237
Published on জুলাই 7, 2024বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ভারতীয় উপমহাদেশে একটি প্রাচীন রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের ইতিহাস সংগ্রাম, সৃষ্টি, অর্জন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস। বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে দলটির। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগ গত ৭৫ বছর ধরে রাজনীতির অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্ট হওয়ার পর পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ তৎকালীন অনেক নেতাকে সংগঠন ছাঁড়তে বাধ্য করেছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত এক রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দিনটি অন্যরকম তাৎপর্য বহন করে। কারণ, এই দল ও বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং বিশে^র বুকে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে।
রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ গঠন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন: “আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের কোনো কর্মপন্থাও নাই।” আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে। ...সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী [মুসলীম] লীগ।’ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২০-১২১)।
বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার চেতনামূলে ছিল আওয়ামী লীগ। ভৌগলিকভাবে দুটি ভূ-খন্ড পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকার পরেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বঞ্চনা পূর্ব-পাকিস্তানীদের মনে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধের যোজনা তৈরি করে। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর মত জাঁদরেল নেতা থাকা সত্ত্বেও পূর্ব-পাকিস্তান এবং পশ্চিম-পাকিস্তান যে এক নয় তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখাকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে কেউই পারেননি।
স্বল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের নেতৃত্বের অগ্রভাগে চলে আসেন। পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতর প্রতিষ্ঠা লাভ করায় আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার শুরুতে নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দ যুক্ত রাখতে হয়েছিল। তবে ১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে (তখন তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক) দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সব ধর্মের মানুষের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগে ৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ‘ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। ‘ছাত্রলীগ’ ও ‘আওয়ামী লীগ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বীজ রোপিত হয়। ৪৮-এর ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের উদ্যোগে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ব বাংলায় সফল ধর্মঘট পালিত হয়।
সূচিত হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে রাজপথে পাকিস্তানি পুলিশ কর্তৃক নির্বিচারে ছাত্র হত্যার আগে আওয়ামী লীগই ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা অ্যাকশন কমিটি’ গঠনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কথা ছিল, “বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্নজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তত আছি।” (প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০)। এক্ষেত্রে, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করা যেতে পারে: ...পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ যে নেতৃত্ব দিয়েছে, পূর্ব বাংলার লোক কোনদিন তা ভুলতে পারবে না। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার আপনারা করেছেন এদেশের মানুষ চিরজীবন তা ভুলতে পারবে না। আপনারাই এদেশে বিরোধীদল সৃষ্টি করেছেন। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না (প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৬)।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠালগ্ন হতেই বাঙালিদের স্বার্থের সত্যিকার ও আপসহীন প্রতিনিধি। তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানের সর্ব প্রথম কার্যকর বিরোধী দল। যে আশা-আকাঙ্খা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালিরা সর্বাত্মক সমর্থন জ্ঞাপন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিল, ১৯৪৭ সালে পূর্ব-পাকিস্তান রূপ লাভ করেও এ অঞ্চলের মানুষ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত ছিল। কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় বাঙ্গালীদের অংশগ্রহণকে অস্বীকার করার পাশাপাশি বাংলা ভাষা তথা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপরেও খড়গ হস্ত হলো পশ্চিম-পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী। ১৯৫০-৬০ এর দশকে প্রণীত পাকিস্তানের উন্নয়নের রূপরেখায় পশ্চিম-পাকিস্তানকে একচেটিয়া প্রাধান্য দেয়া হলো।
অর্থনৈতিক নীতিমালার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের সম্পদ দিয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানে শিল্পায়ন এবং পূর্ব-পাকিস্তানের প্রশাসন ও ব্যবসায় অবাঙ্গালীদের প্রতিষ্ঠা করা। পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেছিলেন ‘ফাঁকির স্বাধীনতা’ বলে। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের অবস্থা দাঁড়ায়, বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘এক শকুনির হাত থেকে আরেক শকুনির হাতে পড়া’র মতো (বাংলাদেশের গণপরিষদের কার্যবাহের রিপোর্ট, ১৯৭২, পৃ. ২)।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনকালীন যুক্তফ্রন্ট গঠনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই যুক্তফ্রন্টের অন্য দলগুলো ছিল কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজাম-ই-ইসলাম পার্টি এবং গণতান্ত্রিক দল। যুক্তফ্রন্ট ২১-দফা এজেন্ডা প্রচারের মাধ্যমে নির্বাচনে জনগণকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। এতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য বঙ্গবন্ধু ১৫ মে সমবায়, ঋণ ও গ্রামীণ পুনর্গঠনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন; কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী অন্যায়ভাবে ৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার বরখাস্ত ও বঙ্গবন্ধুকে কারারুদ্ধ করে। ১৯৫৬-তে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৩-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর ১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগকে তৃণমূল পর্যায় থেকে শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে বাঙালির জাতীয় মুক্তির মঞ্চে পরিণত করতে তিনি সর্বশক্তি নিয়ে আত্মনিয়োগ করেন। এমনকি এজন্য ১৯৫৭ সালে মন্ত্রিত্বের পদ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে নিজেকে বহাল রেখেছিলেন। তার কাছে দলের দায়িত্ব মন্ত্রিত্বের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জেনারেল আইয়ুবের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে (১৯৫৮-১৯৬৯) পূর্ববঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করে। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচিত হয়ে দলকে পাকিস্তানের অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন। ৬ দফার প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু এই দাবির মাধ্যমেই সর্বপ্রথম এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্বকে তুলে ধরেন। “৬ দফা দাবি” পেশ করার পর তৎকালীন স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর জেল-জুলুম ও নির্যাতন চালান।
তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের মে মাস থেকে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। সেই সময়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে সমগ্র পাকিস্তানজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ ও ১৯৬৯ এ গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। এতে আইয়ুব খান ক্ষমতা ভার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে হস্তান্তর করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ (আইনি কাঠামো আদেশ) কার্যকর করার পরে শেখ মুজিব একটি বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে যুক্ত-রাষ্ট্র গঠনের একটি রূপরেখা প্রস্তাব করেন এবং পাকিস্তানের জনগণকে সংবিধান গঠনে তাকে এবং আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার আবেদন জানান। নির্বাচনের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত হবে তারাই সংবিধান রচনা করবেন এবং সেই সংবিধানের ভিত্তিতে পাকিস্তান পরিচালিত হবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়।
ইয়াহিয়া খান নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন। এ অঞ্চলের মানুষকে বঙ্গবন্ধু যে স্বায়ত্তশাসন, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে উদ্বেলিত করেছিলেন, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি এ অঞ্চলের মানুষ পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধ্বস বিজয় পায়। জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৩৮টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পায় ৮১টি আসন। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০ আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী বা মান্ডেট পাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তখন নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
যখন ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের অধিবেশন এক তরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়, তখনই পূর্ব বাংলায় দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে। লাখ লাখ লোক রাজপথে নেমে আসে। শুরু হয় ১ দফা তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেন এবং বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত করতে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে সার্বিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে বলেছিলেন, 'প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক সাব-ডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো,' এবং বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার’ আহ্বানের মধ্য দিয়ে সে সময়ের বাঙালি জনগণের চেতনা ও সার্বভৌম ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। জনগণের সার্বভৌমত্বের এই চরম প্রকাশ সম্ভব হয়েছে বহুধাবিভক্ত বাংলাদেশের জনগণকে একত্রিত করে মুক্তি ও স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার কারণে। এই কারণের পেছনে এদেশের আপামর জনগণের পাশাপাশি, উল্লেখযোগ্য হিসেবে অনেক স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী, নেতা ও ঘটনা জড়িত থাকলেও একজন বঙ্গবন্ধুই এই সবকিছুকে সফলভাবে সমন্বয় করতে ও নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে পেরেছিলেন।
বাংলাদেশে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান স্বকীয়তায় ভাস্বর। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি এ দেশের জনগণকে ‘আমার মানুষ’, ‘বাঙালি’ প্রভৃতি অভিধায় সম্বোধন করে তাদের দুর্দশা বা তাদের রক্তঝরা সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন। এই ভাষণে তিনি জনগণের ওপর শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণ এবং এর প্রতিবাদে বাঙালিদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় তাঁর নিজের সুদীর্ঘ সংগ্রামী প্রচেষ্টার কথা অনবদ্যভাবে বর্ণনা করে স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। শুধু এই ভাষণই নয় বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনই প্রকৃতপক্ষে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল উৎসর্গীকৃত।
একদিকে জনগণের সার্বভৌমত্বে আস্থাবান বাঙালি ও তাদের সমর্থকরা, অন্যদিকে অস্পষ্ট এবং অব্যাখ্যাকৃত চেতনায় উদ্বুদ্ধ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকরা এক ব্যাপক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। রাষ্ট্র্র্র ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এই যুদ্ধ ছিল অনিবার্য। কারণ জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ব্যতীত রাষ্ট্র্র্র পরিচালনায় রাজনৈতিক বৈধতা আসে না। সে হিসেবে একাত্তরে বঙ্গবন্ধু যে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন সেই যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থায় বৈধতা আনা।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা, তাঁকে রাষ্ট্র্র্রপতি করে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ গঠিত মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে স্বাধীন বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। জনগণের সার্বভৌমত্বে আস্থাবান বাঙালি জয়লাভ করে। এরই সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার অন্তর্নিহিত চেতনা এবং বাঙালি ও বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ লালিত নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন ঘটে।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার তাৎপর্য এখানেই। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলেও বঙ্গবন্ধু তখনো বন্দি ছিলেন পাকিস্তানি হায়েনাদের কারাগারে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ রাতে মুক্ত হন। মুক্তি পাওয়ার পরই তিনি যেতে চেয়েছেন সদ্য স্বাধীন হওয়া তার স্বপ্নের বাংলাদেশে। কিন্তু জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সেটা সম্ভব ছিল না। সম্ভব ছিল না প্রতিবেশী রাষ্ট্র্র্র ভারতের আকাশসীমা ব্যবহার করার। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে তৃতীয় দেশ হিসেবে ইরান অথবা তুরস্ককে বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু তা নাকচ করে দেন। তাঁকে লন্ডন হয়ে পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। কারণ বাংলাদেশের পর সবচেয়ে বেশি বাঙালির বসবাস তখন ব্রিটেনে। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন লন্ডনকে।
বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা অনুযায়ী এই সংবাদ পাকিস্তান প্রচার করেনি। বঙ্গবন্ধু নিজেই বিশ্বকে জানাতে চেয়েছিলেন তাঁর মুক্তির বার্তা, বিজয়ের বার্তা, সার্বভৌমের বার্তা। বিশেষ বিমানে পরের দিন ভোরে লন্ডন পৌঁছেন। ৮ তারিখ সন্ধ্যায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বৈঠক করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে। লন্ডন থেকে দেশে ফিরলেন দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি। দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক সংবর্ধনায় উপস্থিত ছিলেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্র্র্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রীপরিষদের অনেক সদস্য ও লাখো ভারতবাসী।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার সময় মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশে অবস্থান করছিলো।
স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য এবং গৌরবোজ্জ্বল। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বঙ্গবন্ধু কখনও কার্পণ্য করেননি। তখন একটি গুজব খুব প্রচলিত ছিল যে, দেশ থেকে সোনা, রূপা, তামা, পীতলসহ তৈজসপত্র, গাড়ি ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিপুলাকারে সীমান্তের ওপারে চলে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এসব অভিযোগ শুনছিলেন। উভয় সংকটে পড়লেন তিনি। কারণ এমন গুজব এবং রটনা যেকোনোভাবেই হোক সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। ভারতীয় বাহিনীকে স্বদেশে ফেরানো সে সময়ের বাস্তব প্রেক্ষাপটে বেশ জটিল ব্যাপার ছিল। সরকারের ও দলের নেতারা বিচলিত, কীভাবে সেনাবাহিনী ফেরাবেন তা বোধগম্য হচ্ছিল না কারোরই।
এমন অবস্থার মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ কলকাতা সফরে যান। দমদম বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে সৈন্য ফিরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধুর কথায় ইন্দিরা গান্ধী এর কারণ জানতে চান। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র্র্র। পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতীয় সৈন্যরা থাকলে এই অপপ্রচার লোকজন বিশ্বাস করবে।’ এরপর ইন্দিরা গান্ধী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘আপনার আগামী জন্মদিনের আগেই ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নেয়া হবে। ১৭ মার্চ ছিলো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ইন্দিরা গান্ধী মার্চে ঢাকায় এসেছিলেন। তার আগেই ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে নেয়া হয়। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই অনেকগুলো দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় (মোহাম্মদ জমির, ২০১৯)।
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে গুজব রটনাকারীদের অপচেষ্টার জবাব বঙ্গবন্ধু এ ভাবেই দিয়েছিলেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো গঠনে সহায়তা করার জন্য ভিনদেশী পরামর্শক বা জনবল সহায়তা গ্রহণ বঙ্গবন্ধুর কাছে খানিকটা স্পর্শকাতর ছিল। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের তেজ ছিল বঙ্গবন্ধুর মজ্জাগত। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রয়োজনে ভারতের সাহায্য নিয়েছি এবং তা কৃতজ্ঞচিত্তে সর্বদা স্বীকার করা হবে। কিন্তু সার্বভৗম বাংলাদেশ কারো আঙ্গুলি হেলানে পরিচালিত হবে না।
বর্তমানে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার আগে নির্বাচনে বিজয়ের গ্যারান্টি চায়। কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করার বিষয়ে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করবে, ভয়ের কোন কারণ নাই। আর যদি সংখ্যাগুরু না হতে পারি আইনসভায় আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হয়ে কাজ করবে। রাজনীতি স্বচ্ছ থাকবে, জগাখিচুড়ি হবে না। আদর্শহীন লোক নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও দেশের কাজ হবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৪৯)।
আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু থেকেই সুস্থ্য রাজনীতির ধারা চর্চা করে এসেছে এবং আজ এই ঐতিহ্যবাহী দলের বয়স ৭৫ বছর হলেও এখনো সে চর্চা অব্যাহত রেখেছে। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। পরে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেনাবাহিনীর কিছু বিপৎগামী সদস্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগকে এদেশের রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
দুই যুগের অধিককাল স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। খুনীচক্র মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আওয়ামী লীগকে তারা ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ‘৮১-এর ১৭ মে স্বদেশের মাটি স্পর্শ করে শহীদের রক্তে ভেজা আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ তথা অর্থনৈতিক মুক্তির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পঞ্চমবারের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসীন। জাতির জনকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশকে আজ অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছেন। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, এবং বাংলাদেশ আমাদের দেশের ইতিহাসের এখন অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই ‘প্লাটিনাম জুবিলি’-তে দলটির প্রতি রইল অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও আন্তরিক ভালোবাসা।
লেখক: মো. মহিউদ্দীন মহারাজ, এমপি, ১২৮ পিরোজপুর-২; সদস্য, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ; যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, পিরোজপুর জেলা শাখা।