237
Published on জুন 6, 2024সাঁকো দিলাম। লক্ষ্য স্পষ্ট, স্বাধীনতা- ৬ দফা প্রদানের পরপরই আওয়ামী লীগের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের কাছে নিজের পরিকল্পনা এভাবেই তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ আমাকে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এবং কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহও একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মণি সিংহ তাঁর ‘জীবন-সংগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন- ১৯৬১ একাধিক গোপন বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন- ‘আমি স্বাধীন পূর্ব বাংলার স্লোগান দেব।’ [জীবন-সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ২২৪]
সিরাজুল আলম খান বলেছেন- ছয় দফা পাওয়ার পর মনে হলো একটা স্বপ্ন দেখার মতো। এটাই তো হলো একমাত্র ডকুমেন্ট, যেটা দেশকে স্বাধীন করার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।’ [প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান- মহিউদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা ১০৬]
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীরও বুঝতে অসুবিধে হয়নি- শেখ মুজিবুর রহমান কী লক্ষ্য স্থির করেছেন, কোন পথে চলেছেন।
বছরের পর বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর পরিচালিত গোয়েন্দা নজরদারির প্রতিবেদনগুলো আমরা জানতে পারি- ৬ দফা কর্মসূচি উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে শাসকগোষ্ঠী বুঝে যায় যে অবিলম্বে ‘কার্যকর ও বলিষ্ঠ’ পদক্ষেপ না নিলে অচিরেই পাকিস্তানের ‘অখণ্ডতা ও সংহতি’ বিপন্ন হবে, পাল্টে যাবে দক্ষিণ এশিয়ার ভুগোল, অভ্যুদয় ঘটবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর নগরীতে স্বায়ত্তশাসনের জন্য ৬ দফা কর্মসূচি প্রথমে উপস্থাপন করেন। পাকিস্তানের ক্ষমতা-কেন্দ্র পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরের একটি স্থানে সে সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দল ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি একটি কনভেনশন আহ্বান করেছিল। দলগুলোর নেতারা সমবেত হয়েছিলেন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত ‘তাসখন্দ চুক্তি’ বাতিলের দাবি সামনে রেখে। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত ১৭ দিনের যুদ্ধের পর বর্তমান উজবেকিস্তানের (সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রজাতন্ত্র) রাজধানী তাসখন্দে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মধ্যে ‘তাসখন্দ শান্তি চুক্তি’ সম্পাদিত হয়। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছিলেন সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন। পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থি ও ধর্মান্ধ কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাসখন্দ চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে। তারা বলেছিল- যুদ্ধ করা হয়েছে ভারতের কাছ থেকে কাশ্মীর দখল করার জন্য। কাশ্মীর দখল হয়নি যুদ্ধে, আলোচনার মাধ্যমেও তাসখন্দে মিলল না কাশ্মীর। অতএব, আইয়ুব খানকে বিদায় করতে হবে। এ জন্য আইয়ুব খানের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে জোটবদ্ধ হতে হবে।
শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর কনভেনশনে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এবং দলের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদসহ একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে সেখানে ৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) উপস্থিত হন। কেবল আইয়ুব সরকার উৎখাত নয়, তাঁর আগ্রহ ছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবি সুনির্দিষ্টভাবে সামনে নিয়ে আসা। কিন্তু কনভেনশনের আয়োজকরা স্বায়ত্তশাসনের ইস্যু নিয়ে আলোচনায় সম্মত না হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদকর্মী, আইনজীবী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের পৃথক পৃথক সমাবেশে ‘৬ দফা কী ও কেন’, সে বিষয়টি তুলে ধরেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশ ছিল বৈরি। ভয় দেখানো হচ্ছিল- এ পথে চললে জেলে থাকতে হবে বাকি জীবন, এমনকি ফাঁসিতেও ঝুলতে হতে পারে। কিন্তু তিনি ছিলেন দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। কৈশোরেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। অবিভক্ত বাংলার অনন্যসাধারণ নেতা ও সংগঠক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দ্রুতই উপলব্ধি করেন- এমন একজন রাজনৈতিক কর্মী মুসলিম লীগে রয়েছে যে কি না অদম্য সাহসী। পাকিস্তান আমলে ১৯৪৮ সালের শুরু থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগ তীক্ষ্ন নজরদারি শুরু করে। তখন তাঁর বয়স ২৮ বছরও পূর্ণ হয়নি। ৬ দফা কর্মসূচি কীভাবে গোয়েন্দারা তুলে ধরেছিল, তার বিবরণ রয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পাদিত ১৪ খণ্ডে প্রকাশিত Secret Documents of Intelligence Branch On Father Of The Nation Bangabondhu Sheikh Mujibur Rahman – এর বিশেষভাবে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ খণ্ডে। এ নিবন্ধ ওই সব প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই রচিত। এ লেখার বিভিন্ন স্থানে সূত্র হিসেবে সংক্ষেপে ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদন’ উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বায়ত্তশাসন ইস্যুটি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই উত্থাপিত হচ্ছিল। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি সহ কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচির ১৯ নম্বরে স্থান পেয়েছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবি। পরের বছরগুলোতে বিশেষভাবে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরের সঙ্গে সভা-সমাবেশে তুলে ধরতে থাকে। ১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন মহিউদ্দিন আহমদ এবং এর পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার সদস্য ও দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুুজিবুর রহমান। তাঁর ভাষণে ‘পাকিস্তানে দুই অর্থনীতি’ উল্লেখ ছিল। তিনি বলেন, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে যখন শাসনতন্ত্র তৈরি হচ্ছিল তখন আমরা আওয়ামী লীগের ১২ জন সদস্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করছিলাম।... অর্থ, বৈদেশিক নীতির সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে।... আজ আমরা দেখতে পাই পাকিস্তানে দুই অর্থনীতি চলছে- একটা পশ্চিম পাকিস্তানে, আর একটা পূর্ব পাকিস্তানে।’ [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬০৯]
কারাগার থেকে লাহোরে
লাহোরে ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত বিরোধী দলের কনভেনশনে যোগদানের কয়েকদিন আগে (২৮ জানুয়ারি, ১৯৬৬) শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্র-দ্রোহাত্মক বক্তৃতাদানের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তাকে আদালত থেকে নাজিমুদ্দীন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আইনজীবীরা তাৎক্ষণিক হাইকোর্টে জামিনে মুক্তির আবেদন করলে তা মঞ্জুর হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান ওই দিনই মুক্তিলাভ করেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ১০ম খণ্ডের ৪৭ পৃষ্ঠায় ইত্তেফাকে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত রিপোর্ট উল্লেখ করা হয়েছে, যা ৩১ জানুয়ারি নথিভুক্ত করা হয়েছিল।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়- ৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) লাহোর যাত্রার প্রাক্কালে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, জনসাধারণের সত্যিকার মনোভাব প্রতিফলনের জন্য পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ও ভারতের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে পূর্বের তুলনায় অধিকভাবে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা দ্বারা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও দেশরক্ষার দিক হতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বয়ংসম্পূর্ণতা বিধানের দ্বারাই দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা সম্ভব। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৬]
‘সাপ্তাহিক জনতা’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদন গোয়েন্দারা ১৮ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত ফাইলে নথিভুক্ত করে। এতে বলা হয়, শেখ মুজিব ২৮ মাঘ (১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬) লাহোর থেকে ঢাকা ফিরে বলেন- লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি শাসনতান্ত্রিক ফেডারেশন গঠনসহ যে ছয় দফা সুপারিশ পেশ করা হয়েছিল, সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটি উহা গ্রহণ করেনি। এ জন্য তিনি ও তাঁর দল সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হয়।
ছয দফায় কী আছে
ছয় দফার প্রথমটিতে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়। দ্বিতীয় দফায় বলা হয়- ফেডারেল সরকার কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি দেখাশোনা করবে। অর্থ ও মুদ্রাসহ বাকি সব বিষয় থাকবে প্রদেশের হাতে। ( ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় অর্থ বিষয়টি কেন্দ্রের হাতে ছিল)। ছয় দফার ৩, ৪ ও ৫ নং দফায় অর্থ ও মুদ্রা এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয় উল্লেখ রয়েছে। ৬ নং দফায় প্রদেশের হাতে প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠনের ক্ষমতা প্রদানের দাবি করা হয়। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫]
১৮ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দারা লিখেছেন, ১৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন- রাজনীতিতে মধ্যপন্থায় আর বিশ্বাস করা চলে না। তাই দেশের বৃহত্তর কল্যাণের কথা চিন্তা করেই তিনি জাতির সামনে ৬ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছেন। এই ৬ দফা কোনো রাজনৈতিক দরকষাকষি নয়, চালবাজিও নয়- এই ৬ দফার সহিত পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ অধিবাসীর জীবনমরণের প্রশ্ন জড়িত। তিনি বলেন, সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে রয়েছে। তবে স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফাকে এখন অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তিনি এটাও স্পষ্ট করে দেন যে যদিও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অ্যাফিলেসন রয়েছে, তবে আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখা অটোনমাস সংগঠন, যার রয়েছে নিজস্ব গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচি। গোয়েন্দা দফতর ১৯ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত ফাইলে এ প্রতিবেদন নথিভুক্ত করে।
৬ দফা উত্থাপনের সময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। তবে তিনিই যে এ দলের প্রাণশক্তি, সেটা সবার জানা ছিল। সভাপতি ছিলেন আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভায় কয়েকজন নেতার আপত্তির পরও ৬ দফা কর্মসূচির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দা বিভাগ এ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত ফাইলে সংরক্ষিত রাখে। বৈঠকে ৬ দফার দলীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণসহ একটি পুস্তিকা প্রকাশ ও বিলির সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য একটি শক্তিশালী কমিটি গঠিত হয়, যাতে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
প্রথম সভা চট্টগ্রামে
৬ দফা নিয়ে এ ভূখণ্ডের জনগণের কাছে যাবেন, এ সিদ্ধান্ত শেখ মুজিবুর রহমান শুরুতেই গ্রহণ করেছিলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে বলেন, বলা হয়ে থাকে পূর্ব পাকিস্তানিরা সামরিক জাতি নয়। কিন্তু বেঙ্গল রেজিমেন্টই ১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে লাহোরকে রক্ষা করায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। এ ভূখণ্ডের মানুষ নিজেদের রক্ষা করতে জানে।
লালদীঘির জনসভা বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- ২০ হাজার লোক সমবেত হয়েছিল সমাবেশে। শেখ মুজিব বলেছেন, আপনারা অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে সমবেত হয়েছেন। আমরা মরে যেতে পারি, কিন্তু পরের প্রজন্ম এ ত্যাগের ফল ভোগ করবে। চট্টগ্রাম কারাগারে ৫০০ জন বন্দী রাখা যায়। আমি আপনাদের ২০ হাজার জনকে জেলে যেতে প্রস্তুত থাকতে বলব। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৫]
২৮ ফেব্রয়ারি তিনি ভাষণ দেন নোয়াখালীর মাইজদী কোর্টে। এর আগের দিন ভাষণ দিয়েছিলেন বেগমগঞ্জে। এখানে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন- মিলিটারি, এয়ারফোর্স, নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার সব করাচিতে। অথচ আমরা পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জন, তারা ৪৪ জন। ১৭ দিন যুদ্ধের পর আইয়ুব খানের সঙ্গে দেখা হলে আমি বললাম- তোমরা বলেছ, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে দিল্লি দখল করবে। তুমি দিল্লি-বোম্বে দখল করে নিলে তাতে আমার বাংলার কী হবে? নদীমাতৃক দেশ এই বাংলা। বাংলায় যুদ্ধ করতে হলে বাঙালির ছেলেই পারে। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৫]
আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা
১৯৬৬ সালের ৫ মার্চ কুমিল্লা থেকে পাঠানো এসবির কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্টে বলা হয়- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১২ টা ২২ মিনিটের দিকে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাসহ উল্কা ট্রেনযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পথে লাকসাম স্টেশনে থামলে তাকে বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা’ নামের একটি পুস্তিকা বিলি ও বিক্রির জন্য তাদের হাতে তুলে দেন। ‘ষাটের দশকের গণজাগরণ’ গ্রন্থে সাবেক ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক বিষয়ে গবেষক শেখর দত্ত লিখেছেন- ৬ দফা প্রদানের দুই সপ্তাহের মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারিকে (১৯৬৬) সামনে রেখে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক পুস্তিকা বের করা হয়। ওই পুস্তিকায় শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য ছাপা হয়। তীব্র হুমকি-ধমকির মধ্যেও পুস্তিকাটির জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হতে থাকে। শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে, শ্রমিক এলাকায় এই পুস্তিকাটি ব্যাপকভাবে বিলি করা হয়। নেতা-কর্মীরা এই পুস্তিকাটির বিষয়বস্তু নিয়ে জনগণের বিভিন্ন্ন অংশের মধ্যে জনসভা, হাটসভা, পথসভা এবং মুখে মুখে প্রচারে নামে। ইতিপূর্বে কোনো রাজনৈতিক পুস্তিকা নিয়ে এতটা উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়নি। অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান, ৬৬-এ ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণজাগরণ, এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গৌরবময় ইতিহাসের সাথে এই পুস্তিকাটি ওতপ্রোপ্তভাবে জড়িত হয়ে আছে। [ষাটের দশকের গণজাগরণ- শেখর দত্ত, পৃষ্ঠা ২৬৪]
ওসি ওয়াচ কুমিল্লা জানান, ২৮ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) শেখ মুজিবুর রহমান ১২টা ২৫ মিনিটের দিকে গাড়িযোগে ফেনী থেকে ঢাকায় ফেরার পথে কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আহমদ আলীর সঙ্গে তার বাসভবনে দেখা করে কথা বলেন। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৭]
চট্টগ্রামের পর শেখ মুজিবুর রহমান ১০ মার্চ মুক্তাগাছা ও ১১ মার্চ ময়মনসিংহ টাউন হলের জনসভায় ভাষণ দেন। ময়মনসিংহের সভায় সভাপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ) মোজাম্মেল হক নামের এক গোয়েন্দা ১৯ এপ্রিল জানান- শেখ মুজিব ময়মনসিংহে বলেন, সরকার যুদ্ধের সময় ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বিড়ির টেন্ডুপাতা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে বন্ধ করে নাই। আমার দেশে ৫ লাখ বিড়ি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। [পৃষ্ঠা ২৬৯]
১৪ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান সিলেট রেজিস্ট্রি অফিস ময়দানের সভায় বলেন, ৬ দফা প্রদানের পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলেছেন- তিনি আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দেবেন। পাকিস্তান কায়েম হয়েছে ১৮ বছর। আমি এ সময়ে এত বক্তৃতা করেছি- গোয়েন্দারা তা লিখে রেখে তাদের রুমে জমা করেছেন। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে আসেননি। কোনো সৈন্য আসেনি, কোনো চিঠি আসেনি। [পৃষ্ঠা ২৯৪]
একের পর এক মামলা
৬ দফা উত্থাপনের পর চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চল সফরের সময় শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে। তিনি প্রতিটি মামলায় জামিন গ্রহণ করেন। ১৬ মার্চ (১৯৬৬) রাজারবাগের এসবি অফিস থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়- মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ ও সিলেটের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন ভাষণ পাঠানো হলো। এতে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের মতো উপাদান রয়েছে কীনা, সেটা জানতে চাই। [১০ খণ্ড গোয়েন্দা প্রতিবেদন, পৃষ্ঠা ২৮৪]
৬ দফার পক্ষে জনগণ- এমনটিই শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহকর্মীদের কাছে বিপুল জনসমাগম থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। অপরদিকে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি দল মুসলিম লীগের অনেক নেতা ৬ দফাকে পাকিস্তান ভাঙার ভারতীয় ও আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তানের অনেক নেতাও তাদের সুরে সুর মেলান। গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান, আবদুস সবুর খান (কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও খুলনার নেতা), জামায়াতে ইসলামী নেতা গোলাম আযম, মুসলিশ লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী- এরা ৬ দফার বিরুদ্ধে জেহাদি মনোভাব নিয়ে প্রচার শুরু করেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতাকালীন সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানির নেতৃত্বে একদল সমাজতন্ত্রকামী রাজনৈতিক নেতাও ৬ দফার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এ সব বামপন্থিরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। কিন্তু কথা ও কাজে গুরুত্ব পেত মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বাধীন চীনের নীতি ও আদর্শ। এমনকি এ মহলটি ৬ দফাকে কুখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ প্রণীত বলে অপ্রচার করতে থাকে। এতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সুবিধা হয় এবং আওয়ামী লীগের সমস্যা বাড়ে।
আইয়ুব খান ১৯৬৬ সালের ১৬ মার্চ রাজশাহীতে এক সমাবেশে বলেন, ‘অখণ্ড বাংলা কায়েমই ৬ দফার লক্ষ্য। এই দাবি প্রতিরোধ আমাদের দায়িত্ব।... জনসাধারণ পুরোপুরি শিক্ষিত না হলে পাকিস্তানে প্রত্যক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। পাকিস্তানে মাত্র শতকরা ১৫ জন লোক শিক্ষিত এবং শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত।’ [দৈনিক পাকিস্তান, ১৭ মার্চ, ১৯৬৬]
খুলনার জনসভায় আইয়ুব খান বলেন- ‘বিরোধীদল ৬ বা ৭ দফার বিনিময়ে পাকিস্তানের স্বাধীনতা বিকাইয়া দেওয়ার চেষ্টা করিতেছে। বৃহত্তর সার্বভৌম বাংলা চায় তারা।’ দৈনিক পাকিস্তান, ১৮ মার্চ, ১৯৬৬]
শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা কর্মসূচি আদায়ের লক্ষ্যে উপযুক্ত সংগঠন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে থাকেন। তিনি জানতেন, সামনে আছে জোর লড়াই। জেল-জুলম আসবে। এর মোকাবিলায় চাই উপযুক্ত সংগঠন। আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক কমিটি ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি ৬ দফা অনুমোদন করে। কিন্তু প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি আবদুর রশিদ তর্কবাগীশসহ অনেক নেতা ৬ দফা উত্থাপনের পর দমননীতির ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ আবার নীতিগত অবস্থান থেকেই ৬ দফা নিয়ে অগ্রসর হতে চাইছিলেন না। তারা পাকিস্তানের ‘অখণ্ডতা ও সংহতিতে’ প্রবলভাবে বিশ্বাসী ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ সভাপতি
৬ দফা বাস্তবায়নে কাজ করবে নিষ্ঠা আন্তরিকতা নিয়ে, জেল-জুলুম ও সব ধরনের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে- এমন নেতৃত্ব চাইছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ ইডেন হোটেলে (নটরডেম কলেজের বিপরীতে) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি নজরদারির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ তিনজন সহসভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন আমেনা বেগম।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ১০ম খণ্ডে আওয়ামী লীগ সম্মেলনের বিষদ বিবরণ রয়েছে।
দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা লিখেছে, শেখ মুজিবুর রহমান ২০ মার্চ পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় বলেছেন, ৬ দফা আদায়ে আন্দোলন চলবে। পাকিস্তানে দুই অর্থনীতি প্রবর্তন করতে হবে।
আওয়ামী লীগের সম্মেলন চলাকালেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ২০ মার্চ ঢাকায় মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় ভাষণ দিয়ে বলেন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা গৃহযুদ্ধ চাপিয়ে দিলে জাতিকে তা মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। বিরোধীদের প্রয়োজনে কঠোরহস্তে দমন করতে হবে।
মুসলিম লীগ সভায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ৬ দফা নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে যে কোনো স্থানে আলোচনায় বসার চ্যালেঞ্জ প্রদান করেন।
২১ মার্চ এসবি’র ডিআইজি এ এস এম আহমদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে লিখেছেন, ২০ মার্চ আউটার স্টেডিয়ামে (পল্টন) প্রদত্ত শেখ মুজিবের ভাষণের পূর্ণ বিবরণ পাঠানো হলো- এর ভিত্তিতে কোনো আইনী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন কীনা, সেটা জানাতে হবে। [১০ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪০]
সম্মেলন শেষ হতে না হতেই বঙ্গবন্ধু ফের জেলা ও মহকুমায় সমাবেশ করতে শুরু করেন। কয়েকটি থানাতেও তিনি সভা করেন। ২৬ মার্চ (১৯৬৬) চট্টগ্রাম জেলার গোয়েন্দা বিভাগ তাদের প্রতিবেদনে জানায়, এই দিন শেখ মুজিব সন্দ্বীপের জনসভায় অভিযোগ করেন- প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ৬ দফা কর্মসূচির মোকাবিলায় গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন। এরপর ২৭ মার্চ সাতকানিয়ায় প্রদত্ত ভাষণে শ্রোতাদের তিনি বলেন- আমি, ৫-৬ বছর জেল খেটেছি। আপনারা মাত্র ৬ মাস জেল খাটেন, দাবি আদায় হবে। [পৃষ্ঠা ৩৫৩-৩৬১]
৩০ মার্চ তিনি ঢাকার ধানমন্ডি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ অফিস উদ্বোধন শেষে কর্মীসভায় বক্তব্য রাখেন। পরবর্তী সময় তিনি ঢাকা ও আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মীসভায় অংশ নেন। এরপর তিনি পাবনা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, ফরিদপুর, যশোর ও খুলনায় জনসভা ও কর্মীসভায় ভাষণ দিতে ৭ এপ্রিল (১৯৬৬) সড়কপথে ঢাকা ত্যাগ করেন।
৯ এপ্রিল গভর্নর মোনায়েম খানের পুত্রের পত্রিকা ‘পয়গাম’ লিখেছে, শেখ মুজিব ৭ এপ্রিল পাবনার টাউন হল ময়দানের সমাবেশে সরকারকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, ৬ দফা প্রশ্নে গণভোটে আইয়ুব সরকার যদি ৩০ ভাগ ভোট লাভ করে, তবে তিনি রাজনীতি হতে অবসর নেবেন। ‘পয়গাম’ এ খবরের শিরোনাম দিয়েছিল বিকৃত করে- ‘শেখ মুজিবের আরেক দফা লম্ফ ঝম্প’। এই পত্রিকাটি ১৪ এপ্রিল ‘ফরিদপুরে শেখ মুজিব নাজেহাল’ শিরোনামে একটি অসত্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা পড়ে ঢাকার গোয়েন্দা বিভাগ ৩০ এপ্রিল ফরিদপুরের এসবি-এর কাছে বিস্তারিত জানতে চায়। [১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৫৫]
১৬ এপ্রিল ডিআইজি, এসবি পূর্ব পাকিস্তানের সহকারী পরিদর্শককে জানান, সিলেট-ময়মনসিংহ-সন্দ্বীপ ও ঢাকায় ৬ দফা বিষয়ে শেখ মুজিব যে সব বক্তব্য রেখেছেন তাতে অনেক আপত্তিকর বিষয় রয়েছে এবং এর ভিত্তিতে মামলা দায়েরের জন্য সংশ্লিষ্ট এসপিদের নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। [১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৫৬] সে সময় সমাবেশে কী স্লোগান উঠত, তা জানিয়েছেন ঢাকার একজন এসবি। তিনি ১৮ এপ্রিল ওপরের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন- শেখ মুজিব এবং তাজউদ্দীন আহমদ যশোর থেকে পিআইএ বিমানে ঢাকা পৌঁছালে কর্মীরা ৬ দফা মানতে হবে, শেখ মুজিবর জিন্দাবাদ, পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করা চলবে না, আয়ুব-মোনেম ধ্বংস হোক, প্রভৃতি স্লোগান দেয়। [১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৬২]
১৯৬৬ সালেই ‘বাংলাদেশ’
১৫ এপ্রিল যশোরের জনসভায় শেখ মুজিব বলেন, আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমার সঙ্গে পল্টন ময়দানে ৬ দফা নিয়ে আলোচনায় রাজী হয়েছিলেন। কিন্তু আজ আমার সেক্রেটারি জানালেন, ভুট্টো সাহেব সসম্মানে পশ্চাদপসারণ করেছেন। তিনি নানা অসুবিধার কথা বলেছেন। আসলে তিনি বুঝেছেন, বাংলাদেশের জনসাধারণ ৬ দফা চায়। [পৃষ্ঠা ৪২১]
লক্ষণীয় যে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালেই পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ’ উচ্চারণ করেছেন।
২০ এপ্রিল আইজিপি, পূর্ব পাকিস্তান জানান- পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র ও কাশ্মীর বিষয়ক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কতটি মামলা রয়েছে সেটা জানতে চেয়েছেন। তাকে জানানো হয়েছে যে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩ থেকে ১৫ এপ্রিল ১৯৬৬ তারিখ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা রয়েছে।
২৭ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দাদের কাছে শেখ মুজিব বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর ও যশোরের জনসভায় যে সব বক্তব্য রেখেছেন তার রেকর্ডেড ভাষ্য চেয়ে পাঠিয়েছে। আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এর প্রয়োজন। [১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১১]
শেখ মুজিব গ্রেফতার
৬ দফা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে শেখ মুজিবুর রহমান ক্লান্তিহীনভাবে ছুটে গেছেন এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। সড়ক, রেল ও নৌপথে এবং বিমানে তিনি ভ্রমণ করেছেন। সাইকেল ও রিকশা ব্যবহার করেছেন। হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। সর্বত্র মিলেছে বিপুল সাড়া। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল এবং তিন মাস জনসংযোগের পাশাপাশি সংগঠন গুছিয়ে তুলেছেন তিনি। কেন্দ্রীয় ও জেলা-মহকুমা নেতৃত্ব সুসংহত করেছেন। পাশাপাশি তাকে হাজিরা দিতে হয়েছে একের পর এক দায়ের করা মামলায়। এ কারণে অনেক স্থানে আয়োজিত কর্মসূচিতে তিনি অংশ নিতে পারেননি।
৮ মে তিনি নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া মাঠের বিশাল সমাবেশে ভাষণ দেন। কাছের ও দূরের শ্রমিকরা দলে দলে মিছিল নিয়ে আসে সমাবেশে। আদমজী জুটমিলের শ্রমিকদের উপস্থিতি ছিল বিপুল। সভাশেষে ধানমন্ডি বত্রিশের ৬৭৭ নম্বর বাসায় ফেরেন। গভীর রাতে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয় তিন মাসের আটকাদেশ দিয়ে। অভিযোগ- জননিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত থাকা এবং দেশের শান্তি এবং অপরিহার্য সরবরাহ ও সেবা বজায় রাখা। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, একাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫]
একই দিনে তাজউদ্দীন আহমদসহ আরও কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হন। এবারের বন্দীজীবন স্থায়ী হয় ২ বছর সাড়ে ৯ মাস। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির প্রবল ছাত্র-গণআন্দোলনের পরিণতিতে তিনি মুক্ত হন ২২ ফেব্রুয়ারি। পরদিন রেস কোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষ তাকে বরণ করে নেয় ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে।
১২ মে (১৯৬৬) এসবি, সূত্র জানায়- শেখ মুজিবুর রহমানসহ আটক নেতাদের সেগ্রিগেট করে রাখার প্রতিবাদে তারা কারাগারে অনশনের হুমকি দিয়েছেন। [একাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭১]
১৫ মে (১৯৬৬) ফজিলাতুন্্ নেছা মুজিব শেখ হাসিনা, শেখ কামাল ও শেখ জামালকে নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। [একাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৫]
১৯ মে জেল কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের কারাকক্ষে একটি সিলিং ফ্যান লাগানোর অনুমতি দেয়, তবে শর্ত ছিল- ফ্যানের পাখা ঢাকা থাকবে লোহার নেট দিয়ে এবং সুইস থাকবে কক্ষের বাইরে। [পৃষ্ঠা ১০৭]
২৮ মে এক গোয়েন্দা জানিয়েছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাঠানো প্রবোধ কুমার সান্যালের ‘রাশিয়ার ডাইরী’ অনুমোদন করা যেতে পারে। ৩১ মে ‘আফ্রিকান ইন্ডিপেন্ডেন্স’ বইটি অনুমোদন করা হয়। এ দিন ফজিলাতুন্্ নেছা মুজিব পুত্র-কন্যাদের নিয়ে কারাগারে স্বামীর সঙ্গে দেখা করেন।
১৯৬৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, পেঙ্গুইন সায়েন্স সার্ভে ১৯৬৩ বি, সায়েন্স ইন আওয়ার লাইভস, সায়েন্স অ্যান্ড দি মডার্ন ওয়ার্ল্ড, এ ব্রিফ হিস্ট্ররি অব সায়েন্স এবং রিডলস সায়েন্স সেন্সর
শেষে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রদানের অনুমোদন দেওয়া হলো। এর আগে ৪ ফেব্রুয়ারি আফ্রিকান কুইনসহ আরও ৬টি বইয়ে আপত্তিকর কিছু না থাকায় অনুমোদন দেওয়া হয়। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, দ্বাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৭]
৭ জুন হরতাল
৪ জুন (১৯৬৬) এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ৭ জুন প্রতিবাদ দিবস পালনের ডাক দিয়েছে। এ উপলক্ষে কয়েকজন হিন্দু ব্যক্তি ও অবাঙালি শিল্পপতিদের কাছ থেকে এক লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়েছে। স্থানীয়-অস্থানীয় লোকদের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘাতের শঙ্কা রয়েছে। তবে আদমজী জুটমিলের ম্যানেজার এবং আরপি সাহা ও বাদল ঘোষকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা চাঁদা দানের বিষয়টি স্বীকার করেননি। [পৃষ্ঠা ১১৮-১২২]
বঙ্গবন্ধুসহ আটক বন্দীদের মুক্তি এবং ৬ দফা আদায়ের দাবিতে দেশব্যাপী মিছিল ও সমাবেশ চলতে থাকে। এমনকি জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ নেতারাও আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদ করেন। আওয়ামী লীগ ৭ জুন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয়। হরতালের সমর্থনে ব্যাপক প্রচার চলে। ৭ জুন তীব্র দমননীতির মধ্যেও হরতাল সফল হয়। সরকারি প্রেসনোটেই বলা হয়- পুলিশের গুলিবর্ষণে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৬ দফার পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণের অভিযোগে ১৮ জুন ‘ইত্তেফাক’ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞাকে গ্রেফতার করা হয়। ৯ জুন ফজিলাতুন্্ নেছা মুজিব সন্তানদের নিয়ে কারাগারে স্বামীর সঙ্গে দেখা করেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্দী শেখ মুজিবের মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে দেখতে যাওয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে প্যারোলে মুক্তি প্রদান করার একটি প্রস্তাব আলোচনায় উঠলেও তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন- প্যারোল নয়, নিঃশর্ত মুক্তি চাই। [একাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩২, ১৫০]
২২ জুন এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানকে ২৫ জুন যশোর কোর্টে একটি মামলায় হাজিরার জন্য পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে জনসমক্ষে হাজির করা ঠিক হবে না। [পৃষ্ঠা ১৬৯]
২৯ জুন সরকার সিদ্ধান্ত নেয়- শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলোর বিচার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে অনুষ্ঠিত হবে। [পৃষ্ঠা ১৭১]
প্রকৃতপক্ষে, আওয়ামী লীগ ও ৬ দফার পক্ষে জনমত এবং শেখ মুজিবের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থনের কারণে তাকে প্রকাশ্য আদালতে হাজির করার সাহস পায়নি শাসকরা। ৬ দফা ঘোষণার পর তিনি যেখানেই গিয়েছেন, সর্বত্র বিপুল মানুষ তাকে দেখতে ও তাঁর কথা শুনতে হাজির হয়েছিল। যে আদালতেই তাকে নেওয়া হতো, মানুষের ঢল নামত।
১৯৬৪ সালের ২২ নভেম্বর পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য নিয়ে দায়ের করা একটি মামলার বিচার চলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২৪ অক্টোবর (১৯৬৬) এ মামলার রায়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। বিচারক রায়ে বলেন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ প্রমাণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি তারা একজন বাঙালিকেও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে হাজির করাতে পারেনি। [পৃষ্ঠা ৩৪১]
৫ নভেম্বর গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ৬ দফা প্রদানের পর ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ পল্টন ময়দানে ভাষণ প্রদানের বিষয়ে দায়ের করা একটি মামলার বিচার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শুরু হয়েছে। [পৃষ্ঠা ৪৪৫]
এ মামলায় একজন সরকারি সাক্ষী বলেন, শেখ মুজিব পল্টনের সভায় বলেছেন- ৬ দফার মাধ্যমে পাকিস্তানের উভয় অংশকে সমান ক্ষমতা দেওয়া হইবে এবং ইহাতে দেশের উভয় অংশ শক্তিশালী হইবে।
১৯৬৭ সালের ২৭ এপ্রিল এ মামলার রায়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আদালতে শেখ মুজিব উপস্থিত দলীয় নেতা ও আইনজীবীদের বলেন- ৬ দফার আন্দোলন চলবে। আমাদের কাজ বন্ধ রাখা চলবে না। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, দ্বাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫]
এই মামলার বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে লিখেছেন- আজ লাহোর প্রস্তাবের মালিকের মৃত্যুবার্ষিকী। আর লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি করে আমি যে ৬ দফা পেশ করেছি তার ওপর বক্তৃতা করার জন্য এ দিনটিতে আমাকে ১৫ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। [৮ নভেম্বর (১৯৬৭) দৈনিক আজাদ লিখেছে- ১৫ মাসের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান আপীল করায় ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজ কায়সার আলী দণ্ডাজ্ঞার মেয়াদ কমাইয়া আটমাস করিয়াছেন। [দ্বাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৭]
২৮ এপ্রিল-৩০ এপ্রিলের ডায়রিতে লিখেছেন- ‘ছেলেমেয়ে ও রেণুর সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বললাম। ... তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া শিখ, আর কতদিন (কারাগারে) থাকতে হয় জানি না। ...আমি তো সারাজীবন জেলে জেলে কাটাইয়াছি, তোমার মা’ই সংসার চালাইয়াছে।’ [কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ২৩২-২৩৩]
আপসের প্রস্তাব
১৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৭) এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সালাম খান ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার কারাগারে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। অত্যন্ত বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, আবদুস সালাম খান ৬ দফার কিছু অংশ বাদ দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য একটি সর্বদলীয় প্লাটফরম গঠনে সম্মত হওয়ার জন্য শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেন। কিন্তু শেখ মুজিব বলেন, ৬ দফা নিয়ে কোনো আপস তিনি করবেন না। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, দ্বাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৪]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের ২৪ বছরের দুঃশাসনের প্রায় অর্ধেকটা সময় কাটিয়েছেন কারাগারে কিংবা ক্যান্টনমেন্টে অথবা পাকিস্তানের নির্জন কারাগারে। এর মধ্যে একটানা ২ বছর ৯ মাসের বেশি কেটেছে স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা কর্মসূচি প্রদানের পর। বন্দী জীবনেও গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন তিনি। পাকিস্তানের শাসকরা বুঝে যায়- এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তাঁর বন্দীজীবনে ফজিলাতুন্্ নেছা মুজিব সন্তানদের নিয়ে বার বার কারাগারে ‘অতিথি কক্ষে’ গিয়েছেন। সর্বক্ষণ কাছে থাকা গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে বাইরের আন্দোলন ও সংগঠনের চিত্র তুলে ধরেছেন। একইসঙ্গে কৌশলে জেনে নিয়েছেন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক নির্দেশনা। মামলা পরিচালনার কৌশল নিয়েও কথা বলেছেন। ৬ দফা প্রদানের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তিনি জনগণকে এমনভাবে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং দেশবাসীকে সচেতন ও সংঘবদ্ধ করেছেন যে ৯ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছে। তাঁর আহ্বানে স্বাধীনতা সংগ্রামে লাখ লাখ ছাত্র-যুবক অস্ত্রধারণ করেছে; ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু আত্মদান করেছে, দুই লাখের বেশি নারী লাঞ্ছিত-নির্যাতিত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, এ যে ঐতিহাসিক ৬ দফারই যথার্থ পরিণতি! ৬ দফা হচ্ছে স্বাধীনতার পথে চলার সাঁকো- বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের বার বার এ কথা বলেছেন। জনগণের এটা বুঝতে সমস্যা হয়নি, পাকিস্তানের গোয়েন্দারাও সেটা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু বাঙালিদের দাবায়ে রাখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে।
অজয় দাশগুপ্ত: বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক