1321
Published on ডিসেম্বর 4, 2017মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দমন-পীড়নের কারণে সৃষ্ট রোহিঙ্গা সঙ্কটের টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে কম্বোডিয়ার সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে তাদের ঘরে ফিরতে পারে, সেজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে আমরা দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের কাছেও আমি সহযোগিতা চাইছি, যাতে এ সঙ্কটের একটি টেকসই সমাধানে আমরা পৌঁছাতে পারি।’
আজ নমপেনে দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে এক যৌথ বিবৃতিতে শেখ হাসিনা একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সাম্প্রতিক কিছু আঞ্চলিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। দুই পক্ষই সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারের কথা বলেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়েও কথা বলেছি, যা আমাদের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি বিনষ্টের হুমকি তৈরি করছে।’
প্রধানমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশকে এখন ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বইতে হচ্ছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৭ লাখ মানুষ মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সহিংসতার কারণে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁরা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের বিষয়েও আলোচনা করেছেন, যা কিনা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই মর্মে হুন সেন আশাবাদ ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার উভয়েই এই রোহিঙ্গা শরণার্র্থীদের সুশৃঙ্খলভাবে নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে একযোগে কাজ করবে।
তিনি বলেন, ‘দেশে ১৬ কোটি মানুষ থাকার পরেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয় প্রদান করে এবং তাদের বিষয়টি নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়ায় আমরা তাদের (বাংলাদেশের) প্রশংসা করছি।’
কম্বোডিয়াকে বাংলাদেশের নিকটতম আঞ্চলিক প্রতিবেশি আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই দুটি দেশ একই রকম শান্তি, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের প্রত্যাশী।
তিনি বলেন, আমরা অনেক আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক ফোরামে পরস্পরকে নিবিঢ়ভাবে সহযোগিতা করে থাকি বিশেষ করে এআরএফ, আসেম, এসিডি এবং জাতিসংঘে।
কম্বোডিয়ায় তাঁর সফরকে অত্যন্ত ফলপ্রসু আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর এবং প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের আলোচনার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
কম্বোডিয়ার উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আজ সকালে অত্যন্ত সৌহার্দ্য ও উষ্ণ আতিথিয়তাপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমরা দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল দ্বিপাক্ষীক বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেছি।’
এ সময়, বাংলাদেশের লক্ষ্য হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতার সম্পর্ককে আরো জোরদার করা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমার এই সফরে দুই দেশের মধ্যে ১০টি দ্বিপাক্ষিক স্মারক ও একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বৈঠকে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠেয় যৌথ কমিশনের (জয়েন্ট কমিশন) প্রথম বৈঠকটি ঢাকায় অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রীদের নেতৃত্বে জয়েন্ট ট্রেড কাউন্সিল (জেটিসি)-র প্রথম বৈঠকটিও আগামী বছর ঢাকায় অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এবং কম্বোডিয়া দু’দেশের রাজধানীতে পৃথক দুটি আবাসিক কূটনৈতিক মিশন খোলার বিষয়টিও বিবেচনা করে দেখছে।
তিনি বলেন, জয়েন্ট ট্রেড কমিশন (জেটিসি), বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং দু’দেশের চেম্বারগুলো সর্বোচ্চ সংস্থার মধ্যে আমাদের স্বাক্ষরিত স্মারকগুলো দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে সাহায্য করবে।
তিনি বলেন, শ্রম এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ, আইসিটি, মৎস্য, অ্যাকুয়া কালচার এবং পর্যটন বিষয়ে স্বাক্ষরিত স্মারকগুলো আমাদের বহুবিধ সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরো প্রশস্থ করবে।
আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি আজকের আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি অত্যন্ত আনন্দিত যে, প্রধানমন্ত্রী হুন সেন আসিয়ান (এএসইএএন) বৈঠকে বাংলাদেশকে ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনারশীপ অ্যাসপিরেশন’এ সহযোগিতা প্রদানের বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন।
তিনি বলেন, গাঙ্গেয় অববাহিকার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কম্বোডিয়ার সঙ্গে ‘মেকং-গঙ্গা সহযোহিতা ফোরামের মেম্বারশিপ প্রাপ্তির বিষয়ে একযোগে কাজ করার দিকে তাকিয়ে আছে।
দুই মহান জাতিই একই ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেছে উল্লেখ কওে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা কম্বোডিয়ার সংঘাত পরবর্তী শান্তি স্থাপনে সর্বাগ্রে কম্বোডিয়ার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালি এবং খেমার জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে আদি সাংস্কৃতিক যোগসূত্র রয়েছে, সংস্কৃত ও পালী সমর্থিত পঞ্জিকা এবং দুজনেরই নতুর সাল গণনা শুরু হয় এপ্রিল থেকে।
নরদম সিহানুকের স্মৃতি সৌধে তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কম্বোডিয়ার জাতির পিতা বাংলাদেশেও উচ্চ সম্মানের আসনে আসীন রয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছেন যে, তাঁর সরকার রাজধানী ঢাকার একটি সড়ক প্রয়াত রাজা নরদম সিহানুকের নামে নামকরণ করতে যাচ্ছে।
তাঁর দেশে উষ্ণ আতিথিয়তা প্রদর্শন করায় প্রধানমন্ত্রী কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, তাঁর এই সফর বাংলাদেশ এবং কম্বোডিয়ার সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী হুন সেন এবং কম্বোডিয়ার বন্ধুত্ব প্রবণ জনগণের সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু এবং শুভ কামনা করে তঁদের অব্যাহত শান্তি, সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতি কামনা করেন।
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমরা একটি ফলপ্রসু সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছি যাতে ভবিষ্যতে উন্নত দেশগুলোর কাতারে সামিল হতে আমরা একযোগে কাজ করতে পারি।
তিনি বলেন, কম্বোডিয়া বাংলাদেশের আসিয়ানে (এএসইএএন) সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হবার আকাঙ্খাকে সমর্থন করে এবং নমপেন তাদের এই লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা করে যাবে।
কম্বোডিয়ার জনগণের জন্য বাংলাদেশের জনগণের সহযোগিতার বিষয়ে হুনসেন তাঁর হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ২০০১ সালে বাংলাদেশে তাঁর প্রথম সফরের পর এবারে কম্বোডিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সফর দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরো জোরদার করেছে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হুন সেনকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি তা গ্রহণ করে বলেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গেই এটি গ্রহণ করছি।’
আলোচনায় বাংলাদেশ পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মূখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং প্রেস সচিব ইহসানুল করিম উপস্থিত ছিলেন।