1891
Published on ফেব্রুয়ারি 5, 2018প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য মিয়ানমারের প্রতি তাঁর আহবান পুনর্ব্যক্ত করে এ বিষয়ে কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন এবং একইসঙ্গে নেপিদোর উপর আন্তর্জাতিক চাপ জোরদার করার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সুইস প্রেসিডেন্ট অ্যালাইন বেরসেট এর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছি আমরা এবং আমি সুইস প্রেসিডেন্টকে বলেছি এই সমস্যার গোড়া রয়েছে মিয়ানমারে, কাজেই এর সমাধানও সেখান থেকেই খুঁজে বের করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার তাঁর কার্যালয়ে সুইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ বিবৃতিতে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি এক্ষেত্রে কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের পূর্ণ এবং অবিলম্বে বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন কারণ এটি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সফলভাবে নিজ দেশের বাড়িঘরে প্রত্যাবাসন এবং তাঁদের মর্যাদা ও নিরাপত্তার জন্য জরুরি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে এবং এর বাইরেও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে সুইজারল্যান্ডের ভূমিকার প্রশংসা করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডও সংকটের শান্তিপূর্ণ দ্রুত সমাধানের জন্য মিয়ানমারের উপর চাপ অব্যাহত রাখবে।’
সুইস প্রেসিডেন্ট তাঁর বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য ১২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাংক (প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার সমতুল্য) প্রদানের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, এটি হবে গত অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের জরুরি মানবিক সাহায্য হিসেবে সুইজারল্যান্ড প্রতিশ্রুত ৮ মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত।
সুইস প্রেসিডেন্ট মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের প্রতি সংহতি, সহায়তা এবং সুরক্ষা প্রদানের জন্য জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বেরেসে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের সফল প্রত্যাবাসনের জন্য সম্পাদিত চুক্তিকে সমস্যা সমাধানের জন্য একটি কার্যকরী পদক্ষেপ বলেও উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক ব্যাপক সুযোগ রয়েছে বলে তারা মতৈক্যে পৌঁছেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি জেনে অত্যন্ত আনন্দিত যে, মহামান্য প্রেসিডেন্ট এলেন বারসের উপস্থিতিতে আজ প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-সুইস বিজনেস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফোরামের একটি বৈঠকে উভয় দেশের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিরা মতবিনিময় করেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, তারা টেকসই উন্নয়নের ২০৩০ সালের এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা নতুন বিশ্বায়ন অংশীদারিত্ব তৈরিতে আমাদেরকে একটি অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘নিকট ভবিষ্যতে এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আজ উভয় দেশ যৌথভাবে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরে (এমওইউ) সম্মত হওয়ায় আমি আনন্দিত হয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে নোভার্টিস, নেসলে ও লাফার্জ-হোলসিম-এর মতো কিছু সুইস বহুজাতিক কোম্পানি ব্যবসা করছে এবং সেদেশের আরো কিছু কোম্পানি এখানে ব্যবসার সুযোগ নিতে পারে।
তিনি বলেন, ‘নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ, জটিল অবকাঠামো উন্নয়ন, আইসিটি, ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স এবং ওষুধ শিল্পসহ তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের মতো খাতে অংশগ্রহণের জন্য আমরা তাদের প্রতি আমন্ত্রণ জানাই।’
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্য আজ দুই দেশ একটি যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের জনগণের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদের গৃহীত যৌথ উদ্যোগ বাস্তবায়নে একটি রোডম্যাপ তৈরি করার কথা বলতে পারি।’
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বারসের সরকারি সফরকে ঐতিহাসিক অভিহিত করে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ৪৫ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে এই সফর একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রী ২০০০ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে সুইজারল্যান্ড সফরের কথা স্মরণ করেন এবং বলেন, ‘এই সফর আমাদের দুই দেশের চলমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো জোরদার করবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, সুইজারল্যান্ডের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, উচ্চতর অর্থনৈতিক অর্জন এবং শান্তি, বন্ধুত্ব ও দৃঢ় নিরপেক্ষতার প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুগ্ধ ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, আমার পিতা, সুইজারল্যান্ডের মতো আদর্শ দেশ ‘প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড’ হিসেবে বাংলাদেশকে উন্নত করতে চেয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের ১৩ মার্চ সুইজারল্যান্ড বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পশ্চিম ইউরোপীয় দেশের মধ্যে প্রথম স্বীকৃতিদানকারী কিছু দেশের মধ্যে অন্যতম ছিল সুইজারল্যান্ড।
তিনি বলেন, ‘তখন থেকেই সুইজারল্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার এবং আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু।’
সুইস প্রেসিডেন্ট তার দেশকে বাংলাদেশের ‘দৃঢ় ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ অংশীদার হিসেবে বর্ণনা করে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আরো জোরদারের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, দু’দেশের মধ্যে চমৎকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে এবং বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
বিসেট বলেন, সুইজারল্যান্ড অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শাসন এবং নিরাপদ অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী এবং ‘আমার এই সফর দু’দশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে অবদান রাখবে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের এই রোহিঙ্গা সঙ্কটের সময়ে আমার সফর বাংলাদেশের প্রতি সুইজারল্যান্ডের সমর্থন ও সংহতিরই প্রকাশ।’
সুইস প্রেসিডেন্ট গণতন্ত্র ও আইনের শাসন শক্তিশালীকরণের পাশাপাশি আকর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচন সাফল্য অর্জনে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, এইসব সাফল্যেও ফলে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এই কারণে সুইজারল্যান্ড বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করছে।
দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সুইস প্রেসিডেন্ট বলেন, গত সাত বছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এবং তিনি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করে বলেন, এই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ ভবিষ্যতে একটি নতুন উচ্চতা পৌঁছবে।
সুইস প্রেসিডেন্ট বন্ধুত্বের দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরে পারস্পরিক আস্থা এবং অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর উপর ভিত্তি করে দু’দশের মধ্যে এই অংশীদারিত্ব অবিরত অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
দু’নেতার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতেও সুইজারল্যান্ড রাজনৈতিকভাবে এবং দ্বিপক্ষীয় উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
শহীদুল হক বলেন, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের এগিয়ে যাবার প্রেক্ষিতে সুইস প্রেসিডেন্ট বেরসে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিতেও আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে সুইস প্রেসিডেন্ট বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে একটি বড় বাজার সৃষ্টি হওয়ায় অনেক সুইস কোম্পানীই বাংলাদেশে তাদের পণ্য নিয়ে আসতে চাইছে।
পররাষ্ট্র সচিব যোগ করেন, সুইস প্রেসিডেন্ট এসডিজি, জলবায়ু পরিবর্তন এব অভিভাসন ইস্যুতেও বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে অভিভাসন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর একটি ভালো জোট ছিল উল্লেখ করে বেরসে জোট গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করে মানুষের গতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি সম্প্রসারিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দু’দেশই এসডিজি বিষয়ে সহযোগিতার জন্য একটি দলিল স্বাক্ষরে একমত হয়েছে। কোন উন্নত দেশের বাংলাদেশের সঙ্গে এ ধরনের দলিল স্বাক্ষরে সম্মতির ঘটনা এই প্রথম।
ব্রিফিংয়ে-সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি শামীম আহসান বলেন, গত জানুয়ারিতেই মাত্র দায়িত্বভার গ্রহণ করা সুইস প্রেসিডেন্ট এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। অবশ্য এরআগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় তিনি পুরো বিষয়টি ওয়াকিবহাল রয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল