159
Published on জুন 24, 2024আওয়ামী লীগের ৭১ বছরের ইতিহাস দুর্গম পথচলার ইতিহাস, চড়াই-উতরাই পার হওয়ার ইতিহাস। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইলের সন্তোষে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়। ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কলামিস্ট শামসুল আরেফিন খান লিখেছেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ গ্রহণ করলেন।
তাঁর প্রিয় সহচর শেখ মুজিবুর রহমান দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের স্থলাভিষিক্ত হলেন। টাঙ্গাইলের জনপ্রিয় নেতা শামসুল হক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় মওলানা ভাসানী সভাপতির গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে দাউদকান্দির সোহরাওয়ার্দী-অনুসারী পাশ্চাত্যপন্থী নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের জ্যেষ্ঠতার দাবি অগ্রাহ্য করে রাজবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নিযুক্ত করলেন। পাশ্চাত্যপন্থী সেক্যুলার গণতান্ত্রিক নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সমাজতন্ত্র-অনুসারীদের দলের নেতৃত্বে বরণ করতে মোটেও দ্বিধা বোধ করলেন না, বরং তাঁদের অবলম্বন করে দলকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় অভিষিক্ত করলেন। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগের নতুন যাত্রা শুরু হলো।
১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ দলের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করলে তাঁকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগে দ্বিতীয়বারের মতো বিভক্তি দেখা যায়। দলের সভাপতি আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। একই কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবকে সভাপতি আর তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে দল পুনর্গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ ঘোষিত ছয় দফা সারা দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে, ছয় দফার ভেতরই লুকিয়ে আছে বাঙালির স্বাধীনতার বীজ। আইয়ুব খান শেখ মুজিবসহ তাঁর প্রায় সব রাজনৈতিক সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করেন আর তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে সামরিক আদালতে বিচারের নামে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর সহকর্মীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে শুধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাই ভেসে যায়নি, আইয়ুব খান নিজেও ক্ষমতাচ্যুত হন। নতুন সামরিক শাসক হয়ে আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে সরকার গঠন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দুরূহ কাজটি হাতে তুলে নেন এবং সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশটিকে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে দেশের শত্রুরা সপরিবারে হত্যা করলে আওয়ামী লীগ আবার অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। দলটিকে সম্পূর্ণভাবে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে কারাগারে বন্দি জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা—শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকার কারণে ঘটনাচক্রে বেঁচে যান। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের এক বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে প্রবাসে নির্বাসন জীবন যাপনকারী শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতভাবে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সেই বছর ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশের এক ক্রান্তিকালে দেশে ফেরেন। তাঁর নেতৃত্বেই দলে নতুন করে ঐক্য সুসংহত হয়। এর পর থেকে ৪৪ বছর ধরে তাঁর নেতৃত্বেই দলটি গণতন্ত্র ও মানুষের ভোট-ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামেও সফলতা দেখিয়ে আসছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিজয়লাভের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পেছনে দলটির মুখ্য অবদান ছিল। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর আসন অলংকৃত করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের মাধ্যমে টানা চতুর্থ মেয়াদে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করছে। চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় শুধু নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের যত ইতিবাচক অর্জন, সবই হয়েছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষ নিরাপদ বোধ করে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে গত ১৫ বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা অতীতে আর কখনো হয়নি। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ বলেই দলটি আজ অনিবার্য। বঙ্গবন্ধুকন্যার সফল ও কার্যকর নেতৃত্বে দলটি আজ মানুষের আস্থার গভীরে স্থান করে নিতে পেরেছে।
লেখক : এম নজরুল ইসলাম, সর্ব-ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি