্ক, কামাল আতাতুর্ক, আব্রাহাম লিংকন আর বিপিন চন্দ্র পালের কাতারে। তার এই অসাধারণ বাগ্মিতা সারা বাঙালি জাতিকে ঐকবদ্ধ করতে সাহায্য করেছিল।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের অভিভাষণ তাকে ইতিহাসের চূড়ায় তুলে দেয়। তিনি উঠে আসেন বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের কাতারে। বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে তার ভূমিকা হয়ে ওঠে একক ও অদ্বিতীয়। আশপাশে আর কেউ রইলেন না। জাতির নেতৃত্বের চূড়ায় তিনি বৃত হলেন। সারা জাতি তার ডাকে ঐক্যবদ্ধ হলো। এ এক অভূতপূর্ব অবস্থা। ১১ দফার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলন (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী আন্দোলন), ’৭০-এর নির্বাচন আর ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনের সময়কাল যারা দেখেছেন, তারা জানেন কীভাবে আন্দোলন-সংগ্রামের গর্ভ থেকে পূর্ববঙ্গ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু আর জাতির জনক। আমাদের দুর্ভাগ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্যতম হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে জাতির পিতাকে হারিয়েছি। যদিও এই ষড়যন্ত্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী চক্র মুজিববিরোধী এ দেশীয় ষড়যন্ত্রকরীদের খুঁজে পেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কালেই। যারা ভাবাদর্শগতভাবে পাকিস্তানি ধ্যানধারণায় পুষ্ট। সাম্রাজ্যবাদীদের এই পদলেহীরা পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়েও দলের অভ্যন্তরে ক্রীয়াশীল থেকে যায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, মুজিবাদর্শের পক্ষের শক্তি নিজেদের দুর্বলতার কারণে, দূরদর্শিতার অভাবে সাম্রাজ্যবাদী ও দেশীয় যড়যন্ত্রকারীদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। তাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দলের অভ্যন্তরে মুজিবাদর্শের প্রশ্নে কখনো দৃঢ় অবস্থান নিতে পারেননি। রাজনৈতিক অপরিপক্বতা ও আদর্শিক ক্ষেত্রে চিন্তার দৈন্যতার কারণে বারবার এই নেতৃত্ব হোঁচট খেয়েছে। কখনো দলে বিভক্তি এনেছে বামধারার নামে এবং কখনো এই বিভক্তির সুযোগ নিয়ে ডানপন্থিরা তথা মোশতাকের প্রেতাত্মারা সাম্রাজ্যবাদের পদলেহীরা দলকে বিপথগামী করেছে। অথচ মুজিবাদর্শ সর্বদাই মধ্যপন্থাকে অনুসরণ করার পরামর্শই দেয় আমাদের।
বাঙালি জাতি তার গতিপথ নির্মাণে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সামনে এগিয়েছে। সাময়িকভাবে উন্নয়নের চাকা ধীর হয়েছে। তাই বলে থেমে থাকেনি। আর এর পুরো কৃতিত্বই সাধারণ মানুষের। রাষ্ট্রপিতা স্বাধীন বাংলাদেশে যে শোষণহীন ক্ষুধামুক্ত ও অগ্রসর গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন, আজকের বাঙালি ও বাংলাদেশের নাগরিকরা তার সে স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দিতে এক নবতর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তারই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
আমাদের জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার মহানায়কের জন্মদিনে তার প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
সৌজন্যেঃ আমাদের সময়