222
Published on জুন 18, 2025অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশে এক ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে—যেখানে একদিকে যেমন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত, বিচার বিভাগে স্বাধীনতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষাঙ্গনে অব্যবস্থা ও দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একতরফা আচরণ, ও তথাকথিত ছাত্রনেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এই সময়েই দেশের অর্থনীতিতে নেমে এসেছে স্থবিরতা, মন্দির-মাজার থেকে শুরু করে সিনেমা হল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক স্থানের অস্তিত্ব সংকট, এবং জঙ্গিবাদের বাড়বাড়ন্ত পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলেছে।
গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা করছে সরকার
সাংবাদিকতার এক্রিডিটেশন বাতিল, রাজনৈতিক দল ও সরকারের দিক থেকে নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত, আর ভয়ের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করতেও ভয় পাচ্ছেন—এসবই নির্দেশ করছে দেশ এখনো “স্বাধীন মিডিয়ার স্বাধীনতা” ফিরে পায়নি।
তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি) প২০২৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে ১৬৭ জন সাংবাদিকের এক্রিডিটেশন বাতিল করে। গত এপ্রিলে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করার জের ধরে দুইটি টেলিভিশন মিডিয়ার দু'জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়। একই ঘটনার জেরে আরেকটি চ্যানেল একজন সাংবাদিককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ।
মামলা, আইনি বাধা, মামলার ধাপ ও প্রেস আইডি বাতিলের মাধ্যমে সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ এখনও ‘সংকুচিত ও প্রতিকূল’—এমনটাই অভিমত প্রকাশ করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক নূরুল কবির, মতিউর রহমান চৌধুরী।
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন “যে দেশে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়—সে দেশে আমরা মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি? ... সাংবাদিকরা সেলফ-সেন্সরশিপ থেকে বের হতে পারছেন না।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির বলেন, 'সারাবিশ্বে যখন ঘটা করে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করতে হয়, তখন বুঝতে হবে যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। বাংলাদেশে বিগত সময়ের চেয়ে এখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পার্থক্য সূচিত হওয়ার লক্ষণ দেখা গেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে সূচক, বাংলাদেশ এখনও সেই সূচকের অনেক নিচে অবস্থান করছে। গণমাধ্যমকে বাধাগ্রস্ত করার প্রধান শক্তি রাজনৈতিক দলগুলো।'
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, "নভেম্বর পর্যন্ত সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে বিতর্কিত ভূমিকা রাখার অভিযোগে কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। এছাড়া, সরকারি দপ্তরগুলোতে সংবাদ সংগ্রহের জন্য ১৫০ জনেরও বেশি সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে। জাতীয় পতাকা অবমাননার জন্য পুলিশ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও করেছে।"
শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্গতি
ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিটি স্তরে সংকটে নিমজ্জিত। শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখতে উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে —শিক্ষক নিয়োগ, পরীক্ষা পুনর্গঠন, সংস্কার কমিশন গঠন—কিন্তু শৃঙ্খলা ও মান-উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। বরং পুরনো যান্ত্রিক শিক্ষায় ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি, শিক্ষক ও ছাত্রদের স্বার্থহানির অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবনতি—এসবই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বাস্তব সংস্কার ছাড়া শিক্ষাভবিষ্যৎ সংকটে যাচ্ছে।
২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সব না হলেও কিছু বই বছরের প্রথম দিনই উঠত শিক্ষার্থীদের হাতে।
এবার স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য ৪১ কোটি বিনামূল্যের বই ছাপানোর কথা রয়েছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীরা হাতে পেয়েছে ৬ কোটি বই। বাকি ৩৫ কোটি সময়মতো যায়নি।
এছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব এবিএম গাজী সালাউদ্দিন আহমেদ তানভীরকে নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে নেট দুনিয়ায় চলতি বছরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যবই ছাপানোর কাগজ কেনায় কমিশন-বাণিজ্য নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে তাঁর নাম এসেছে। দেশের একটি অনলাইন পোর্টালে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই নেটিজেনদের মাঝে তাঁকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা- সমালোচনা চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিকদলের নেতারও বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।
অনিয়মের পাশাপাশি নিম্নমানের কাগজে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছেপে শতকোটি টাকা অতিরিক্ত লোপাট করেছে প্রেসমালিকদের অসাধুচক্র। তাদের অপকর্মে পাঁচমাস পেরোনোর আগেই কিছু অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।তাই শিক্ষার্থীদের জন্য বাকি মাসগুলোয় এসব বই পড়া কষ্টকর হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় ২০২৬ শিক্ষাবর্ষেও মানহীন বই ছাপার প্রস্তুতি নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি।
ছাত্র ও শিক্ষক পদত্যাগ: অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অনেক শিক্ষক, বিশেষ করে যারা আওয়ামীলীগ সরকারের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত, তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার দাবিতে জোরপূর্বক পদত্যাগের ঘটনা ঘটে
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা
একদল শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে।
শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, সম্পূর্ণ পরীক্ষা নেয়া ছাড়া এভাবে ফলাফল ঘোষণা করলে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারেই দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষার সর্বস্তরে এমনকি কর্মজীবনে প্রবেশেও জটিলতা তৈরি হবে। স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল না করে বরং প্রয়োজনে পরীক্ষার্থীদের আরো সময় দেয়া, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করাসহ নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন শিক্ষকরা।
একইসাথে সামগ্রিকভাবে সব শিক্ষার্থীর জন্য পরীক্ষা বাতিল না করে, বিশেষ করে যেসব পরীক্ষার্থী আন্দোলনের সময় গুরুতর অসুস্থ বা চিকিৎসাধীন রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষা গবেষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা
শান্তি ও প্রশাসনের সংকট: উপাচার্য ও প্রশাসনিক শীর্ষপদের ৪৬ জন পদত্যাগ, কেউ কেউ হুমকি ও লাঞ্ছনার মুখে ছিলেন।
ক্লাস ও পরীক্ষা স্থবিরতা: আগস্টের পর থেকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা সম্পূর্ণভাবে চালু হয়নি
নিয়োগ ও প্রশাসনিক সংকট: মাউশি–সহ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সংস্থায় শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘ শূন্যতা থেকে চলতি নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দিয়েছে
দুর্নীতি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনই আজ পরিণত হয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির দুর্ভেদ্য দুর্গে।
১. চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মানববন্ধন
গত ১২ জুন, গাইবান্ধায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নামে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের চাঁদাবাজির প্রতিবাদে শহরের ডিবি রোডে তারা মানববন্ধন করে।
২. আদর্শের পতন ও পদত্যাগ
গত ৮ মে রংপুর শহীদ মিনারে এক সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগ করেন সংগঠনের জেলা কমিটির সদস্য মাহমুদুর রহমান লিওন।
তিনি অভিযোগ করেন, জেলা আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব চাঁদাবাজি, মামলার তদবির ও সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।
৩. ২০ লাখ টাকার চাঁদা দাবির ভিডিও ভাইরাল
টঙ্গীতে এক কারখানায় বিশৃঙ্খলার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতা গ্রেফতার হন। একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তিনি স্থানীয়দের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।
৪. উপদেষ্টার দপ্তরে দুর্নীতির ছায়া
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সাবেক এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যে শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক।
এছাড়া সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের বিশেষ সহকারী (পিএ) আতিক মোর্শেদের আতিক মোর্শেদের বিরুদ্ধে ১৫০ কোটি টাকা বেহাতের অভিযোগ উঠেছে। নাহিদ ইসলামের পরামর্শেই আতিক মোর্শেদ এসব কাজে জড়িত কি না- এমন প্রশ্ন তুলেছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন।
এই সব ঘটনায় প্রমাণ হয়, “বৈষম্যের বিরুদ্ধে” বলা আন্দোলন আসলে ক্ষমতা, প্রভাব, ও পৃষ্ঠপোষকতার আশ্রয়ে এক ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দখলদারিত্বে পরিণত হয়েছে।এতে করে সত্যিকারের আন্দোলন, সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনগণের ওপর প্রভাব ফেলছে ভয়াবহভাবে।
নড়বড়ে অর্থনীতি
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়েছে। বাজেট বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে শ্রমবাজার পর্যন্ত সবখানে স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আর্থিক নীতির অসামঞ্জস্যতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস-জানুয়ারি ২০২৫ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে মাত্র ৪.১% —যা গত বছর ৬–৭% প্রবৃদ্ধির তুলনায় বেশ কম।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ ও শিল্পোৎপাদন এই সময় খুবই ধীর ছিল—যা প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে । বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালে মুদ্রাস্ফীতি ১০.৩৪%–এ ওঠে—যা পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়েছে এবং এ কারণে বেসরকারি খরচে হ্রাস, অর্থনীতিকে ব্যাহত করেছে ।
পোশাক খাতে কারখানা বন্ধ ও শ্রমবাজারে ধস
প্রথম আলো জানিয়েছে, গত ৭ মাসে গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ৯৫টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে, যার ফলে প্রায় ৬২ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।
মানবজমিনের একটি প্রতিবেদন বলা হয়, গত বছরের আগস্ট মাসের পর প্রায় শতাধিক কারখানা স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। এতে কাজ হারিয়েছেন ৬০ হাজারের অধিক শ্রমিক। অন্যদিকে দেশে অর্থনৈতিক সংকট সহ নানা উত্থান-পতনের মধ্যেও রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পে নতুন নতুন কারখানাও চালু হয়েছে। এতে কর্মসংস্থানও বেড়েছে। তবে কারখানা বন্ধ ও খোলা শিল্পের কার্যক্রমের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে করেন শিল্প উদ্যোক্তারা। বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও শিল্প পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে বৈশ্বিক অর্ডার কমে যাওয়া, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মূল্যস্ফীতি, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, অর্থ পরিশোধে বিলম্ব এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনসহ একাধিক কারণ উল্লেখ করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
যুগান্তের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি এখন সংকটময় অবস্থায় রয়েছে। আগামীতে আরও সংকটের মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কা আছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হচ্ছে। এ কারণে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে।
অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী আরও বেশি সংকটে পড়ছে।
জঙ্গিবাদের উত্থান, মাজার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা
বিশ্ব সুফি সংস্থা গত জানুয়ারিতে জানায়, গত ছয় মাসে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে জঙ্গিবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশজুড়ে ৮০টি মাজার, দরবার ও ধর্মীয় স্থানসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছে বিশ্ব সুফি সংস্থা।
জাতীয় প্রেসক্লাবে বিশ্ব সুফি সংস্থার এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এসব হামলার পেছনে কারা রয়েছে তা স্পষ্ট না হলেও, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করা হয়েছে।
ঢাকার উত্তরায় বসন্ত উৎসবসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান একদল ‘তৌহিদী জনতা’ নামের গোষ্ঠীর বাধার মুখে পণ্ড হয়েছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে পহেলা ফাগুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উদযাপনের সময় নানা স্থানে এসব ঘটনা ঘটেছে, যার বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
বরিশালে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রাম নবমী উৎসব উপলক্ষে ‘রামায়ণ’ নাটক প্রদর্শন বন্ধ করে দেয় পুলিশ। আয়োজকদের দাবি, হামলার হুমকি ও নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে পুলিশ বলেছে অনুমতি না নেওয়ায় প্রদর্শন বন্ধ করা হয়েছে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের পতনের পর ইসলামি কট্টরপন্থিরা বাংলাদেশে নতুন করে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। নারীদের প্রতি বিদ্বেষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আহমদিয়াদের ওপর হামলা ও বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের কর্মকাণ্ড প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়া, নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের প্রকাশ্য কর্মসূচিও জঙ্গিবাদের উত্থানের একটি উল্লেখযোগ্য ইঙ্গিত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে হলেও কার্যকর ও দৃশ্যমান ফলাফল পাওয়া যায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে জঙ্গিবাদ কার্যকলাপে ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে যা দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামোর জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বন্ধ হচ্ছে না ‘মব সন্ত্রাস’, বাড়ছে আতঙ্ক-উদ্বেগ
১৩ মে রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শাহারিয়ার আলম সাম্যকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। সাম্য ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঘটনার পর পুলিশ দ্রুত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে; তামিম হাওলাদার (৩০), পলাশ সরদার (৩০) ও সম্রাট মল্লিক (২৮)। তবে তাদের গ্রেপ্তারের পর তামিমের গ্রামের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল লোক, যা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নির্দেশ করে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম জানিয়েছেন, মব হামলা বন্ধ করা শুধু পুলিশের পক্ষে কঠিন; সবার সম্মিলিত চেষ্টা প্রয়োজন। অভ্যুত্থানের ৯ মাস পরও পুলিশের ওপর নিয়মিত মব হামলা হচ্ছে। এপ্রিলে ৩৭টি এবং মার্চে ৩৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশ মব তৈরি করে সংঘটিত।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ১১৯ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। গত বছর ১৭৯ জন নিহত হয়েছিলো এ ধরনের ঘটনায়, যা গত দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক সহিংসতা ও মবের ঘটনা বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে দলের কর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, হিন্দু সংখ্যালঘুর ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে।
একাধিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদে মব তৈরি ও হামলা সংগঠিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেছেন, “রাজনৈতিক নেতারা অপরাধীদের রক্ষা করলে আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থা ব্যাহত হয়।”
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইরানের দুই নাগরিককে ছিনতাইকারী সন্দেহে মারধর, বগুড়ায় একটি চিকিৎসককে মারধরসহ মবের কারণে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা এবং সাংবাদিক ও শিল্পীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে গণমাধ্যমে ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’ বেড়ে গেছে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ মবের হুমকির কারণে সাংবাদিকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। পুলিশের উপদেষ্টা ফয়েজ আহমেদ বলেছেন, “অপরাধ কমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।”
নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও মিথ্যা মামলা
বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে—জামিনহীন বিচার, স্বেচ্ছাচারিতা ও নিপীড়ন চলছে, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের মৌলিক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
রাজধানীর বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (পিজি হাসপাতাল) নাক কান গলা বিভাগের চিকিৎসক হাসানুল হক নিপুন। শাহবাগ থানায় দায়ের করা প্রশ্নবিদ্ধ একটি মামলার তিনি আসামি। মুন্সীগঞ্জের ইসমাইল হোসেন মামলাটির বাদী। এজাহারে বাদী কারো নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করেছেন।
তবে ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ৫৫ দিন কারাবাস করেন নিরপরাধ এই চিকিৎসক। চিকিৎসক নিপুনের দাবি, মিথ্যা অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে হামলা ও ভাঙচুরের মামলা করা হয়। পরে কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনার সময় এবং মামলার এজাহারের বর্ণনা সম্পূর্ণ ভুয়া।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনায় করা এ ধরনের অন্তত ৩৫টি মামলার খোঁজ পাওয়া গেছে। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হয়রানিমূলক এসব মামলায় কাকে আসামি করা হবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে ভূমিকা রেখেছেন একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। সেই সঙ্গে এই মামলাগুলোকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবী, কোনো কোনো দলের নেতাকর্মী এবং একটি দালাল সিন্ডিকেট দেশজুড়ে বিপুল মামলা বাণিজ্য শুরু করেছে। মামলাপ্রতি এরা লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করছে।
আবার কোথাও প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে, ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এসব মামলা করা হচ্ছে। এসব মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী দেশে বেশির ভাগ হত্যা মামলা তদন্তে তাঁদের অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করতে যেটি অপরিহার্য—নিহত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটি এখনো করা হয়নি। এ ছাড়া হত্যা মামলা করার ক্ষেত্রে এজাহারে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। আসামিদের নামের পাশে হুকুমদাতা বা নির্দেশদাতা উল্লেখ করা হচ্ছে।
আবার যাদের গুলি করে হত্যার কথা বলা হচ্ছে, নির্দিষ্ট করে এজাহারে বলা নেই কে তাদের গুলি করে হত্যা করেছে। আইনগত অনেক ফাঁকফোকর থাকায় তদন্তে অনেক সময় লাগছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যা মামলা করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। এ পর্যন্ত যেসব মামলা হয়েছে, তাতে বেশির ভাগ আসামির ক্ষেত্রে ‘হুকুমদাতা ও নির্দেশদাতা’ উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এ ধরনের মামলা টেকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া এলাকার সোলায়মান সেলিম নামের এক ব্যক্তি দাবি করছেন, জুলাই আন্দোলনে তাকে মৃত দেখিয়ে হত্যা মামলা হয়েছে। তার ঠিকানায় পুলিশ তদন্তে গেলে নিজের 'ভুয়া মৃত্যু' ও হত্যা মামলার ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারেন।
জীবনের নিরাপত্তার শঙ্কা থেকে স্থানীয় থানায় সম্প্রতি একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন সেলিম।
তেসরা অগাস্ট ঢাকার কাজলা এলাকায় গুলিতে মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ করে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলাটি রুজু করা হয়। ওই মামলার বাদী সেলিমের আপন বড় ভাই।
যাত্রাবাড়ী থানায় সেলিম হত্যা মামলায় প্রধান আসামি শেখ হাসিনা। এছাড়া ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান কামাল, শামীম ওসমানসহ ৪১ জনের নামে এবং অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও দেড়শ থেকে দুশ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক নতুন প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, যেমন "স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতা" বন্ধ করতে হবে। নইলে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত কিছু "গুরুত্বপূর্ণ'' পদক্ষেপ ব্যাহত হতে পারে।
এতে বলা হয়, পুলিশ আবারো স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন বাছ-বিচার ছাড়াই ফৌজদারী মামলা দায়ের করছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ যেকোনো ব্যক্তিকে যে কোনো অবস্থায় হয়রানি করার অবাধ সুযোগ পাচ্ছে।
সংকটজনক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
জুলাই অভ্যুত্থান ও পরবর্তী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এইচআরডব্লিউ এক প্রতিবেদনে বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সেই পুরোনো নিপীড়নমূলক ভূমিকায় ফিরেছে, যা বাংলাদেশের জন্য "সংকটজনক"।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গণহারে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গণগ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার মতো ভূমিকা থেকে সরে আসার পাশাপাশি প্রতিশোধমূলক গ্রেপ্তার বন্ধ করতে বলেছে এইচআরডব্লিউ।
পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধে সংস্কার এবং বেসামরিক তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করে সংস্থাটি।
একই সাথে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে খামখেয়ালিভাবে ভিন্নমত দমনে যাকে-তাকে মামলায় আসামি করা ও মোটাদাগে অভিযোগ আনার সংস্কৃতি থেকে থেকে বের হয়ে আসার কথা বলেছে এইচআরডব্লিউ।
কেউ গ্রেপ্তার হলে তাকে দ্রুত ও নিরাপদে বিচারকের সামনে হাজির করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আদালতকে ভূমিকা রাখার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। ()
সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে মামলা, জামিনে বিলম্ব ও তদন্ত ছাড়াই গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
অপারেশন ডেভিল হান্টঃ
সারাদেশে চলমান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের শত শত নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হওয়ায় রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগ ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ অভিযানে এখন পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাদের বড় একটি অংশ বর্তমান সরকারের অনুসারী।
গাজীপুরে সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলার পর ছাত্র আন্দোলনের দাবিতে শুরু হওয়া এ অভিযানে সবচেয়ে বেশি গ্রেপ্তারও গাজীপুরেই—মাত্র পাঁচ দিনে ৩৩২ জন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোমিনউদ্দিন ভান্ডারির মতো বয়স ও অসুস্থতায় ভুগছেন এমন নেতারাও বাদ পড়েননি। পরিবারের অভিযোগ, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দলীয় নেতাদের বাড়ি বাড়ি অভিযান, সাদা পোশাকে গভীর রাতে গ্রেপ্তার এবং জামিনে বাধা তৈরি করছে এক ধরনের আতঙ্ক। আইনজীবীরাও রক্ষা পাচ্ছেন না—বলা হচ্ছে, তারা ভয়ের কারণে মামলায় দাঁড়াতে সাহস করছেন না।
আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রশ্ন, “অপরাধীরা শাস্তি পাক আমরা চাই। কিন্তু আওয়ামী লীগ করলেই যদি অপরাধী হওয়া যায়, তাহলে কি এটি রাজনৈতিক প্রতিশোধ?”
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, “এই অভিযানে দেখা যাচ্ছে, মূলত বিগত সরকারের লোকজনই গ্রেপ্তার হচ্ছেন। এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে।”
সরকার বলছে, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযান, তবে গ্রেপ্তার তালিকায় সরকারি দলের নেতাকর্মীদের আধিক্য নিয়ে তৈরি হচ্ছে রাজনৈতিক সংকেত ও উদ্বেগ।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কাল এক গভীর অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে—যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সংকুচিত, অর্থনৈতিক গতি স্থবির এবং নাগরিক অধিকার হুমকির মুখে। রাষ্ট্রযন্ত্রের একতরফা প্রয়োগ, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা ও বিচার ব্যবস্থার উপর রাজনৈতিক প্রভাব এবং ‘বৈষম্যবিরোধী’ আন্দোলনের নামে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার—সব মিলিয়ে দেশে এক প্রকার ভয়াবহ দমনমূলক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তা না হলে বাংলাদেশ শুধু একটি সাময়িক রাজনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে—যার খেসারত দিতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও।