442
Published on ডিসেম্বর 3, 2025জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন শাসকের হাতে রাষ্ট্র অপহরণ
বাংলাদেশ এখন তার সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যে সময় পরিবর্তনের কথা ছিল, তা এখন পরিণত হয়েছে আমাদের গণতান্ত্রিক ভিত্তি ভেঙে ফেলার ধীরগতির প্রক্রিয়ায়।
২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতা নেয়ার পর মুহাম্মদ ইউনুস একটি সিদ্ধান্ত নেন, যা সবকিছু বদলে দেয়— তিনি আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম স্থগিত করেন। এতে দেশের প্রায় ৪০% ভোটার কার্যত আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
এই এক নির্দেশেই জাতীয় নির্বাচন আর জাতীয় থাকল না; তা হয়ে গেল একটি সাজানো নাটক, যেখানে প্রকৃত প্রতিযোগিতা থাকারই কোনও সুযোগ নেই।
ইউনুস সরকারের অধীনে বাংলাদেশ তালেবানাইজেশনের ঝুঁকিতে
এটি কোনো ভুল বোঝাবুঝি নয়— এটি স্পষ্ট একটি ধারা।
দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তিকে সরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন উগ্র ইসলামী গোষ্ঠী আবারও এমন প্রভাব ও সুযোগ পাচ্ছে, যা বহু বছর ধরে তারা পায়নি। একই সময়ে নারীর অধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের ওপর চাপ, এবং জনজীবনে “নৈতিকতার পুলিশিং” দ্রুত বাড়ছে।
ধীরে ধীরে বাংলাদেশ এমন এক পথে হাঁটছে, যা অস্বস্তিকরভাবে পরিচিত লাগে— এক ধরনের ধীর, নীরব তালেবানাইজেশন, যেখানে রাস্তায় উগ্র সন্ত্রাসীরা নয়, রাষ্ট্রের শীর্ষে বসা একজন মানুষের সিদ্ধান্তই দেশকে বদলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে তালেবানাইজেশন এখন বাস্তব সংকট
সংখ্যাগরিষ্ঠকে চুপ করানো: তালেবানধারার শাসনের প্রথম ধাপ
আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম বন্ধ করা শুধু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ছিল না— এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন রাজনৈতিক অন্ধকার। একটি নির্বাহী নির্দেশে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তিকে অচল করে দিয়ে প্রায় ৪০% নাগরিকের কণ্ঠস্বর বন্ধ করে দেওয়া হলো। কোনো আলোচনা, জনমত ছাড়াই শুধু অবৈধভাবে পাওয়া সর্বোচ্চ ক্ষমতার চরম অপব্যবহার। আফগানিস্তানেও তালেবান সরকার জনসমর্থন দিয়ে নয়, বরং প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিষিদ্ধ করে, রাজনৈতিক সংগঠন দমন করে, এবং বিরুদ্ধমতকে একঘরে করে দিয়ে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
ইউনুস আর তালেবানের মধ্যে ভয়ংকর মিল দৃশ্যমান— আগে বিরোধী দলকে উপড়ে ফেলো, তারপর নিয়ন্ত্রিত, সাজানো বিরোধীদলের জন্য “রাজনৈতিক মাঠ খোলা” ঘোষণা করো।
আওয়ামী লীগকে মাঠের বাইরে সরিয়ে দিয়ে তিনি এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছেন যেখানে নির্বাচনের ফল আগেই ঠিক করা। এটি সরাসরি স্বৈরাচারী যুক্তি— প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারাতে না পারলে, প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দাও।
যখন দেশের ৪০% মানুষ ভোটাধিকার হারায়, তখন নির্বাচন অর্থহীন হয়ে যায়। গণতন্ত্র নাটকে পরিণত হয়। রাষ্ট্র আর বহুত্ববাদী প্রজাতন্ত্র থাকে না— বরং তালেবানধারার মতো শাসনের দিকে এগোয়, যেখানে ক্ষমতা কেন্দ্রায়িত হয়, বিরোধীরা চুপ করানো হয়, এবং জনগণের মতামতের তোয়াক্কা থাকে না।
এই নির্দেশ শুধু একটি রাজনৈতিক দলকে নয়— গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ধারণাকেই আঘাত করেছে।
এবং এটি প্রমাণ করে যে ইউনুস বাংলাদেশকে এমন এক পথে ঠেলে দিচ্ছেন, যা গণতান্ত্রিক বা ধর্মনিরপেক্ষ নয়— বরং উগ্র ইসলামী স্বৈরশাসনের সঙ্গে বেশি মিল।
ইউনুসের ইসলামপন্থী সমঝোতা: তালেবানাইজেশনের মূল চাবিকাঠি
যেখানে কোটি ভোটারের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, সেখানে আবার জামায়াত-হেফাজত সহ যে উগ্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বহু বছর লড়েছে— তাদেরকেই ইউনুস তার নতুন রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে তুলে নিচ্ছেন।
জনসমর্থন না থাকায় তিনি এখন ভরসা করছেন ধর্মভিত্তিক ও উগ্র ইসলামপন্থী শক্তির ওপর। একসময় সহিংস কার্যকলাপ ও উগ্র আদর্শের কারণে নিয়ন্ত্রিত এসব গোষ্ঠী এখন তার আশ্রয়ে নতুন বৈধতা পাচ্ছে।
রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভেতরেও এই পরিবর্তন স্পষ্ট। ধর্মনিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে ইসলামপন্থী ঘরানার লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন আরও বেশি ব্যস্ত আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ধরতে— বরং তাদের নজর নেই সেই উগ্র গোষ্ঠীর দিকে, যারা এখনো সংখ্যালঘু, নারী ও সংস্কৃতির ওপর হামলা চালাচ্ছে।
এর সামাজিক প্রভাবও দেখা যাচ্ছে— নারীদের খেলাধুলা বাতিল, নৈতিকতার নামে হয়রানি, মিডিয়া–সাংস্কৃতিক অঙ্গনে চাপ, বিশ্ববিদ্যালয়ে হেফাজত ধাঁচের নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া— সবই একে একে বাড়ছে।
এভাবেই তালেবানাইজেশন শক্ত ভিত তৈরি করে— একদিনে নয়, বরং ক্রমশ উগ্র শক্তির সঙ্গে আঁতাত, রাষ্ট্রযন্ত্র দখল, এবং মানুষের সামাজিক স্বাধীনতা ক্ষয় করে।
ইউনুস শুধু তাদের সহ্য করছেন না— তিনি তাদের ক্ষমতায়ন করছেন, তাদের অপকর্মের বৈধতা দিচ্ছেন। এদিকে বাংলাদেশকে এমন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, যা তালেবান শাসনের ছায়া আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
নির্বাচন সাজানো, ভবিষ্যৎ ঠিক করা: তালেবানাইজেশনের কিনারায় বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে, ইউনুস পরবর্তী নির্বাচনকে একটি সাজানো নাটকে পরিণত করেছেন। সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তিকে বাদ দিলে ফলাফল আর নির্বাচন নয়— কাগজে লিখে দেওয়া সিদ্ধান্ত মাত্র। বাহ্যিকভাবে ভোট হবে, কিন্তু ক্ষমতার সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া। এর পরিনাম হবে ভয়াবহ।
বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মুল্যবোধ এখন হুমকির সম্মুখীন। উগ্র শক্তিগুলো যখন রাজনৈতিক মঞ্চে জায়গা পাচ্ছে, তখন বাড়ছে অসহিষ্ণুতা, কমছে স্বাধীনতা, এবং সংখ্যালঘুদের জন্য হুমকি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
এ অস্থিরতা সীমান্তের বাইরে পর্যন্ত প্রভাব ফেলছে— আঞ্চলিক নিরাপত্তা দুর্বল হচ্ছে, এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ইউনুস বাংলাদেশকে এক বিপজ্জনক প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছেন। যা সামনে আসছে, তা শুধু ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন নয়— বরং তালেবানধারার একটি রাষ্ট্র তৈরির নীরব প্রক্রিয়া, যেটি গড়ে উঠছে বঞ্চনা, ভয়, এবং একটি সাজানো রাজনৈতিক ব্যবস্থা দিয়ে।