বঙ্গবন্ধুর বিচার ও স্বাধীনতার যুদ্ধ

2265

Published on ফেব্রুয়ারি 26, 2021
  • Details Image
 
বাবুল আনােয়ারঃ
 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পুরােটা সময় পাকিস্তানের কারাগারে আটক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে তাকে তার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। গ্রেফতার হওয়ার আগেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং তা ওয়ারলেস যােগে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর নিকট প্রেরণ করেন। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপারেশন সার্চ লাইট নামে বাঙালি হত্যা লীলায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। সংগঠিত হয় পৃথিবীর বুকে জঘন্য নৃশংসতম গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে প্রথম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন দিন পর পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে লায়ালপুরের মিয়ানওয়ালী জেলে আটকে রাখা হয়। এখানে কারাগারের এক নির্জন প্রকোষ্ঠে ৯ মাস তার বন্দী জীবন কাটে। এ সময় তাকে কোন বই, সংবাদপত্র পড়তে দেয়া হয়নি। সমগ্র বিশ্ব থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। জেলখানায় এক অসহনীয়, অমানবিক পরিবেশে এ মহান নেতা দুর্জয় মােহনীয় শক্তিতে বাংলার মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে অনড় থেকেছেন মৃত্যুকে তুচ্ছ করে। বঙ্গবন্ধু কোথায়? কেমন আছেন এ উদ্বেগের অবসান হয় পাকিস্তানের সংবাদপত্র সমূহে প্রকাশিত খবর ও ছবি দেখে। তাকে যে পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে সবাই সে সম্পর্কে নিশ্চিত হন। তবে কারাগারে রেখে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযােগ এনে সামরিক আদালতে বিচারের নামে প্রহসন চলতে থাকে। অবশ্য এ ধরনের অপচেষ্টা এর আগেও কয়েকবার তারা গ্রহণ করেছিল। তবে সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। বিশেষ করে ১৯৬৮ সালে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' মামলায় বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে তাকে হত্যার যে নীলনকশা করা হয়, তা ১৯৬৯ সালের ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের কারণে নস্যাৎ হয়।
 
পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী ভেবেছিল যে, বাঙালিদের হত্যা, নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করা সম্ভব হবে। মুক্তিযুদ্ধে তারা বিজয়ী হতে পারবে না। ইসলামের নামে এবং ভারত বিরােধী মনােভাব চাঙ্গা করে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি টিকে রাখা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহযােগিতা তাদের এ ধারণাকে আরও বদ্ধমূল করে তােলে। আর তা সম্ভব হলে তারা প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিশ্চিতভাবে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে দিত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ক্রমশ প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হতে থাকে। মুক্তিপাগল বাঙালি জনগােষ্ঠীর গভীর দেশপ্রেম, অদম্য সাহস, বঙ্গবন্ধুর প্রতি আস্থা, ভালবাসা, মুক্তিযােদ্ধাদের মরণপণ লড়াই আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব, ভারতের সহযােগিতা, বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন পাক সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করে। তাই পাক সরকার বঙ্গবন্ধুকে আটক রেখে মুক্তিযােদ্ধাদের মােকাবিলা ও পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় মরিয়া হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত বিলম্বিত হতে থাকে। অথবা তারা বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে থাকে। এর থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলাে বঙ্গবন্ধুকে আটক করে তাদের যে নীলনকশা ছিল তা তাে সফল হয়নি। বরং বাঙালি জাতি বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন ও তাদের নেতাকে মুক্ত করার সংগ্রাম দিন দিন জোরদার করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রক্রিয়া বাঙালি জনগােষ্ঠীর গভীর দেশপ্রেমের ধারাকে আরও বেগবান করে তােলে। উজ্জীবনের শপথে দুর্দমনীয় আত্মপ্রত্যয় মুক্তির মােহনায় সমগ্র জনগােষ্ঠীকে এক করে ফেলে। অথচ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের প্রথম থেকেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বিচার করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার হুমকি প্রদান করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর এ কথিত বিচার বন্ধ ও মুক্তির ব্যাপারে বিভিন্ন রাষ্ট্র, নেতৃবৃন্দ, ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে বক্তব্য, বিবৃতি প্রদান অব্যাহত থাকে। এর কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
 
১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ উইক' ম্যাগাজিনের পরিবেশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে রেখে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। লেখাটিতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, স্বাধীনতার মৃর্তপ্রতীক এ নেতাকে জেলে রাখায় বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ব্রিটিশ 'ডেইলি টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'পকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ভুলক্রটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের অন্ধত্ব পাকিস্তানকে যে গভীর খাদের দিকে ধাবিত করছে তা থেকে একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই রক্ষা করতে পারেন। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রকাশ্যে ঘােষণা করেন যে, শেখ মুজিব রাষ্ট্রদ্রোহী এবং এ জন্য তার বিচার হবে।
 
৮ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বিচারের নামে শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দেয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে বার্তা প্রেরণ করেন ও প্রতিবাদ জানান।
 
৯ আগস্ট এক সরকারী প্রেসনােটে জানানাে হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ও অন্যান্য অপরাধের জন্য বিশেষ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হবে। ১২ আগস্ট 'দি টাইমসে' 'শেখ মুজিবের ভাগ্য শিরােনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'শেখ মুজিবুর রহমানের গােপনে বিচারের সিদ্ধান্ত খুবই দুঃখজনক। সম্পাদকীয়টিতে আরও বলা হয়, শেখ মুজিবই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সমস্যা সমাধানের জন্য কথা বলতে পারেন, যাতে পাকিস্তানে আরও বড় ধরনের ট্রাজেডি না ঘটে। সম্পাদকীয়টির শেষে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণ বাঁচানাের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলা হয়, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব সম্পর্কে এমন কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না যা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলবে।
 
১৯৭১ সালে ১৭ আগস্ট হেরাল্ড ট্রিবিউন'-এ উল্লেখ করা হয়, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাকে গভীরভাবে ভালবাসে এবং বিশ্বাস করে। এ সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা শাহী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিবের বিচার কোথায় হচ্ছে তা জানাতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপরাধে দুই সপ্তাহের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার হবে। পাকিস্তান সরকারের এ সব দম্ভোক্তি বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তােলে। বঙ্গবন্ধুর এ বিচারের বিরুদ্ধে কেবল বিদেশী রাষ্ট্রগুলােই যে সােচ্চার হচ্ছিল তা নয়, বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ ও বিভিন্ন সংগঠনও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট 'ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট'সহ ২১৫টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে এক টেলিগ্রাম বার্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন সামরিক বিচারে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানায়। জাতিসংঘ মহাসচিব উথান্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচারের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকারকে এ কাজ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিবের পরিণতি নিয়ে কোনরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে পাকিস্তানের বাইরে সর্বত্র ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। যার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট লন্ডনের 'দি ডন' পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'শেখ মুজিবের গােপন বিচারের অকল্পনীয় সিদ্ধান্ত ভারত উপমহাদেশে অধিকতর তিক্ততা, যুদ্ধ ও ধ্বংস ডেকে আনবে। ডন পত্রিকার এক খবরে ১১ আগস্ট থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু ও ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণের কথা বলা হয়। ১৪ আগস্ট পূর্ব জার্মান সরকার, ২০ আগস্ট' ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল, ২০ সেপ্টেম্বর আরব লীগ প্রতিনিধিসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এ বিচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তার মুক্তি দাবি করা হয়।
 
পাকিস্তান কারাগারে সামরিক আদালতে এ ধরনের বিচার প্রক্রিয়া যে সম্পূর্ণ অবৈধ, উদ্দেশ্য ও ষড়যন্ত্রমূলক দেশে-বিদেশের সকল মহল সহজেই তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ বােধ শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি শাসকদের রােষানল থেকে মুক্তির ব্যাপারে সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। তিনি জেলে থাকুন আর দূরে থাকুন, তিনি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা, জনগণের আশা-ভরসার প্রতীক তা সর্বজন গ্রাহ্য সত্য ও বাস্তবতায় মূর্ত হয়ে ওঠে। তাই পাকিস্তান সরকার ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

বইঃ বঙ্গবন্ধু- স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, ড. আনু মাহমুদ

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত