আজ সেই মহান পুরুষের জন্মদিন, যাঁর নামের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালীর আত্মপরিচয়। তিনি সেই মহান পুরুষ, যাঁকে নিয়ে বাঙালীর অহঙ্কার কোনদিন ফুরোবে না। এমনই বিশাল ব্যক্তিত্ব তিনি, মৃত্যুর চার দশক পরও তাঁকে আবিষ্কার করতে হয় নতুন করে। বাঙালী গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করে তাঁর নাম। বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাঙালী জাতিকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন অসম্ভবের পথ। মানুষকে, দেশের জনগণকে তিনি বিশ্বাস করতেন। মানুষও তাঁর সেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন। শৈশব থেকেই তিনি প্রতিবাদী, মমতাময়। শৈশবেই পরিচয় দিয়েছেন নেতৃত্বের। নেতৃত্বের গুণেই বাঙালীর মননের প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। কৈশোরেই শুরু কারাবাস। ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন তিনি। কলকাতা থেকেই গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবে খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে রাজনীতির সূচনা করেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের নেতা। আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জন এই স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই সংগ্রামে তিনি ছিলেন নেতা। তাঁর নামে পরিচালিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধ তো একদিনের ব্যাপার নয়। হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে একটি যুদ্ধের জন্য, একটি ভূখ-ের স্বাধীনতার জন্য, স্বতন্ত্র জাতিসত্তার জন্য তৈরি করতে হয়েছে। রাজনৈতিক প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। জাতিকে তৈরি করতে হয়েছে রাজনৈতিক কর্মকা-ের ভেতর দিয়ে। যে বাঙালী স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরে নিজেদের মতো করে, সেই বাঙালীকে সংগঠিত রাখার কঠিন কাজটি বঙ্গবন্ধু করেন দক্ষ হাতে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটায় হক, ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা বাঙালীর এই বিজয়কে মেনে নিতে না পেরে ৯২-ক ধারা জারি করে সরকার অপসারণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলের একটি কনভেনশনে বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মুক্তি সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। ঐ ৬ দফা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়। শেখ মুজিবের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে জেনারেল আইয়ুব খান একটার পর একটা মামলা দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফার পক্ষে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। সেই সময় রাজনীতির প্রধান আলোচিত বিষয় হয় ৬ দফা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সঙ্গীদের নামে আইয়ুব খান তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় গোটা বাঙালী জাতি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালী তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে আনে। বাঙালী জাতি তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে। এর পর যে ইতিহাস রচিত হলো, সে ইতিহাস সবারই জানা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালীর ভবিষ্যত নির্ধারিত হওয়ার পর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি জাতিকে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শামিল হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন-
‘ভাইয়েরা আমার,
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।
কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলব, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস।’ তাঁর বক্তৃতায় উঠে আসে বাংলার বঞ্চনার কথা।
তাঁর জাদুকরি সম্মোহনী শক্তিই বাঙালী জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল গুলির সামনে বুক পেতে দিতে। তিনি বরাভয় দিয়েছিলেন বলেই ভয় পায়নি জাতি। ইতিহাসের সেই বরপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের জাতির জনক।
আজও তিনি আমাদের প্রেরণার উৎস। আমাদের সত্তায় মিশে আছেন তিনি।
কবি শামসুর রাহমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন,
‘ওরা তাঁকে হত্যা করে ভেবেছিল তিনি
সহজে হবেন লুপ্ত ঊর্ণাজাল আর ধোঁয়াশায়,
মাটি তাঁকে দেবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে-
কিন্তু তিনি আজ সগৌরবে
এসেছেন ফিরে দেশপ্রেমিকের দীপ্র উচ্চারণে,
সাধারণ মানুষের প্রখর চৈতন্যে,
শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে, কবির ছন্দের
আন্দোলনে,
রৌদ্র ঝলসিত পথে মহামিছিলের পুরোভাগে।’
বঙ্গবন্ধু আজও আমাদের চেতনার উৎস। তাঁকে হত্যা করে বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দেয়া যায়নি। বরং বঙ্গবন্ধু আজও আমাদের আদর্শ। বাঙালীর চেতনায় তিনি স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল।