1818
Published on ডিসেম্বর 1, 2017প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কাছে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সহযোগিতা কামনা করেছেন, যাতে করে এই অঞ্চলের শান্তি এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শান্তিচুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ভূমি বিরোধ, সেই জটিলতাও শিগগির সমাধান হবে। যাই হোক, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সহযোগিতা করলে এই বিষয়টিরও মীমাংসা হতে পারে।’
ভূমি বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধন পূর্বক “ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০১৬” সংশোধিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে এবং বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার সন্ধ্যায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ২০তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে কেন্দ্রীয়ভাবে রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানসহ বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সঙ্গে মতবিনিময়কালে এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির সুফলের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চুক্তির পর পার্বত্য এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় আছে বলে সেখানে উন্নয়নের ছোঁয়াও লেগেছে। সরকার উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালাতে পারছে। রাস্তাঘাট গড়ে উঠেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুষম উন্নয়নের অংশীদার হয়েছে পার্বত্য জনপদের বাসিন্দারা। এখানকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে।
সুষম উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য এলাকাসহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও এতো দ্রুত এভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে কি-না, আমার জানা নেই। চুক্তির ৭২ শর্তের মধ্যে ৪৮টিই বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। ১৫টি আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। ১৪টির বাস্তবায়ন চলমান।
চুক্তি আরো দ্রুত বাস্তবায়ন করার সম্ভব ছিলো উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তারা চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক ছিলো না।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে যেভাবে হত্যা-ক্যু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়, তেমনি পার্বত্য এলাকায়ও আত্মঘাতী সংঘাত শুরু হয়। একটা সময় ছিল, পার্বত্য এলাকায় গেলেও দুপুর ৩টার মধ্যেই ফিরে আসতে হতো।
’৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকারগুলো পাহাড়ে সেটেলার বাঙালি বসতি স্থাপন করতে গিয়ে দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটান উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আমি পার্বত্য সমস্যাকে “রাজনৈতিক” বলে বিবেচনায় নেই। সেই অনুযায়ী আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজতে থাকি।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাদের সমন্বয়ে সেল গঠন করি এবং নিজেও উদ্যোগ নেই। এরমধ্যে মাঝেমধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটতো, যা অগ্রহণযোগ্য ছিল। দ্বন্দ্বটা আরও বাড়ানোর অপচেষ্টা ছিলো। একটা পর্যায়ে আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তি চুক্তি করতে সমর্থ হই। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তিতে সই করি।
তিনি বলেন, শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে যারা সংঘাতে জড়িত ছিল, আমরা তাদের অস্ত্র সমর্পণের সুযোগ দেই। স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরে আসার সুযোগ দেই। সংঘাতের কারণে যে বাসিন্দারা ভারতে শরণার্থী হয়ে যান, তাদের ফিরিয়ে আনি। তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেই, যেটার দায়িত্ব থাকে আমাদের সেনাবাহিনীর হাতে। চাকরি ছেড়ে যাওয়া অনেককে নীতিমালা শিথিল করে ফের চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দেই।
এ চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে বাধা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চুক্তির পর আমরা যেদিন অস্ত্র সমর্পণের অনুষ্ঠান করি, সেদিন বিএনপি হরতাল ডাকে। অস্ত্র সমর্পণে বাধা দেওয়া ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আমার মনে হয় তারা অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা কতো অপপ্রচার করেছিল, বলেছিল চুক্তি হলে পুরো ফেনী পর্যন্ত ভারতের অংশ হয়ে যাবে। এমনকি ভারতের একটি পতাকাও তারা বানিয়েছিল, যেটা আমাদের গোয়েন্দারা চিহ্নিত করে ফেলেন।
সব বাধা পেরিয়ে চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধান মেনে সই হওয়া এই চুক্তির উদ্দেশ্য পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়ন, এখানকার মানুষের জীবনমান উন্নত করা। আজকে সাজেক ভ্যালি পর্যন্ত সরাসরি গাড়িতে যাওয়া যায়।
পার্বত্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭০ সালে সাজেক ভ্যালিতে যেতে চেয়েছিলাম। বলা হলো সাত দিন হেঁটে যেতে হবে সাজেক ভ্যালিতে। এখন সেখানে গাড়িতে যাওয়া যায়। শুধু সাজেক নয়, পার্বত্যের সব এলাকায় দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে। এখন যেমন রাস্তাঘাট হয়ে গেছে, তেমনি ওই অঞ্চলের মানুষ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফলমূল সব বাজারজাত করতে পারছে।
সরকার প্রধান পার্বত্যাঞ্চলে উন্নয়নের কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন, সেখানে পর্যাপ্ত স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছি। ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়িয়েছি। রাস্তাঘাট করতে গিয়ে ক’দিন আগেই থানচিতে আমাদের সেনা সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন।
চুক্তির বাইরেও সরকার পার্বত্য জনপদের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চাকরির ক্ষেত্রে পার্বত্য-বাসীর জন্য কোটার ব্যবস্থা করেছি। দেশে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। সেজন্য পার্বত্য জনপদকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করারও ব্যবস্থা নিয়েছি আমরা। যেন আমাদের সন্তানরা নিজেদের এলাকায় থেকেই পড়াশোনা করতে পারে।
চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী।
গণভবন প্রান্তে অন্যান্যের মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং বক্তব্য রাখেন।
রাঙ্গামাটি স্টেডিয়াম থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
দিবসটি উপলক্ষে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানে বর্ণাঢ্য র্যালী অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এতে অংশগ্রহণ করেন।
ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল