8302
Published on ফেব্রুয়ারি 27, 2018[২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ ভাষণটি হুবহু মুদ্রিত হলো]
আমি আমার বক্তব্যের প্রথমেই, আমি শ্রদ্ধা জানাই মহান ভাষা আন্দোলনে সেই সকল শহীদ, যাঁরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমাদেরকে মা বলে ডাকার অধিকার দিয়ে গেছে। শহীদ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিকসহ আমাদের শহীদ, যাঁদের মহাত্যাগের বিনিময়ে আজকে বাংলা ভাষায় কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি। আমি শ্রদ্ধা জানাই আমাদের মহান নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি; যিনি বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং যাঁর আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছি, স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ পেয়েছি। আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি, আমাদের জাতীয় চার নেতা এবং ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনকে।
জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহর ১২.০১ মিনিটে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে তিনি তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, আমি “১৯৫২ সালের আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।” জাতির পিতার এই মহামূল্যবান বক্তব্য থেকে এসে যায়, যে আমাদের ভাষা আন্দোলন আমাদের পথ দেখিয়েছিল আমাদের জাতিসত্ত্বা প্রকাশের সংগ্রামের এবং যখন পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রটা সৃষ্টি হয় এবং যখন ব্রিটিশরা ভারতে দুটি রাষ্ট্র তৈরি করে গেল, একটা পাকিস্তান, একটা ভারতবর্ষ। ঠিক সেই সময় নানা আলোচনা শুরু হয়। আর তখন থেকেই ভাষার বিষয়টা উঠে আসে।
আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ এবং আলোচকবৃন্দের কাছে আপনারা শুনেছেন যে, কিভাবে, কি করে এই ভাষার জন্য অনেকেই তার লেখনির মাধ্যমে বাংলাকে মর্যাদা দেবার কথা বলে গেছেন। কিন্তু যখন ’৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে একটা সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল। সেই সাহিত্য সম্মেলনে ঘোষণা দেয়া হলো যে, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। তখনি কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, কয়েকজন ছাত্র মিলে মিছিল করে তখনকার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে তারা গিয়েছিল এটার প্রতিবাদ জানাতে। সেখানেও কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন, তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। এবং সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একটি সভা ডাকলেন। তমুদ্দুন মজলিসসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠন তারা মিলে সিদ্ধান্ত নিল ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের এবং ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে ১১ই মার্চ ঘোষণা দেয়া হলো। ১১ই মার্চ এই ঘোষণা দিয়ে, সেই দিন ধর্মঘট ডাকা হয়। এবং তারই পূর্বে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তিনি (বঙ্গবন্ধু) ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রলীগ নামে একটি সংগঠনও গঠন করেছিলেন। এবং সেই ছাত্রলীগকে দিয়েই কিন্তু সংগঠন, মানে ভাষা আন্দোলনের যাত্রা শুরু এবং এই ১১ই মার্চ এ ধর্মঘট করতে গিয়ে আমাদের তখন অনেক নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হন, সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও ছিলেন। এমনকি আমাদের এখানে দীপুমনির বাবা ওদুদ সাহেবসহ আমাদের আওয়ামী লীগের অনেক নেতৃবৃন্দ প্রায় ৭০ জনের মতো তখন গ্রেফতার হয় অথবা পুলিশের লাঠির বাড়িতে আহত হয়।
এরপর নাজিমুদ্দিন সাহেব একটা যোগাযোগ করে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনা হয় এবং তিনি ওয়াদা দিয়েছিলেন যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটা তিনি পার্লামেন্টে তুলবেন এবং মেনে নেবেন। এবং ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের দাবিগুলো মেনে নেয়ার ফলে সকলে আবার ১৫ তারিখে সন্ধ্যায় মুক্তি পান।
১৬ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা, এই আমতলা এখন আমাদের যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ তার যে আউটডোর এটাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর সেখানেই ছিল আমতলা এবং সেখানে একটা সভা হয়। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং সেখানে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণ দেয়া হয়।
আর এই সংগ্রাম করতে গিয়ে বারবার কিন্তু তিনি গ্রেফতার হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন মুক্তি পেয়েছেন। কারণ সংগ্রাম পরিষদ তখন সমগ্র দেশে ছড়িয়ে যায়। এই রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে যাতে জনমত সৃষ্টি করা এবং সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য এবং এরই একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ফরিদপুরে যেয়েও গ্রেফতার হন, আবার মুক্তি পান। বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, মুক্তি পেয়েছেন। পরবর্তীতে ঢাকায় তিনি ’৪৯ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকায় একটি ভুখা মিছিল হয়। তখন লিয়াকত আলী খান পূর্ববঙ্গে আসার কথা, সেই সময় এই আন্দোলনে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে গেলেন। তারপর কিন্তু অনেকে মুক্তি পেয়েছে কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তি পাননি। কিন্তু কারাগারে থেকেও তিনি যখনি কোর্টে অথবা চিকিৎসার জন্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আসতেন তখনি কিন্তু তিনি ছাত্রনেতাদের সাথে সাক্ষাত করতেন। এই সাক্ষাতকারের একটা পর্যায়ে, তিনি ছাত্রলীগের তখন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নইমুদ্দীন সাহেব এবং খালেক নেওয়াজ, তাঁদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করে এবং ঐ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যে একুশে ফেব্রুয়ারি তখন প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট সেশন বসবে, তখন পার্লামেন্ট বসত জগন্নাথ হলের যে হলটা ভেঙ্গে পড়ে গিয়েছিল, আপনাদের মনে আছে অক্টোবর মাস ১৫ই অক্টোবর, ঐটাই ছিল মূলত তখন প্রাদেশিক পরিষদের মানে সংসদ ভবন, ওখানেই তখন বৈঠক হত। যেহেতু ওখানে বৈঠক হবে, ছাত্রদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে সেই ধরনের নির্দেশনা দেন এবং সেই সাথে সাথেই একটা সংগ্রাম পরিষদ আবার গঠন করা হয় ’৫২ সালে এবং সেখানে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যেন সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়, সে নির্দেশনাও তিনি দিয়েছিলেন।
কাজেই এভাবেই তিনি ঐ বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তাঁর দাবি আদায়ের জন্য অনশনে যাবেন এবং ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি অনশন করা শুরু করেন, তাঁর সঙ্গে আমাদের ন্যাপে মহিউদ্দিন সাহেব (তিনিও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের) অনশন করেন। অনশনরত অবস্থায় তাঁকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। যখন তাঁকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যায় ঐ সময় স্টিমার এখানে ওয়াইজঘাট থেকে স্টিমার ছাড়ত, নারায়ণগঞ্জে স্টিমার থামত, তিনি আগেই খবর দিয়েছিলেন যে নারায়ণগঞ্জের নেতৃবৃন্দ যেভাবে হোক ওনার সঙ্গে যেন দেখা করে। সেখানেও তিনি বসে তাদেরকে চিরকুট পাঠান এবং অনেকের সাথে সাক্ষাত হয়, সেখানেও নির্দেশ দিয়ে যান যে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
ভাষার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে, সেই নির্দেশনাও তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন। কাজেই এইভাবেই তিনি এই আন্দোলনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কারাগারে বসেও কিন্তু এই আন্দোলন সম্পর্কে সব সময় সচেতন ছিলেন।
’৫২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি যখন মিছিল বের হয়, সেখানে গুলি চলে এবং আমাদের শহীদরা রক্ত দিয়ে এই ভাষা আন্দোলনকে একটা জায়গায় নিয়ে যান। অথচ সেই ’৪৮ সাল থেকে আন্দোলন শুরু ’৫২ সালে এসে বুকের রক্ত দিয়ে রক্তাক্ষরে ভাষার অধিকারের কথা আমাদের শহীদরা লিখে গিয়েছেন।
এরপর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন হয়। নির্বাচনে তখন যুক্তফ্রন্ট একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, তাঁরা সকলে মিলে যুক্তফ্রন্ট করেন। সেই যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলেও সেই সরকার বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। কারণ পাকিস্তানী কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে নানারকম চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র করে এবং সেই সরকার বাতিল করিয়ে ৯২/ক ধারা দিয়ে সেখানে এমারজেন্সি ডিক্লেয়ার করে, আবার সবাইকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবার গ্রেফতার হন।
এরপর ’৫৬ সালে এসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখন সোহরাওয়ার্দী সাহেব, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। সেখানে অনেক শর্ত মেনেই তাঁকে হতে হয়েছিল। যাই হোক, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়ে পাকিস্তানের জন্য প্রথম সংবিধান রচনা করে। পাকিস্তান রাষ্ট্র হবার পর কিন্তু আর এর পূর্বে পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হয়নি। এই সংবিধানে তখন উর্দুর সাথে বাংলাকে রাষ্ট্রাভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয় এবং সেটা আপনারা শুনেছেন যে, শর্তসাপেক্ষে। সেটা আমরা জানি। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আসার পরেই কিন্তু যে শাসনতন্ত্র পাকিস্তানে রচিত হয়েছিল, সেখানেই বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। আর সেই সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়, ছুটি ঘোষণা করা হয়, সরকারী ছুটি পালন করার জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে, প্রকল্প নিয়ে কাজও শুরু করে।
’৫৮ সালে আইয়ুব খান তখন মার্শাল ‘ল’ জারি করে। আইয়ুব খান ছিল পাকিস্তানের সেনাপ্রধান, তিনি একাধারে সেনাপ্রধান আবার সেই সাথে নিজেকে রাষ্ট্রপতিও ঘোষণা দেয়, ক্ষমতা দখল করে। আবার আমাদের ভাগ্যে নেমে আসে সেই অমানিশার অন্ধকার এবং বাংলাকে আবারও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। সেসময় আপনারা শুনেছেন, এর আগে আমি নিজেও বলেছি যে, বাংলা ভাষা চর্চা করা যাবে না, বাংলায় কথা বলা যাবে না। আবার কবিতাগুলোও, আপনারা কিছুক্ষণ আগেই শুনলেন যে, কবিতাগুলোকেও কি মুসলমানি ভাষা দিতে হবে; মানে ফযরে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি। সেটাকে করা হয়েছিল, ফযরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি, সারাদিন আমি যেন আচ্ছা হয়ে চলি। এমনকি কবি নজরুলের সেই কবিতা, সজীব করিব মহাশশ্মান, এই মহাশশ্মান থাকতে পারবে না, সেখানে বসানো হল গোরস্থান। আর রবীন্দ্রনাথ পড়া যাবে না, রবীন্দ্রনাথ বন্ধ করে দেয়া হলো। রবীন্দ্র সংগীত শোনা যাবে না, রবীন্দ্রনাথ পড়া যাবে না। আমার মনে আছে, আমাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরা, রফিক স্যার এখানে উপস্থিত আছেন, তখন কিন্তু সমস্ত শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই সময়, আমাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টের যিনি হেড ছিলেন হাই স্যার, তাঁকে ডেকে নিয়ে মোনায়েম খান, মোনায়েম খান খুব বিরক্ত, কারণ এখানে আন্দোলন কেন চলবে? রবীন্দ্রনাথ তাকে বাদ দেয়া হয়েছে, তাতে কি আছে? রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কি চলে না ভাষা? কাজেই সেই দিন থেকে নজরুলের কবিতাকে মুসলমানি শব্দ দেয়া হচ্ছে, আর রবীন্দ্রনাথ একেবারে বাতিল। এই হলো তাদের মানসিকতা। তো সেখানে দেখা গেল যে যখন হাই স্যারকে ডেকে মোনায়েম খান সাহেব বলল যে, কি মিয়ারা আপনারা বসে খালি রবীন্দ্র সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত করেন ২/৪ খান রবীন্দ্র সংগীত নিজে লিখে ফেলতে পারেন না। উনি (হাই সাহেব) খুব ভদ্র লোক ছিলেন, খুবই নেহাতই ভদ্র মানুষ। আমি যখন ভর্তি হই, তখন উনি বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন। উনি খুব বিনয়ের সাথে বলেছিলেন যে, স্যার, আমরা তো লিখতে পারি কিন্তু সেটাতো রবীন্দ্র সংগীত হবে না, আমি লিখলে ওটাতো হাই সংগীত হয়ে যাবে। এইভাবে আমাদের ভাষার উপর বারবার আঘাত এসেছে।
এই আঘাতটা কিন্তু সেই আমাদের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত, বারবারই আমরা দেখেছি। কখনও রোমান হরফে বাংলা লিখতে হবে, কখনও আরবী হরফে বাংলা লিখতে হবে। এভাবে বারবার এক-একটা সমন জারি হয়েছে আর আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু সবসময় আন্দোলন করেই গেছে এর বিরুদ্ধে। কারণ প্রত্যেকটা অর্জনই কিন্তু সংগ্রাম করে, আন্দোলন করে আমাদেরকে অর্জন করতে হয়েছে। প্রত্যেকটা অর্জনের পেছনে আমাদের কিন্তু অনেক ত্যাগতিতিক্ষা রয়েছে।
জাতির পিতা যে কথাটা বলেছিলেন, যে আমাদের ভাষা আন্দোলন এটা শুধুমাত্র যে ভাষার জন্যই তা নয়; এখানে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ আন্দোলন ছিল। এই ধারাবাহিকতায় কিন্তু জাতির পিতা একটা জাতিকে ধীরে ধীরে আন্দোলনের পথ বেয়ে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি যে ৬ দফা দিয়েছিলেন, সেই ৬ দফা ছিল বাঙালী জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সোপান। এটা পাকিস্তানীরা বুঝতে পেরেছিল, যে কারণে ৬ দফা দেবার সাথে সাথে তাঁকে গ্রেফতার করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাঁকে ফাঁসি দিয়ে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু এখানে আমাদের ছাত্রসমাজ, দেশের জনগণ ব্যাপক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটিয়েছিল এবং বাধ্য করেছিল এই মামলা প্রত্যাহার করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে। মুক্তিটা তখন তিনি পেয়েছিলেন ’৬৯ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি।
আমি জানি না, উনার জীবনীটা পড়লে খুব অদ্ভুত লাগে। ’৫২ ভাষা আন্দোলনের যে সংগ্রাম তিনি ’৪৮ সাল থেকে শুরু করলেন এবং একের পর এক গ্রেফতার হলেন। এরপরে যখন ’৪৯ সালে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন তারপর কিন্তু আর মুক্তি পান নাই। ’৪৯, ৫০, ৫১ এরপর ’৫২ সালে যেয়ে ২৭ শে ফেব্রুয়ারি যখন তিনি অনশনরত অবস্থায় প্রায় মৃতপ্রায়, তখন তিনি ২৭ শে ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান।
আবার ’৬৯ সালে যখন তাকে গ্রেফতার করা হলো, তারপর তিনি মুক্তি পেলেন ২২ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ সালে। ’৬৬ সালে গ্রেফতার করা হয়, ’৬৬ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল, তাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দেয়া হলো এবং অনেক সাজাও দেয়া হলো। তারপর ’৬৮ সালে ১৮ই জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো। ১৮ই জানুয়ারি যখন নিয়ে যাওয়া হয়, আমরা পরিবারের কেউ জানি না কোথায় নিয়ে গেছে, কেমন আছেন, বেঁচে আছেন কিনা? কোন খবরই আমরা পায়নি। যখন আগরতলা মামলা শুরু হয়, ঐ কোর্টে প্রথম দেখা। কাজেই, এভাবে বারবার যে আঘাত এসেছে, তারপরও তিনি কিন্তু একটা নীতি নিয়ে, আদর্শ নিয়ে, বাঙালী জাতির স্বাধিকার আদায়, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কিন্তু সংগ্রাম করে গেছেন। আর সেই সংগ্রামের পথ বেয়েই আজকে আমরা এই বাংলাদেশে, স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি।
তাঁর যে ঐতিহাসিক ভাষণ ৭ই মার্চের, যে ভাষণ আজকে বিশ্ব ঐতিহ্য প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে, সেটা বাঙালী জাতি আজকে মর্যাদা পেয়েছে। বাঙালী জাতির জন্য এটা গৌরবের। কাজেই যা কিছু অর্জন আমাদের করতে হয়েছে, সংগ্রামের পথ বেয়েই করতে হয়েছে।
স্বাধীনতার ঘোষণা তিনি দিলেন সাথে সাথে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো। যাহোক, তারপর তিনি মুক্তি পেলেন, আমরা বিজয় অর্জন করলাম ’৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। এরপরে জাতির পিতা মুক্তি পেলেন ৮ জানুয়ারি ’৭২ সালে, ১০ই জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশে ফিরে এলেন। তো ফিরে এসে যে কাজটি তিনি করেছেন যে, একটা প্রদেশ ছিল তাকে একটা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং স্বাধীনতার সুফল যেন বাংলাদেশের মানুষের ঘরে পৌঁছায় এবং একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলা, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় তিনি হাতে নিলেন। মাত্র সাড়ে ৩ বছর সময় পেলেন, এই সাড়ে ৩ বছরের মধ্যেই একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথে নিয়ে যাওয়া। এবং ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে, একদম মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা তিনি নিয়েছিলেন। যাতে অর্থনৈতিক উন্নতিটা দ্রুত হয় এবং বাঙালী জাতি যেন বিশ্ব সভায় একটা মর্যাদার আসন পায়। ঠিক যখন এই অর্থনীতিক অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আওতায় চলে এসেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চলতে শুরু করেছে, দেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের, দেশের মানুষের ভিতরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে এবং ঐ যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠে যখন অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ এটা খুব কঠিন একটা কাজ ছিল, সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটি মানুষ ছিল শরনার্থী। ৩ কোটি মানুষ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর, আলবদর, রাজাকার, আলশামস ও যুদ্ধাপরাধী, যারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে ছিল, তারা পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে গেছে। এই বাংলাদেশে তারা পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিল, তারা মানুষ চায়নি তারা খালি মাটি চেয়েছিল। এইভাবে তারা গণহত্যা চালিয়েছে, আগুন দিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়েছে। ৩ কোটির উপর মানুষ গৃহহারা ছিল, তার উপর প্রতিটি শহীদ পরিবার, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং আমার লাঞ্ছিত মা-বোন; তাদের পুনর্বাসন, চিকিৎসা সব ব্যবস্থায় কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি (বঙ্গবন্ধু) করেছিলেন।
সব থেকে বড় কথা, মিত্র শক্তি ভারতের সেনাবাহিনী যারা আমাদের সাথে ছিল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, অনেক রক্ত ঝরেছে, কিন্তু সেই মিত্রশক্তিকেও ফেরত পাঠিয়েছিলেন। জাতির পিতার অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধী তাদেরকে ফেরত নিয়ে যায়। আমরা দেখেছি যখন বাংলাদেশ একটু অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী তখন কিন্তু ’৭৫ সালে আমরা আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ ভাগ পর্যন্ত অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য, যে ঠিক তখনি আঘাতটা আসল, জাতির পিতাকে নির্মম ভাবে হত্যা করে এবং গোটা পরিবারকে একই সাথে ৩টা বাড়ি আমার মেজো ফুপু, সেজো ফুপু, ছোটো ফুপু প্রত্যেকের বাড়িতে আক্রমণ করল, প্রতিটি বাড়ির সদস্যকে হত্যা করল এবং এরপরে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করল। তারপর আপনারা ধীরে ধীরে নিজেরাই শুনেছেন, প্রত্যেকটা জিনিসের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন হয়ে গেল। ঠিক পাকিস্তানী ভাবধারায় আবার এই নামগুলো পরিবর্তন করে এবং ৭৫ এর ১৫ই আগস্টের পর প্রথম যে ঘোষণা, সেখানে কিন্তু বাংলাদেশকে ঐ ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে এক পর্যায়ে ঘোষণা দিয়েছিল। তারপর যখন বুঝল যে, এটা মানুষ গ্রহণ করবে না, তখন আর ও কথা দ্বিতীয় বার উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু প্রথম ঘোষণাটা ওভাবে এসেছিল অর্থাৎ এটাকে যেন পাকিস্তানের একটা প্রদেশ বানাবারই একটা প্রচেষ্টা হয়েছিল।
এরপর ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি এবং যারা এসেছিল তারা তো অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখলকারি। তারা ঐ আইয়ুব খানের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই ক্ষমতায় এসেছে এবং দেশকে তারা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে না, বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, বাংলাদেশ যে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন করেছে, সেই বিজয়ী মনোভাবটাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া এবং পরাজিত যেই শক্তিকে আমরা পরাজিত বললাম, ঐ তাদেরই প্রতি খোষামোদী, তোষামোদী চাটুকারিতা আমরা দেখেছি। তাদের দেখলেই যেন বেহুঁশ হয়ে পরার মতোন অবস্থা ছিল, যারা ক্ষমতায় ছিল।
যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জাতির পিতা শুরু করেছিলেন, সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মার্শাল অর্ডিন্যান্স দিয়ে বন্ধ করে তাদেরকে মুক্ত করে তাদের দল করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল।
অনেকেই যখন বলেন যে, জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়েছিল। তাদের বহুদলীয় গণতন্ত্র মানেই তো ঐ যুদ্ধাপরাধীদের দল করার সুযোগ করে দেয়া, যাদের সাজা হয়েছিল তাদের মুক্ত করা। কাউকে প্রধানমন্ত্রী, কাউকে মন্ত্রী, কাউকে উপদেষ্টা, তাদের হাতে আমার লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তুলে দেয়া। জাতির পিতার হত্যাকারী তাদেরকে বিচার না করে পুরস্কৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়া। কি দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বা দূতাবাসে কর্মরত তাদের পরিচয় কি? তাদের পরিচয় হচ্ছে, যার নেতৃত্বে এ স্বাধীনতা সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকারী, খুনী। আমার মনে আছে, পোল্যান্ডে যখন পাঠানো হয় একজন খুনীকে, পোল্যান্ড সরকার তাকে গ্রহণ করে নাই। বলেছিল শেখ মুজিবের হত্যাকারীকে আমরা এখানে কোন পদে আসতে দেব না। কাজেই, আমরা দেখেছি যে কিভাবে দেশের ভাবমূর্তি সারা বিশ্বে নস্যাত করে দেয়া হয়েছিল।
২১ বছর পর আমরা সরকারে আসি। আমরা আসার পর আমরা প্রচেষ্টা চালিয়েছি দেশের উন্নয়নে এবং আজকে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সেই প্রস্তাবটা যখন করা হয়েছিল, আপনারা শুনেছেন যে, সালাম আর রফিক, তারাই আরো কয়েকটি দল-দেশের প্রতিনিধি মিলে ঐ যে ভালবাসি মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা যখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রস্তাব নেই এবং সেখানে ১৭ই নবেম্বর ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোতে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। আজকে আমরা যখন ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, পৃথিবীর বহু দেশের বহু জাতির মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। কাজেই সেই মাতৃভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করা, সেই মাতৃভাষা গুলির চর্চা করা, মাতৃভাষা গুলির নমুনা রাখা এবং একটা ভাষা জাদুঘর, আমরা কিন্তু সেই জাদুঘর তৈরি করেছি। এই প্রতিষ্ঠানটা আমি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গেছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, বিএনপি ক্ষমতায় এসে আমার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আর তারা তৈরী হতে দেয়নি, সেখানেই বন্ধ করে রেখেছিল। আমি ২০০৯ সালে সরকারে আসার পর আবার সেটা প্রতিষ্ঠা করি। কাজেই একদিক দিয়ে বোধহয় ভাল, কারণ আমি এসে আমার হাতে শুরু ছিল, আবার আমরা এসেই সেটাকেই প্রতিষ্ঠা করেছি। আজকে সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন মাতৃভাষা আমরা সংগ্রহ করছি, সেখানে গবেষণার সুযোগ আছে এবং হারিয়ে যাওয়া ভাষাগুলোকেও আমরা এখানে সংরক্ষণ করছি। ভাষা জাদুঘর একটা আমরা তৈরি করে দিয়েছি। মনে হয়, বাংলা সারা বিশ্বব্যাপী আজকে বাংলাদেশীরই আজকে দায়িত্ব পড়েছে মাতৃভাষাকে সংরক্ষণ করার।
মাতৃভাষায় শিক্ষা আমি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কাছে জানলাম যে, আমরা সাবসিডিয়ারি হিসেবে একটা মূল সাবজেক্ট আমরা নিই অথবা অনার্স আমরা নিতাম। কিন্তু সাথে সাথে ২টি বিষয় আমরা সাবসিডিয়ারি নিই। আমি বিষয়টি জানতাম না যে, বাংলাকে আমরা যখন অনার্স করতাম তখন বলত সাবসিডিয়ারি এখন বলে মেজর অর মাইনর। কিন্তু বাংলা ভাষা নাকি শেখা যায় না, নেয়া যায় না। এটা আমি জানি না, আমার মনে হয়, এ বিষয়ে ইউজিসির সাথে, বা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আলোচনা করতে হবে, যে এটা কেন? বাংলা ভাষার প্রতি এই অবহেলা কেন?
আর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আমরা ব্যাপকহারে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছি, কিন্তু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শিক্ষা হবে না, বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে কোন শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে না, এটাতো হতে পারে না। এটা কেন হবে? আরেকটি বিষয় খুব সঠিকভাবে বলে যাই, মাত্র কিছুদিন আগে আমাকে একজন একটা বিয়ের কার্ড দিলেন, বিয়ের কার্ডটা পরে আমি খুব খুশী হলাম এবং তাকে ধন্যবাদও জানালাম। তিনি আমাদের সচিব ছিলেন। আমি ধন্যবাদ জানালাম এজন্য যে, তার বিয়ের কার্ডটা বাংলা ভাষায় রচনা করেছে এবং সেটা এনে দিয়েছে। নইলে এটা ঠিকই, আমাদের স্যার যে কথা বলেছেন বা সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সাহেব যা বলেছেন একথা সত্যি, প্রত্যেকটা বিয়ের কার্ড হয় ইংরেজি ভাষায়। আমি ঠিক জানি না, কেন হয়? অনেকে যখন নিয়ে আসত আমি জিজ্ঞেস করতাম যে, কেন, ইংরেজি ভাষায় কেন? কিসের জন্য এই দাওয়াতের কার্ড বা বিয়ের কার্ড কেন ইংরেজি ভাষায় লিখতে হবে কেন? এটার সাথে আমি ঠিক জানি না, কোন মর্যাদার কোন বিষয় আছে কিনা, সেটাও আমি বুঝি না! কিন্তু ইংরেজি ভাষায় লেখে। এটা কিন্তু ব্যাপকভাবে মনে হয় যেন এটা একটা ব্যাধির মতো ছড়িয়ে গেছে। হ্যাঁ, যদি কোন ইংরেজি ভাষাভাষির জন্য যদি তৈরি করত তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমরা বাংলা ভাষায় লিখব না কেন? দাওয়াতের কার্ডটা লিখতে পারি না কেন? এই দৈন্যতা কেন দেখাতে হবে? এটা আমিও বুঝি না।
আজকে আমার শ্রদ্ধেয় স্যার রফিক সাহেব এবং শ্রদ্ধেয় আমাদের সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সাহেব যে কথাগুলো বলেছেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা, তারা বলে গেছেন। আমরা চেষ্টা করব যে, এ কথাগুলো আমি নোট করে নিয়েছি, যে এগুলো কিভাবে সুরাহা করা যায়, তার কিছু কিছু আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব, আমাদের নিতে হবে।
অন্য ভাষা শিখার বিপক্ষে কিন্তু আমরা না, ভাষা শিখতে হবে। আজকে সারা বিশ্বটা যেহেতু প্রযুক্তির প্রভাবে, আজকে বিশ্বটা কিন্তু এক হয়ে গেছে। সেই জন্য বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখতে গেলে আমাকেও অন্য ভাষা শিখতেই হবে। কিন্তু অন্য ভাষা না শিখতে পারলে আমরা উন্নত হতে পারব না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ জাপানিজরা কিন্তু জাপানিজ ভাষায় কথা বলে বলে তারা সারা বিশ্বে এক সময় সব থেকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলেছিল, তারা কিন্তু সব সময় নিজের ভাষায় কথা বলত। এখনও কিন্তু জাপানিজ ভাষাই তারা ব্যবহার করে। তবে ভাষা শেখার ব্যাপারে আমি একেবারে বিরুদ্ধে না, যে যত বেশি ভাষা শিখতে পারবে, অবশ্যই আমরা চাই। আমি এটাই চাইব, যে আমাদের দেশে যেমন ইংরেজি এখন একটা আন্তর্জাতিক ভাষার মাধ্যম হয়ে গেছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কিন্তু,এই ইংরেজি ভাষাটা এখন শিখছে, আগে যারা শিখত না তারাও শিখছে, তারাও কিন্তু এ ভাষার চর্চা করছে। এ ভাষায় কথা বলছে। হ্যাঁ, সেটা আমরা জানব। যখন আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথা বলতে হবে, আমরা বললাম। খুব ভাল কথা কিন্তু আমার নিজের দেশে ভাষার জন্য, আমাদের ভাষা শহীদদের রক্ত দিয়ে, রক্তের অক্ষরে মাতৃভাষার মর্যাদা দিয়ে গেছে, আমরা সেটা শিখব না কেন? আমরা সেটা বলব না কেন? বা আমরা সেটার চর্চা করব না কেন? সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন? সেটাই হচ্ছে মূল কথা? কাজেই, আমাদেরকে এ বিষয়টা দেখতে হবে, এই মর্যাদাটা আমাদের দিতে হবে, শুধু দিবসটা আসল পালন করলাম, তা না। ওনারা ঠিকই বলেছে, সাইনবোর্ডগুলো লেখা হয় আমরা ইংরেজি ভাষায়। বাংলা ভাষায় কিন্তু অনেক বিদেশী ভাষা আছে, অনেক শব্দ আছে আমরা কিন্তু শব্দগুলো গ্রহণ করে নিচ্ছি, আবার বাংলা ভাষার শব্দও কিন্তু আবার অন্য ভাষায় চলে গেছে, এটাও ঠিক। এটা যায়, এটা ভাষারই একটা নিয়ম, এই আদানপ্রদান এটা হয়। কিন্তু তারপরেও আমাদের দেশে অন্য ভাষায় কেউ দিতে চাইলে দিক, কিন্তু সেখানে মাতৃভাষা বড় করে লিখবে, অন্য ভাষাটা একটু ছোট করে আলাদাভাবে লিখুক, আমাদের আপত্তি নাই। মাতৃভাষার চর্চাটা তো থাকতে হবে, এটা তো একান্তভাবে অপরিহার্য বলেই আমরা মনে করি। যেমন কথা হচ্ছে উচ্চ আদালতের রায়, হ্যাঁ, উচ্চ আদালতের যখন রায় হয় তখন ইংরেজিতে লেখা হয়। আমাদের চেয়ে অনেক সাধারণ মানুষ আছে হয়ত ইংরেজি ভাল জানে না, তার যে উকিল সাহেব থাকে ঐ রায় পরে উকিল সাহেব যেটা বোঝায়, সেটাই তাকে বুঝতে হয়, সেটুকুই তাকে জানতে হয়। এখন উকিল সাহেব ভাল করে বললেন না, বুঝলেন বা এমন কথা বলে দিলেন যে, হয়ত তার পকেট থেকে আরো বেশি কিছু টাকা খসলো। অবশ্য আমি আশা করি, উকিল সাহেবরা কিছু মনে করবেন না। এখানে অনেক আবার আমাদের আইনজীবী আছে, তারা যেন কিছু মনে না করে। কিন্তু এটা কিন্তু বাস্তবতা। যে রায়টা পেলেন, এ রায়টা পাওয়ার পর এই সাধারণ মানুষটা তিনি তো নিজে পড়ে দেখে বুঝতে পারছেন না। তিনি যার উপর নির্ভর করছেন তিনি যেভাবে বলেছেন সেইটাই তাকে বলতে হচ্ছে। তাতে যদি তার কিছু পকেট খালি হয়, সেটাও হচ্ছে। কাজেই তাকে তো জানার আর বোঝার সুযোগটাও দিতে হবে, এদিকটাও তো বিবেচনা করতে হবে। তবে এখন যেমন নি¤œ আদালতে এখন ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বাংলা ভাষায় রায়ের। এখন উচ্চ আদালতেও, আমরা আশা করি যে ভবিষ্যতে, যে দীর্ঘদিনের একটা চর্চা চট করে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কিন্তু তাও, আমরা আশা করি, নিশ্চয়ই সেটা লিখবে, তা ঐ জিনিসটাই ভাষান্তর করা হোক, অনুবাদ করা হোক, অনুবাদের বিরুদ্ধে আমরা না। কিন্তু অন্ততপক্ষে বাংলা ভাষায় লিখলে পরে যারা অন্তত একটা ন্যায়বিচার চাচ্ছিল, তারা কি বিচার পেল, অন্তত সেটুকু তো তারা জানতে পারবে, সে সুযোগটা তো তারা পাবে। কাজেই এ চর্চাটা আমাদের থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে যে ,বাংলা ভাষায় কথা বলি কিন্তু এই বাংলা ভাষা এখন অনেকটা এখন ইংরেজি মানে ইংরেজি টোনে বলা, এক ধরনের কেমন যেন একটু বিকৃত করে বলার কেমন একটা চর্চা শুরু হয়ে গেছে। সেটা কেন, আমি জানি না।
কারণ, হ্যাঁ, যেমন আমাদের একটা অসুবিধা ছিল আমরা ’৭৫ এর পর দেশে ফিরতে পারে নাই। ৬টা বছর আমাদের বিদেশের মাটিতে থাকতে হয়েছিল। ছেলেমেয়েগুলো বিদেশেই তারা লেখাপড়া শিখতে বাধ্য হয়েছিল যেখানে বাংলা শেখার এতটুকু সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমি, রেহানা, আমরা, কিন্তু সব সময় চেষ্টা করেছি আমাদের ছেলে-মেয়েদের ঐ সীমিত অবস্থায় এবং হোস্টেলে পড়াশুনা করেছে, প্রতি সপ্তাহে বাংলায় চিঠি লিখতাম; আর ছুটিতে আসলে বাংলা শেখাতে চেষ্টা করতাম। যাতে করে অন্তত কিছুটা মাতৃভাষাকে তারা জানুক, তারা সুযোগ পাক। তারা বিদেশে লেখাপড়া শিখেও অন্তত যতটুকু বাংলা বলতে পারে বা যতটুকু শুদ্ধভাবে বলতে পারে, আমরা তো দেখি যে, বাংলাদেশে থেকে হয়তো বেশ ভালো একটু ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়ে তারাও যেন বাংলা বলতেই চায়না, বলতেই পারে না; বলতে গেলেও একটু বিকৃত করে বলে। সেখানেই খুব দুঃখ লাগে। আমরাতো বাধ্যতামূলকভাবেই আমাদেরকে বিদেশে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু যারা এখানেই মানুষ হচ্ছে, তাদের মধ্যেই এই বিকৃত থাকবে কেন? আমি আবারও বলছি আমি কিন্তু ভাষা শেখার পক্ষে, যতটুকু ভাষা শেখা যায়, আমরা নিশ্চয়ই সেটাকে স্বাগত জানাই; আমরা এটা চাই। আমি এটা মনে করি যে, আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদেরকে একবারে শুরু থেকেই যে ইংরেজি ভাষা ইংরেজি ভাষা দ্বিতীয় ভাষা। পৃথিবীর সব দেশেই এটা আছে, একটি মাতৃভাষা শিক্ষা আর একটি দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষা। এই দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ এখন দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ। এখন আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। গ্রামে বসেই আমার ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন দেশের ভাষা শিখে কিন্তু তারা অনলাইনে অনেক অর্থ উপার্জন করছে। সেই সুযোগটা সৃষ্টি করতে হবে কিন্তু সাথে সাথে যে ভাষা আমার মায়ের ভাষা, যে ভাষায় আমরা কথা বলি, যে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, সেই ভাষার চর্চাটা তো আমাদের থাকতে হবে। সে শিক্ষাটা পেতে হবে; সেটা পরিবার থেকে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ পরিবার থেকে না করলে কিন্তু এটা কখনই শেখা যায় না। কাজেই সেটাও আমাদের করতে হবে। কাজেই সেটাই আমরা চাই।
আজকে বাংলাদেশের কথা আমরা বলবো যে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আমরা যে কাজগুলো করেছিলাম, মাঝখানে আবার পথ হারিয়ে যায় বাংলাদেশ অর্থাৎ ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত। আমরা আবার সরকারে আসার পর, আজকে বাংলাদেশে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসগুলো আবার মানুষের সামনে তুলে ধরা, মুক্তিযুদ্ধের যে আত্মত্যাগের কাহিনী সেই কাহিনীগুলো বলা এমন একটা সময় দেখেছি যে, অনেকেই নিজে মুক্তিযোদ্ধা বলতে সাহস পেতেন না। একটি সরকারী চাকরি পাওয়া জন্য তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা, একথাটা লিখতে সাহস পেতেন না। কারণ তাহলে চাকরি পাবে না। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! ’৭৫ সালের পর জাতির পিতাকে হারাবার পর এই অবস্থা বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল, তখন ছিলো রাজাকারদের দাপট। অন্তত আজকে, ২০০৮-এর নির্বাচনে আমরা জয়ী হয়েছি, এরপর ২০১৪-এর নির্বাচন ঠেকাতে যেয়ে অগ্নিসন্ত্রাস করেও ঠেকাতে পারেনি। আমরা সরকারে এসেছি এই দীর্ঘ সময় ৯ বছর সরকারে থাকার পরে অন্ততপক্ষে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আজকে মানুষ গর্ববোধ করে, এখন আর ভীতসন্ত্রস্ত হয় না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসগুলো আবার সামনে এসেছে। মানুষ বলার সুযোগ পাচ্ছে, লেখার সুযোগ পাচ্ছে। অন্তত সেই আত্মবিশ্বাসটা ফিরে এসেছে। এই আত্মবিশ্বাসটা যেন হারিয়ে না যায়। এমন কোনো অন্ধকারে যেন আবার আমরা না পড়ি যে, আবার আমাদেরকে সেই অন্ধকারে চলে যেতে হবে, আবার মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে হবে, সেই পরিবেশ যেন ভবিষ্যতে আর কোন দিন বাংলার মাটিতে না আসে, সে ব্যাপারে সবাইকে আমি বলবো সচেতন থাকতে হবে। সবাইকে সচেতন থাকতে হবে, আবার যেন আমরা সেই ধরনের বিপদে না পড়ে যাই। কারণ যাদের হৃদয়ে পাকিস্তান, থাকে বাংলাদেশে, সবরকম আরাম-আয়েশ ফল ভোগ করবে এই দেশে, আর অন্তর আত্মাটা পড়ে থাকবে ঐ দেশে, আর তাদের জন্য আবার কাঁদে পাকিস্তান, পেয়ারে পাকিস্তান! কাজেই এই পেয়ারে পাকিস্তানওলাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষা করে চলতে হবে। এটাই আমার আবেদন থাকবে দেশবাসীর কাছে।
আমরা আমাদের ভাষা আন্দোলনের এই শহীদের রক্তের পথ বেয়েই কিন্তু লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ওই ১৫ আগস্টের খুনীদেরকেও পার্লামেন্টে ভোট চুরি করে বসানো হয়েছিল। আর স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী, যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার হয়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে, সাজা কার্যকর হয়েছে, তাদেরকে যারা মন্ত্রী বানিয়েছিল, আমার লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তাদের হাতে যারা তুলে দিয়েছিল, জাতি যেন কোনদিন তাদেরকে ক্ষমা না করে। সেটাই আমার জাতির কাছে আবেদন। যারা আমার মা-বোনকে রেপ করেছে, যারা গণহত্যা চালিয়েছে, অগ্নিসংযোগ করেছে, লুটপাট করেছে সেই যুদ্ধাপরাধী আর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে, তাদের বিচারের রায় আমরা কার্যকর করেছি। যারা এদেরকে মর্যাদা দিয়েছিল, যারা এদের হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিল তাদের ব্যাপারে জাতিকে সচেতন থাকতে হবে। তাদেরকে কিন্তু জাতি কোনদিন ক্ষমা করতে পারে না। ক্ষমা করবে না, জাতির কাছে আজকের দিনে আমার এটাই আবেদন থাকলো।
আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। আমি আশা করি যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আজকে জাতির পিতার নেতৃত্বেই এই বাংলাদেশ। আমরা নিম্নআয়ের দেশ হিসেবে একটা স্বীকৃতি পেয়েছিলাম, আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছি অর্থাৎ একধাপ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। বাঙালী জাতি আজকে মর্যাদা পেয়েছে। এই অগ্রযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে, শহীদদের প্রতি এটা আমাদের অঙ্গীকার যে, এই অগ্রযাত্রা আমরা অব্যাহত রাখবো। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য শেষ করছি।
সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ
প্রকাশিত : ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৮