13180
Published on ফেব্রুয়ারি 6, 2018বাঙালির ঐতিহ্যের সারথী হিসেবে প্রতি ইংরেজি বছরের ভাষার মাসখ্যাত ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী বাংলা একাডেমির বইমেলা শুরু হয়। ঐতিহ্য এবং রীতি অনুযায়ী তা পহেলা ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় এ দিনে দেশের সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তা উদ্বোধন করে থাকেন। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে বিকেল বেলায় তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলেন বাঙালির প্রাণের সে মেলা। সেখানে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অতিথিরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীসহ সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেক গুণী ব্যক্তিরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে অমর একুশে গন্থেমেলা উদ্বোধন করেন। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেলা উদ্বোধন করলেও তিনি শুধু যে একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই এখানে আসেন তা কিন্তু নয়। বরং আমরা দেখেছি মেলায় আসলে তিনি একজন সাধারণ পাঠক ও দর্শনার্থীর মতো হয়ে যান। নিজেই বইয়ের স্টলে স্টলে ঘুরে পছন্দসই বই কিনেন। কারণ তিনি নিজেও একজন সাহিত্য অনুরাগী, সৃজনশীল লেখক ও অনবদ্য পাঠক।
ছাত্রজীবনে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন কৃতী শিক্ষার্থী ছিলেন। সেই হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা সবাই তার সরাসরি শিক্ষক। তাদের মধ্যে জীবন্ত কিংবদন্তি হলেন প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম, প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান প্রমুখ। প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম হলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলা একাডেমির সভাপতি হলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাহিত্যিক, ভাষাবিদ, গবেষক প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান। তিনি বইমেলা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি একই বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার শিক্ষকদের কীরূপ সম্পর্ক তা প্রায়শই দেশবাসী প্রত্যক্ষ করে থাকেন। তিনি সর্বদাই তার গুণী শিক্ষকদের কদর ও যথাযোগ্য মর্যাদার আসন প্রদান করে থাকেন। সেটি মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লক্ষ করা যায়। সর্বশেষ বইমেলা ২০১৮ উদ্বোধনকালে দেশবাসী সেটি আরো একবার প্রত্যক্ষ করল। সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর কোনো অনুষ্ঠান থাকলে সেখানে লালগালিচা প্রদান করা হয়ে থাকে। বইমেলা উদ্বোধনী মঞ্চে ওঠা-নামার পথেও লালগালিচা দেয়া ছিল। কিন্তু তিনি সেই লালগালিচা ব্যবহার করেননি। কারণ পাশে ছিলেন তার শিক্ষক এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান। তিনি শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্মানে লালগালিচা ছেড়ে লালগালিচার পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছেন। আর শিক্ষককে নিয়েছেন লালগালিচার ওপর দিয়ে।
শিক্ষকের প্রতি সম্মান দেখানোর সেই মূহূর্তের একটি ছবি সেখানে উপস্থিত থাকা আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ জগলুল হায়দারের ফেসবুক পেজে পোস্টিং দেয়া হয়। তারপর তা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। এর আগেও একাধিক অনুষ্ঠানে শিক্ষকের জন্য প্রধান অতিথির জন্য বরাদ্দকৃত আসন ছেড়ে দেয়ার নজির তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি শুধু তার আচরণে নন, কথাবার্তাতেও সর্বদা এ বিষয়টির প্রমাণ দিয়ে থাকেন।
একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষমতা ও অবস্থানকে প্রাধান্য না দিয়ে যেভাবে বারবার তার শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করে চলেছেন সেখানে নিশ্চয়ই সবার শিক্ষণীয় কিছু থাকতে পারে। এমন বিনয় আজকাল আর অনেকের মধ্যেই লক্ষ করা যায় না। একজন সরকার-প্রধানের এমন আচরণ নিশ্চয়ই দৃষ্টান্তমূলক। আমরা হয়তো সবকিছুই নিজের উচ্চতা দিয়ে বিচার করি যা কখনোই বিধাতার সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে বিনয়ী করে না। আবার এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যাদের বিনয় তার চারপাশের সবাইকে মুগ্ধ করে।
একজন শিক্ষক তিনি হতে পারেন প্রাইমারি স্কুলের, হাই স্কুলের, কলেজের কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সে সব সম্মানিত শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা যত বড়ই হই না কেন আমাদের সেই শিক্ষাগুরুদের সম্মান করতে হবে। এ বিষয়ে আমার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনয়ী উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি করে থাকেন যা আমাকে খুবই আকৃষ্ট করে। সেটি হলো সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষই তার শিক্ষক-তুল্য। কারণ সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রত্যেকটি মানুষের কাছ থেকেই কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। দেখা গেছে একজন নাপিত যেভাবে চুল কাটেন কিংবা একজন ধোপা যেভাবে ইস্ত্রি করেন সেভাবে ইচ্ছা করলেও আমরা তা পারব না। তার মানে হলো তারাও এসব কাজের ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষক-তুল্য।
তবে একটি কথা ঠিক যে, সমাজে সব ছাত্রও যেমন একরকম নয় তেমনি সব শিক্ষকও একরকম নয়। এখন অনেক শিক্ষক তাদের স্বার্থের দ্ব›েদ্ব দলাদলিতে জড়িয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়ছেন। অনেকে আবার ক্লাসের বাইরে কোচিং বাণিজ্যসহ অনৈতিক আয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে মূল পেশা শিক্ষকতার নীতি-নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা করছেন না। অপরদিকে ন্যায্য বেতন-ভাতা না পেয়ে শিক্ষকদেরও ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য অনেক সময় আন্দোলন করতে হয়। কিন্তু তারপরও শিক্ষক-ছাত্র সবাই সমাজেরই জীব। মনুষ্য সমাজের কলুষ থেকে সরাসরি মুক্ত হওয়া খুবই কঠিন কাজ। শিক্ষক তো শিক্ষকই। সমাজে, দেশে তাদের অবদান অসামান্য। কাজেই তাদের শুধু ভালোবাসা এবং মর্যাদাই প্রাপ্য। কোনো অপমান-বঞ্ছনা নয়। আর আমাদের বিনয়ী প্রধানমন্ত্রী তার শিক্ষককে মর্যাদা দিয়ে জাতিকে সেটিই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কেমনে বিনয়ী হতে হয়। নিশ্চয়ই এটি অনুকরণীয় ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ