আমার দেখা মুজিব

4112

Published on জানুয়ারি 6, 2021
  • Details Image

সুফিয়া কামাল:

শেখ মুজিবুর রহমান যখন বঙ্গবন্ধু হননি, বলা যেতে পারে তার কিশোর বয়স থেকেই আমি তাকে জানি। সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাকে প্রথম দেখি কলকাতায়। তখন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সে। রাজনীতিতে সোহরাওয়ার্দীর খ্যাতি যখন তুঙ্গে, সেই সময় থেকে ছাত্রকর্মী ছাত্রনেতা হিসেবে মুজিবুর রহমানকে আমি চিনি। নেতা হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিত হয়েছে মুজিবুর রহমান। কিন্তু আমার কাছে আমার ছোট ভাইয়ের মতোই ছিল সে। বরাবর আমাকে ‘আপা’ বলে সম্বোধন করেছে। কাছে গেছি, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি। তারপর একই পাড়ায় থাকার কারণে মুজিবের সঙ্গে আমার একটি পারিবারিক সম্বন্ধের মতো গড়ে উঠেছিল।

মুজিবের কথা বলতে গেলে মুজিবের স্ত্রীর কথাও বলতে হয়। এত ধৈর্যশীল, এত শান্ত, এত নিষ্ঠাবতী নারী খুব কমই দেখা যায়। বছরে ১২ মাসের মধ্যে বেশির ভাগ সময় মুজিবের কেটেছে জেলে। যখনই শুনেছি মুজিবকে ধরে নিয়ে গেছে, ছুটে গিয়েছি। দেখেছি মুজিবের স্ত্রী অবিচল মুখে কাপড়, বিছানা, বালিশ গুছিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। বলেছে, আপনার ভাই তো জেলে গেছে। বেচারি খুব ধৈর্যের সঙ্গে সংসারটাকে টেনেছে। বাপকে জেলে নিয়ে গেছে বলে কোনো স্কুলে হাসিনাকে ভর্তি করবে না, এমনও দিন গেছে। নারী শিক্ষা মন্দিরে আমরা তাকে ভর্তি করে নিলাম। তখন নারী শিক্ষা মন্দিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম আমি।

একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে হেঁটে হেঁটে মুজিবের সঙ্গে গিয়েছি শহিদ মিনারে ফুল দিতে। মুজিব বলেছে, আহা, আমার বোনটা, আমার আপাটা এ-রকম করে হেঁটে যাবে? আপা, আপনি হেঁটে যাবেন না। আপনি রিকশায় যান। আমরা হেঁটে যাই।

আমি বলেছি, না ভাই, আমি হেঁটেই যেতে পারব। এভাবে মুজিবের সঙ্গে হেঁটে গিয়ে মিটিংয়েও যোগ দিয়েছি। আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। মুজিব সব সময় আমাকে বড় বোনের মতো আগে আগে সঙ্গে রেখেছে। রাস্তায় দেখা হলে গাড়ি থামিয়ে বলেছে, আপা, শিগগরিই আসেন, গাড়িতে আসেন।

আমি বলেছি, না ভাই, এইটুকুন পথ তো- এইখান থেকে এইখানে হেঁটে যেতে পারব।
মুজিব বলেছে, না, আমি পৌঁছে দিয়ে আসি। ড্রাইভারকে বলেছে, আমার বোনকে আমার বোনের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসো।

মুজিবের বাড়িতে গিয়েছি। শত মিটিং হলেও মুজিব এসে বলেছে, আপনি এসে আমাকে খবর দেন না কেন? আপনি সরাসরি আমার কাছে চলে আসবেন। আপনি এসে কেন নিচে বসে থাকেন? আমার বাড়ি আপনার বাড়ি। আমি আপনাকে বড় বোন বলে মনে করি।

মুজিব প্রতিদিন ভোরবেলা তার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে পায়ে হেঁটে এক চক্কর দিত। একদিন আমাকে দেখতে পেয়ে হাসতে হাসতে বলল, গতকাল মনে হলো যে আমার বাড়িতে তো পিঠা হচ্ছে, আপাকে একটা ডাক দেব নাকি। কিন্তু অত ভোরে আপাকে আর ডাক দিলাম না। তার আন্তরিকতা এমন ছিল যে আমাকে নিয়ে পিঠা খাওয়াবে।

আমার মেয়ের স্বামী আবদুল কাহার চৌধুরী চাটগাঁ রেডিওর অফিসার ছিল। একাত্তর সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মারা যায়। দেশে ফেরার পর মুজিব এ ঘটনা শুনল। বলল, কই, দুলু কোথায়? আমার মেয়ে বিধবা হলে যে-রকম কষ্ট পেতাম, ওর জন্যও আমি সে-রকম কষ্ট বোধ করছি। দুলু যা চায়, আমি ওকে সব দেব।

আমি বললাম, হাজারো মানুষ এ-রকম গেছে। আমার জামাইও গেছে। তার জন্য শুধু দোয়া করো। মুজিব আবার বলল, আপা, আমি আপনার কাছে হাতজোড় করে বলছি, আপনি বলেন, দুলুকে আমি কী সাহায্য করতে পারি?

আমি বললাম, ভাই, রক্তের বিনিময়ে আমার মেয়েকে কিছু দিতে হবে না। দেশের হাজারো মেয়ের মতো আমার দুলুও বিধবা হয়েছে। অনেক বিধবা তো আমার আশ্রয়েই রয়েছে। ওদের জন্য শুধু দোয়া করো।

এরপর যখন সে রাষ্ট্রপতি হলো, আমাকে বলেছে, একবার এসে আমাকে দোয়া করে যান। গাড়ি পাঠাল। আমি গেলাম। ওই প্রথম যাওয়া। ওই শেষ যাওয়া তার প্রেসিডেন্ট হাউসে।

তখন বাকশাল গঠিত হয়েছে। মুজিব বলল, একটা লোক পাচ্ছি না, যাকে আমি বাকশালের ভার দেব। আপা, আপনি যদি রাজি হন, তবে বাকশালের সভানেত্রী হয়ে থাকুন। আপনি যে-রকম বলবেন, সে-রকমই হবে।

আমি বললাম, ভাই, আমি রাজনীতি বুঝি না। আমাকে মাফ করো।

আমি তার সেই বাকশালে গেলাম না। কিন্তু যখনই কোনো মিটিং হয়েছে আমি মুজিবের সঙ্গে গিয়েছি। আগেও আমাকে বলেছে, আওয়ামী লীগের মহিলা কমিটি গঠন করে সেখানে আপনি সভানেত্রী থাকুন। সব সময় আমাকে সে সম্মানের পদ দিতে চেয়েছে। আমি বলেছি, ভাই, রাজনীতির মধ্যে আমি যাব না। অন্য যা বলবে আমি করতে পারব। রাস্তায় নামতে পারি কিন্তু রাজনীতির কোনো সংশ্রবে আমি থাকব না।
তখন মুজিব বলেছে, আপা, আপনাকে আমি মাথায় রাখব, না আপনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করব? আমি আপনার কাছে মিনতি করছি।
আমি বলেছি, ভাই, আমিও মিনতি করছি।

ধানমন্ডি পাড়ায় মুজিবের আগে আসি আমি। তাকে গ্রেফতারের সময়গুলোতে তার ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার বউ একটা বাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। এই দুর্দশার ভেতর দিয়ে মুজিবুর রহমান নেতা হয়েছে। মুজিবের ত্যাগের কোনো সীমা নেই। তার নিষ্ঠার কোনো পরিসীমা নেই। দেশকে যে সে কতখানি ভালোবাসত, তার পরিমাপ কোথাও নেই। মানুষের জন্য মমত্ববোধ, আত্মার একটা টান তার ছিল। আজকের দিনে তার মতো একটি মানুষ সারাবিশ্বে আমি দেখতে পাচ্ছি না। পলায়নি মনোবৃত্তি ছিল না মুজিবের। যেখানে সংকট, যেখানে সংগ্রাম, যেখানে সংঘাত দেখেছে, সে এসে আগে দাঁড়িয়েছে। মরণকে ভয় করেনি। তার পেছনে লাখো জনতা ‘মুজিব ভাই’ বলে লাফিয়ে পড়েই না এই দেশকে স্বাধীন করেছে।

বাঙালি আমাকে মারবে না- মুজিবের এই প্রবল বিশ্বাস ছিল বাঙালির ওপর। সেই বাঙালির হাতে মুজিব হত্যা হয়েছে। এই বাঙালি জাতির সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত কবে হবে, আমি জানি না। মুজিবকে আমি সারা অন্তর দিয়ে এখনও উপলব্ধি করি। সে যা দিয়ে গেছে- সোনার বাংলা; সেই সোনার বাংলায় এখন যারা আগুন জ্বালাচ্ছে, তাদের ধিক্কার দেওয়ার মতো ভাষা আমার নেই। মুজিবের দেশপ্রেমের আদর্শ নতুন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপ্ত হোক- এই প্রার্থনা করি আমি আল্লাহর কাছে।

লেখক : কবি; বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের পুরোধা এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি

সৌজন্যেঃ উত্তরণ (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত