1540
Published on ডিসেম্বর 5, 2017প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়া একটি শক্তিশালী এবং পারস্পরিক সুবিধাজনক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে এবং এখন এই অঞ্চলে উন্নয়ন, শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বৃহত্তর আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার জন্য একসাথে কাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আশা করি যে, বাংলাদেশ এবং কম্বোডিয়ার মধ্যে ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা আমার সফরের মাধ্যমে আরও জোরদার হবে।’
৪ ডিসেম্বর এখানে বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘খেমার টাইমস’এ লেখা এক নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন।
‘বন্ধুত্বের লালন: বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়া’ শীর্ষক নিবন্ধটিতে বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার জনগণ স্বাধীনত অর্জনের সময় অভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং অত্যাচার সহ্য করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার মধ্যে আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে অনেক মিল রয়েছে এবং উভয় দেশের জনগণই জীবনযাপনের মান উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দু’দেশের জনগণের কল্যাণে কৃষি, বাণিজ্য ও বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা এখন বৃদ্ধি করতে হবে।
তিনি বলেন, ভৌগোলিক নৈকট্য সত্বেও, বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার জনগণের মধ্যে একটি বড় ধরনের বিচ্ছিন্নতা ছিল, যদিও প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের ২০১৪ সালের বাংলাদেশ সফরের ফলে উল্লেখযোগ্যভাবে এই দূরত্ব কমে আসে এবং ব্যবসায়ীমহলের যোগাযোগের পথ প্রশস্থ হয়।
নিবন্ধটিতে রোহিঙ্গা ইস্যু সম্পর্কে কম্বোডিয়ানদের কাছে তুলে ধরে শেখ হাসিনা লেখেন, জোরপূর্বক বাস্তুুচ্যুত মিয়ানমারের ১০ লাখেরও বেশি নাগরিককেকে মানবিক সহায়তা প্রদানের কারণে বাংলাদেশ এক অপ্রত্যাশিত সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
সঙ্কটের সমাধান করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অভ্যাহত সমর্থন কামনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা মানবিক বিবেচনায় তাদের আশ্রয় দিয়েছি কিন্তু দীর্ঘদিনের জন্য তাদেরকে খাদ্য ও আশ্রয় প্রদান করাটা আমাদের জন্য কঠিন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমারকে তার নাগরিকদের অবশ্যই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং আমরা সঙ্কটের সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাই।’
তিনি বলেন, অনেকে ধারণা করেছিল পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গিবাদের এক উর্বর ভূমি হতে যাচ্ছে। কারণ, এর প্রজননের জন্য অনেক উপাদানই এখানে রয়েছে। এটি বিশ্বব্যাপী একটি প্রবণতা যা সমগ্র বিশ্বের দেশসমূহকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘(কিন্তু) আমাদের (বাংলাদেশ) সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের সরকারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’নীতি গ্রহণ করে এর বিস্তার রোধ করা।’
তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ তার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সামর্থকে উন্নত করেছে, যা দেশের মধ্যে সন্ত্রাসের বিস্তারকে কঠিন করে তুলেছে। কারণ, দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মের নামে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সমর্থন করে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক, অভিভাবক এবং জনপ্রতিনিধিসহ সকল শ্রেণীপেশার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ প্রচারাভিযান শুরু করেছি।’
তিনি কম্বোডিয়া সফরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের আমন্ত্রণে অত্যন্ত খুশি শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আমার এই তিনদিনের সফরে, আমার দেশবাসীর পক্ষে এবং আমার নিজের পক্ষে, আমি কম্বোডিয়ার জনগণের কাছে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’
তিনি উল্লেখ করেন, পারষ্পরিক শ্রদ্ধা, অংশীদারিত্বমুলক ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং জনগণের একই ধরনের মূল্যবোধ ও রীতিনীতি নিয়ে বাংলাদেশ এবং কম্বোডিয়া বন্ধুত্বের দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ চমৎকার সম্পর্ক উপভোগ করছে। তিনি এ সময় বিশেষ করে হুন সেনের সঙ্গে তাঁর (হুন সেনের) ঢাকা সফরকালীন ২০১৪ সালের ১৬ থেকে ১৮ জুনের সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করেন।
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন একটি সুষম উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে যেমনটি রেখেছে কম্বোডিয়া উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকল বাধা উপেক্ষা করে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি শক্ত ভীতের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে এবং নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত খুশী যে, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারায় কম্বোডিয়াও এখন নি¤œমধ্যম আয়ের দেশ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা যদিও কখনই সুখকর ছিল না, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করে। শেখ হাসিনা এ সময় মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং সম্ভ্রমহারা ২ লাখ মা-বোনের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন মতাদর্শের সমন্বয়ে বিদ্যমান ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শিক মূল্যবোধ প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। পুরো জাতি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে একই সুরে ছিল না এমনকি কেউ কেউ স্বাধীনতার বিরোধীতা পর্যন্ত করেছিল।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের ১৮জন সদস্যসহ সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যখন তিনি (বঙ্গবন্ধু) যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিয়েছিলেন। আমি এবং আমার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকার কারণে সেই হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পাই।
তিনি লেখেন, ‘যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক সময় বিরোধিতা করেছিল এই হত্যাকান্ডের পর ষড়যন্ত্র করে তারাই ক্ষমতায় আসে। স্বাধীনতার চেতনাকে তারা ধূলিস্মাৎ করারও ষড়যন্ত্র করে।
প্রধানমন্ত্রী লেখেন, প্রায় দুই দশকেরও অধিক সময় সেনা শাসনে থাকে বাংলাদেশ। দেশী-বিদেশী চক্রান্ত অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশ সে সময় তাঁর কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও আত্মমর্যাদা নিয়ে এগুতে পারেনি।
বাধ্য হয়ে ছয় বছর প্রবাসী জীবন কাটানো পর ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরতে সক্ষম হন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকেই তাঁর জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর ক্ষমতায় এলেও পরবর্তী পাঁচ বছর আবারো ক্ষমতার বাইরে থাকে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে পূনরায় বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর টানা দুই মেয়াদে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারই বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর অন্যতম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে জনগণের জীবিকা চাষযোগ্য জমি ও প্রকৃতির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। প্রাকৃতিক সম্পদেরও স্বল্পতা রয়েছে।
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের কারণেই আর্থসামাজিক সূচকে উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। জনগণের সীমাহীন স্থিতিশীলতা, সাহস ও উদ্যোগের ফলেই এই উত্তরণ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দশক আগেও বাংলােেশর জনগণের জীবনমান কেমন ছিল? দারিদ্রের হার যেখানে ২০০৫ সালে ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ তা থেকে বর্তমান সরকারের সময়ে কমে ২২ ভাগ হয়েছে। জনগণের মাথা পিছু আয় ২০০৫ সালে যেখানে ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার তা বেড়ে বর্তমানে ১৬১০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আশা করা হচ্ছে ২০২১ সাল নাগাদ আমরা দারিদ্রের হার আরো কমিয়ে ১৬-১৭ ভাগে নিয়ে আসতে সক্ষম হব।
তিনি বলেন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার এবং গড় আয়ুতে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের মধ্যে ভালো।
তিনি লেখেন, বর্তমানে দেশের শিশু মৃত্যুর হার কমে হাজারে ২৮ জন এবং মাতৃমৃত্যুর হার হাজারে ১ দশমিক ৭ জনে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিও সার্বিক হার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ২ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। গত ৮ বছরে মানুষের গড় আয়ু ৬৫ বছর থেকে বেড়ে হয়েছে ৭২ বছর হয়েছে।
‘গত বছর আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নীচে রয়েছে যা আমাদের অর্থনীতির সামর্থেরই পরিচায়ক।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরপর তৃতীয় বারের মত বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোর মধ্যে লিঙ্গ সমতায় শীর্ষস্থান অর্জন করেছে এবং বিশ্বে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭ তম।
প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, গ্রামীণ বাংলাদেশে এখন আঁবাবাঁকা কংক্রিটের সড়কের মাধ্যমে একটির সঙ্গে দূরবর্তী আরেকটি সংযুক্ত হয়েছে। টিনের ঘরগুলোর স্থান নিয়েছে পাকা ঘরবাড়ি। গ্রামগুলো হারিকেন ও লন্ঠনের বদলে বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় ঝলমলে হয়ে উঠছে।
রাতে অধিকাংশ গ্রামেই লন্ঠনের জায়গা নিয়েছে বিজলী বাতি উল্লেখ করে বর্তমানের পল্লী-গ্রামের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অধিকাংশ গ্রামেই এখন বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। যে সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও বিদ্যুতের গ্রিড লাইন পৌছতে পারেনি এমন এলাকায় প্রায় ৪৫ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপন করে বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে।
আমাদের সরকার শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে মানব সম্পদ উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারী শিক্ষার্থীদের বিশেষ বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে অসচ্ছল পরিবারের মেয়েরা বিনামূল্যে তাদের লেখাপড়া করতে পারে। বছরের প্রথম দিন থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে। দূরবর্তী গ্রামগুলো ডিজিটাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী লেখেন, তাঁর সরকার বাংলাদেশকে একটি স্থিতিশীল ও দৃঢ় অবস্থানের মধ্যে রেখেছে।
তিনি বলেন, আমি দারিদ্র্যকে সবসময় মানবজাতির প্রধান শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেছি, আমরা প্রায় ক্ষুধার বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছি। আমরা তৃণমূলের মানুষদের জন্য ১৮,৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার আশা করে। বর্তমান অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে দেশের মানুষ তখন টেকসই ও উন্নত জীবনযাত্রার স্বাদ পাবে।