অসহযোগের উত্তাল দিন

1644

Published on মার্চ 10, 2021
  • Details Image

সেলিনা হোসেনঃ

বাঙালি-বাংলাদেশের ইতিহাস একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দিগ্দর্শন। বাঙালির অতিজাগরণে অসহযোগ আন্দোলন এবং পরবর্তী পর্যায়ে যোদ্ধা জাতি হিসেবে বাংলাদেশের সৃষ্টি বাঙালির এক দীপ্ত নতুন পরিচয়। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ পৃথিবীর সীমানায় বাঙালি জাতিসত্তার গৌরব ছড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠা করেছে আত্মমর্যাদার ভিত্তি। মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য জীবনদানকারী বাঙালি আজ বিশ্বের দরবারে নিজের পরিচয়ে পরিচিত। ২১ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ, ২৫ মার্চ বাঙালির অর্জন ইতিহাসের অবিস্মরণীয় অর্জন। এই অর্জনে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের প্রাঙ্গণে আজ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের জনগণের সামনে দীপশিখা। তারা সগৌরবে বলতে পারছে, ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।’

১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেলা একটার সময় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই হীন ষড়যন্ত্রে রোষে ফেটে পড়ে জনতা। মুহূর্তে ঢাকা শহর এক গভীর জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রূপান্তরিত হয় প্রতিবাদ, মিছিল আর স্লোগানের শহরে। বঙ্গবন্ধু সে সময়ে হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের শাসনতন্ত্র–সংক্রান্ত মিটিং নিয়ে ব্যস্ত। হাজার হাজার মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে সমবেত হয়। উত্তেজিত জনতা প্রবল ঘৃণায় পাকিস্তানের পতাকা ও জিন্নাহর ছবি পুড়িয়ে ফেলে। বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন। তারপর সংবাদ সম্মেলনে ২ মার্চ থেকে হরতাল পালনের আহ্বান জানান। সাংবাদিকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাইরে উত্তেজিত জনগণ আপনার নির্দেশ চায়। আপনি কী বলবেন তাদের?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘সাত তারিখে সব জানতে পারবেন।’ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে।’

৩ মার্চ সারা দেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এই দিন ঢাকায় জাতীয় সংসদ অধিবেশনের উদ্বোধনী দিন ছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দিনটি শোক দিবস বলে উল্লিখিত হয়। পল্টন ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ডক্টর মাযহারুল ইসলাম অনূদিত অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের রেপ অব বাংলাদেশ গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে, ‘দেশের শাসনক্ষমতা ক্রমশ শেখ মুজিবের হাতে চলে গেল। শেখ মুজিবের নির্দেশ ছাড়া আর কোনো নির্দেশ এ সময় পালিত হয়নি। ইয়াহিয়া সরকারের ক্ষমতা শুধু ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে হাইকোর্টের বিচারপতি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশকেই সরকারি আদেশ বলে শিরোধার্য করেছিল।’

৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় একটি ইশতেহার পাঠ করা হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বলা হয়, ৫৬ হাজার ৫৭১ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের জন্য আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম সে রাষ্ট্রের নাম হবে বাংলাদেশ।

৪ মার্চ মিরপুর, মোহাম্মদপুরে অবাঙালিদের জনসভা হয়। তারা অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে।

বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দেন, ব্যাংক এবং সরকারি অফিসগুলো আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে। শিল্পীসমাজ জানায়, যত দিন সংগ্রাম চলবে, তত দিন রেডিও-টিভিতে অনুষ্ঠান করবে না। আবুল মনসুর আহমদ পাকিস্তান সরকারের খেতাব ও তকমা বর্জনের আবেদন জানান।

৭ মার্চ রমনা রেসকোর্সে তাঁর অসাধারণ ভাষণটি দিয়ে দেশবাসীকে তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য অনুপ্রাণিত করেন।

৯ মার্চ বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে টিক্কা খানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানান।

১২ মার্চ বাঙালি সিএসপি অফিসাররা অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। তাঁরা আওয়ামী লীগের ত্রাণ তহবিলে এক দিনের বেতন দানের সিদ্ধান্তের কথা জানান।

১৩ মার্চ সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ ১১৫ নং সামরিক আইন আদেশ জারি করে। আদেশে বলা হয়, যাঁরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন, ১৫ মার্চের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে তাঁদের চাকরি যাবে। আরও বলা হয়, যোগদানে ব্যর্থ হলে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হবে।

১৪ মার্চ কর্মচারীরা সামরিক আইন অমান্য করে এর বিরুদ্ধে মিছিল বের করেন। সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘উসকানিমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করুন।’ তিনি দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘বাঙালিদের স্বাধীনতার উদ্দীপনা কেউ দমাতে পারবে না।’

২৪ তারিখে ইয়াহিয়া খান–ভুট্টো সবার সঙ্গে আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাড়ির সামনে জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘আন্দোলন নস্যাতের চক্রান্ত চলছে। আমার মাথা কেনার শক্তি কারও নেই। বাঙালির সঙ্গে আমি বেইমানি করতে পারব না।’

২৫ মার্চ বিকেলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ছেড়ে চলে যান। অথচ মুজিব ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা সাতটায়। রাত ১০টা সাড়ে ১০টার দিকে সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে ঢাকার রাজপথে বেরিয়ে আসে। শুরু করে বাঙালি নিধনযজ্ঞ। জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা করে।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। মার্চ মাসের শুরু থেকে পরবর্তী ২৫ দিন তাঁর নির্দেশে বাঙালি জাতি এক উত্তাল সময় পার করে। স্পর্শকাতর সেই সময়ে তিনি তাঁর প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দিয়ে ২৫ দিন ধরে পাকিস্তান সরকারের বিপরীতে যেভাবে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন, তা ছিল অসাধারণ। এভাবেই তিনি স্বাধীনতার প্রধান মন্ত্রণাদাতা হয়ে ওঠেন।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত