সাংবিধানিক কর্তব্য, ন্যায়বিচার এবং জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা

18

Published on মে 29, 2025
  • Details Image

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিচার বিভাগ কেবল আইনের ব্যাখ্যাই করে না, বরং সংবিধানের রক্ষক হিসেবেও কাজ করে। জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা, নির্বাহী ও আইনসভার ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করা এবং ন্যায়সঙ্গত সামাজিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা - এই সবই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কি এই সাংবিধানিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে?

উত্তরটি দুঃখজনকভাবে নেতিবাচক। বিচার বিভাগ আজ রাজনৈতিক চাপ, প্রশাসনিক প্রভাব এবং নিরাপত্তাহীনতার চক্রে আটকা পড়ে আছে। ফলস্বরূপ, আদালত আর সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল নয় - বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

বিচার বিভাগের সাংবিধানিক দায়িত্ব

বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৪(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে - "বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে।" এটি কেবল একটি শব্দ নয়, বরং রাষ্ট্রের একটি মৌলিক অঙ্গের জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত। বিচার বিভাগ যদি স্বাধীনভাবে কাজ না করে, তাহলে সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র একটি নিপীড়ক যন্ত্রে পরিণত হয়।

একটি ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্র গঠনে, বিচার বিভাগ জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে পারে যেখানে অন্যান্য সমস্ত অঙ্গ ব্যর্থ হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বিচার বিভাগ নিজেই অনেক ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের ছায়ায় পরিণত হয়েছে।

সাহসী বিচারকদের অনুপস্থিতি

আমাদের ইতিহাসে অনেক সাহসী বিচারক রয়েছেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী থেকে শুরু করে বিচারপতি মো. হাবিবুর রহমান পর্যন্ত, তারা বিভিন্ন সময়ে আইনের শাসনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বিচারকরা মূলত নীরব, অনুগত এবং "ব্যবস্থার অংশ" হয়ে উঠেছেন।

আজ, যখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করা হচ্ছে, এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে - তখন আমাদের বিচার বিভাগ নীরব। এই নীরবতা কি ভয়ের ফলাফল? নাকি এটি বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ?

যখন একজন বিচারক সাহস দেখানোর চেষ্টা করেন, তখন তাকে বরখাস্ত, পদোন্নতি বা তদন্তের হুমকি দেওয়া হয়। ফলস্বরূপ, বিচারকরা ন্যায়বিচারের পথ নয় বরং আত্মরক্ষার পথ বেছে নিচ্ছেন।

সরকার কি বাধা দিচ্ছে?

প্রশ্ন উঠছে—সরকার কি বিচার বিভাগকে তার দায়িত্ব পালন করতে দিচ্ছে না? দুর্ভাগ্যবশত, বাস্তবতা বলছে—না।

* বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য দেখা যায়।
* বিচার বিভাগের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে।
* গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলি "মনোনীত" বেঞ্চে পাঠানো হয়।
* অনেক বিচারককে সরকারি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে—নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য, রাজনৈতিক গ্রেপ্তারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য, এমনকি মিডিয়া সেন্সরশিপকে বৈধতা দেওয়ার জন্য।

ফলস্বরূপ, বিচার বিভাগ আর জনগণের নয়—বরং সরকারের একটি অনুগত শাখা হয়ে উঠছে।

জনগণের আস্থা এবং ন্যায়বিচারের শেষ অবলম্বন হ্রাস:

মানুষ শেষ আশার আলো হিসেবে আদালতে যায়। কিন্তু যখন সেই আদালত রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হয়, অথবা মৌলিক অধিকারের মামলায় ন্যায্যতা নিশ্চিত করে না, তখন জনগণ কোথায় যাবে? এই পরিস্থিতি কেবল ন্যায়বিচারের অপমানই নয়—এটি একটি জাতির মনোবলের তীব্র অবক্ষয়।

বিচার বিভাগের এই দুর্বলতা এবং সাহসী বিচারকদের অনুপস্থিতি আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য একটি বিপজ্জনক সংকেত। সরকার যদি সত্যিই জনগণের সেবা করতে চায়, তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

* সাহসী বিচারকদের নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে,
* বিচারক নিয়োগে দলীয় প্রভাব বন্ধ করতে হবে,
এবং সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করতে হবে।

যতক্ষণ না রাষ্ট্র তার বিচার বিভাগকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেয়, ততক্ষণ জনগণ সুরক্ষিত থাকবে না এবং সংবিধান কেবল কাগজে লেখা একটি 'আদর্শ' হিসেবেই থেকে যাবে।

আজ, আমরা বিচার বিভাগের কাছে একটি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই - আপনি কি ইতিহাসের পাশে দাঁড়াবেন, নাকি ক্ষমতার ছায়ায় অদৃশ্য হয়ে যাবেন?

লেখকঃ সাখাওয়াত হোসেন, মার্কিন প্রবাসী ব্যবসায়ী, প্রাথমিক সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত