তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎঃ হাসান আজিজুল হক

5045

Published on মার্চ 17, 2018
  • Details Image

কৈশোরে মাঝেমধ্যে বর্ধমান শহরে যেতাম। মুসলিম লীগের দু'জন নেতা আবুল হাশিম ও টকু সরকার, এদের কাছে। কলকাতায় দাঙ্গা যখন শুরু হলো, তখন আবুল হাশিমের অফিসে বসে অনেক নেতার কথাই শুনতাম। তার কাছেই মুজিব বলে এক যুবকের কথা শুনেছি। এই মুজিবই পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সময় তার কথা প্রথম জানতে পারি আমি। দেশভাগের পর ১৯৫৪ সালে আমি বাংলাদেশে আসি। তখনও শুনতে পাই তার কথা।

কলেজের ছাত্র হিসেবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমরা তখন মওলানা ভাসানীর সমর্থক। পাকিস্তানকে সমর্থন করার কারণে আমরা ঠিক সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সমর্থন করতে পারি নাই তখন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পর প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব নিয়ে আবির্ভূত হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বলা যায়, একেবারে সঠিক সময়ে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা; ছাত্রদের এগারো দফাও এ সময়ে ঘোষিত হলো।

ছয় দফাতে শেখ মুজিবুর রহমান জোর দিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের ওপর। ছয়টি দফাতেই শোষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কাঠামো গড়ে তোলার কথা ছিল। ছয় দফা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ভাসানীর প্রভাব কমে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই তখন প্রধান নেতা। পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা সাংঘাতিকভাবে শোষিত জনগণ চাইছিল মুক্তি। ছয় দফা ও এগারো দফা তাদের মুক্তির পথ- শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে এটা বোঝাতে পেরেছিলেন।

ধর্মের দোহাই দিয়ে কী করে অনেকখানি দূরত্বে অবস্থান করা দেশ-অঞ্চল একটি দেশ হয়ে থাকবে, সেটা আমাদের বোধগম্য হয়নি। ধর্ম এক হলেও এ দুটি অংশ- পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান বৈপরীত্য ছিল ভাষা। ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ। এ দুটি অঞ্চলের মধ্যে কোনো মিলও ছিল না। এসব থেকে আলাদা রাষ্ট্র-কাঠামোর যে দাবি, সেটা সাধারণের মনের কথা হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেতারের যে জায়গায় আঘাত করলে সঠিক আওয়াজ উঠে আসে, বঙ্গবন্ধু করেছিলেন সেই কাজ।

শেখ সাহেবকে তখন দেখেছি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে। তার নেতৃত্বের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম; দাবি করব যে অংশীদারও ছিলাম। বিরাট ঝড় দেখা দিলে সবকিছু যেমন সামনে থেকে হেলে পড়ে; শেখ সাহেবের কথায় জনগণও সেভাবে হেলে পড়ল। আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল দেখা দিল। জনগণ তাকেই নায়ক বলে মেনে নিল। তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হলো। '৬৯ সালের গণআন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা দিল তখন। '৭০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনোভাব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইঙ্গিত দিয়েছিল। ফলে '৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিলেন :'এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' এই কথা সম্পূর্ণভাবে জনগণের মনের কথা ছিল। এরপরই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৭৩ সালের গোড়ার দিককার কথা। ১০ মিনিটের মতো সামনাসামনি বসেছিলাম তার। আর দূর থেকে দেখেছি বহুবার। বিশালদেহী সুপুরুষ এই মানুষটির উপস্থিতিতে কিছু একটা তৈরি হতো, যার মাধ্যমে তিনি সরাসরি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতেন।

আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। মহান এই মানুষটি বাংলাদেশ-সংক্রান্ত প্রায় সব আন্দোলনের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। সেই মানুষটি আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেছেন। এককথায় বলা চলে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মের অঙ্কুরোদ্গমও হয়েছিল মূলত আজকের দিনেই। কারণ তার আহ্বানে, তার নেতৃত্বেই তো এসেছে স্বাধীনতা। সেদিক থেকে চিন্তা করলে অবশ্যই আজকের দিনটি বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ দিনই বটে।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ আমি নিজ চোখে দেখেছি। কী নারকীয় তাণ্ডব, কত রক্ত, কত হত্যা, কত ত্যাগ; সেটা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। অনেক কিছুর বিনিময়ে পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা, আজকের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। একজন পূর্ণাঙ্গ নেতার যত রকম গুণ থাকা দরকার, সেসব গুণ ছিল তার মধ্যে। সরল মনে মানুষকে খুব সহজেই বিশ্বাস করতেন। আর এ কারণেই তাকে অকালেই জীবন দিতে হয়েছিল। যার নেতৃত্বে একটি দেশের অভ্যুদয়, তাকে দেশবিরোধীদের অস্ত্রে নির্মম হত্যার শিকার হতে হলো। 

আজ ১৭ মার্চ, এই মানুষটির জন্ম। তার জন্মের মধ্য দিয়েই লেখা হয়েছিল একটি দেশের জন্মের ইতিহাস। এই দিনটিকে গোটা দেশের মানুষের পালন করা উচিত বলে মনে করি।

সৌজন্যেঃ সমকাল

প্রকাশকালঃ ১৭ মার্চ, ২০১৮

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত