737
Published on এপ্রিল 3, 2024ধরে নেওয়া যাক আজ থেকে দশ বছর পরের একটি গ্রামের গল্প এটি। যে গল্পটির নাম ‘একটি ভবিষ্যৎ স্মার্ট গ্রামের গল্প’! যে গ্রামে সব মানুষের সঙ্গে সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তির মেলবন্ধনের মাধ্যমে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। গ্রামটি প্রযুক্তির ব্যবহার করে জনগণের জীবন এবং জীবিকার মান নতুন পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছে সবার কাছে। সব সদস্য তাদের জীবনের বিভিন্ন দিক স্থানীয় টেকনোলজিকে ব্যবহার করে উন্নতি করতে পারে। এ স্মার্ট গ্রামের সব সদস্যের একটি করে ডিজিটাল প্রোফাইল আছে যেখানে তারা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থিক অবস্থাসহ জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য সমন্বয় করতে পারে। তারা তাদের স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে গ্রাম এবং নিজেদের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করতে পারে। এই স্মার্ট গ্রামে খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সংরক্ষণের জন্য এমন কিছু স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যা জৈব কৃষি এবং পরিবেশ নিশ্চিত করবে। উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত এ গ্রামের সবাই শহরের সঙ্গে প্রয়োজনে একটি ডিজিটাল নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদন এবং পরিবেশনার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে। এ গ্রামের মাধ্যমে গ্রামীণ অবস্থানে নিজস্ব সক্ষমতা বিকাশ করতে এবং তাদের পরিবেশের উন্নতির জন্য প্রযুক্তির উপযোগী একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে গ্রাম পরিষদ, সরকার এবং প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সম্পর্ক রয়েছে। গ্রামের প্রত্যেকটি স্কুলে শিক্ষার্থীরা যেন শহরের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পায়, এজন্য এখানে এমন ভার্চুয়াল এনভারমেন্ট তৈরি করা হয়েছে যেন শহরের কিংবা দেশ-বিদেশের বিখ্যাত শিক্ষকরাও ভার্চুয়াল এনভায়রনমেন্টের মাধ্যমে গ্রামের একটি স্কুলের শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে ছাত্রছাত্রীদের সামনে তাদের শিক্ষা পরিবেশন করবে। স্কুল এবং হাসপাতালে ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে যাতে শিক্ষার্থী এবং রোগীরা পরামর্শ ও পরিচিতি পান। গ্রামটিতে প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় তথ্য সহজেই অ্যাকসেস করা যায়। এখানে বিভিন্ন সেবা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। স্মার্ট গ্রামে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে গ্রামের মানুষের জীবন সহজ এবং সুবিধাজনক হয়ে উঠেছে। এ গ্রামে জনগণের সঙ্গে ইন্টারেকটিভ যোগাযোগমাধ্যমের সমন্বয় করা হয়েছে। গ্রামের বাসিন্দারা এর আগে ইন্টারনেটের অভাবে হয়তোবা অসন্তুষ্ট ছিলেন কিন্তু বর্তমানে তারা সবাই প্রয়োজনের ভিত্তিতে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে জীবনযাপনের ও প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত হতে পেরেছে। তার একটি উদাহরণ হলো সাহায্যকারী রোবট। এ রোবটগুলো গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে এবং তাদের প্রতিদিনের কাজে সাহায্য করতে পারে। এখানে কখনো বিদ্যুৎ যায় না। কারণ এ স্মার্ট গ্রামটির প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ এখানে উৎপন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে তারা সৌরশক্তিকেও ব্যবহার করেছে। শুধু তাই নয়, নিজ গৃহে নয়—এ গ্রামে যে গভীর ও অগভীর জলাশয়গুলো আছে সেই জলাশয়ের ওপরও সৌরশক্তি উৎপাদনের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। এমনকি এ গ্রামের প্রত্যেকটি ঘরে স্মার্ট মিটার রয়েছে। যার মাধ্যমে তারা ঘরবাড়িতে কতটুকু বিদ্যুতের প্রয়োজন, কতটুকু বিদ্যুৎ মজুত রয়েছে এবং সৌরশক্তিকে কীভাবে দিনের বিভিন্ন সময় আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়, পরিবেশের তারতম্য অনুসারে সেগুলোর অ্যাপ্লিকেশন এবং দিকনির্দেশনা রয়েছে। যার মাধ্যমে তারা খুব সহজেই শুধু নিজের ঘরের জন্য নয়, পুরো গ্রামের জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চয় করতে পারে। গ্রামটির খামারগুলোতে এমন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে যেখানে খামারগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সেখানকার পশুপাখির চাহিদা অনুযায়ী আপনাআপনিই পরিবর্তিত হয়। গ্রামটির প্রতিটি স্থাপনায় যেন গ্রামের নিজস্ব কৃষ্টি এবং কালচারের ছাপ রয়েছে। প্রতিটি স্থাপনা তৈরির উপকরণগুলো গ্রামটির নিজস্ব চিত্র বহন করবে। বৈচিত্র্যের দিক থেকে প্রত্যেকটি স্থাপনায় আধুনিকতার ছায়া রয়েছে। গ্রামটির মধ্যে সাধারণরা পায়ে হাঁটার ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনের সব চাহিদা পূরণ করতে পারে যেমন—চিকিৎসাসেবা, শিক্ষাসেবা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি। এমন অনেক অসাধারণ গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেই স্মার্ট গ্রামটিতে যার আরও গল্প হয়তো পরে করা যাবে। এবার একটু বর্তমানে ফিরে আসি।
আমরা আজ যে স্মার্ট গ্রাম উন্নয়নের কথা বলছি সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন আজ থেকে বহু বছর আগে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তানাকার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে যমুনা বহুমুখী সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু) নির্মাণের স্বপ্নের কথা প্রথম সূচনা করেন, যা শুধু যাতায়াতের জন্য নয়, নদীর দুই প্রান্তের গ্রামগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মেলবন্ধনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গ্রাম ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের জন্য তিনি প্রাথমিকভাবে ৫০০ ডাক্তারকে গ্রামে নিয়োগ করেছিলেন যেন শহর আর গ্রামের স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য নিরসন হয়। এমনকি দেশের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা এবং ধারণ ও সমৃদ্ধির জন্য তিনি গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। আমরা সত্যি আশান্বিত হই প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশের গ্রামগুলোর উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। স্মার্ট গ্রাম উন্নয়নকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিবেচনা করছেন। বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের জুন মাসের এক ভাষণে বলেছিলেন দেশের প্রত্যেকটি মানুষ যেন খেতে পারে, আশ্রয় পাবে…। বলেছিলেন প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবনের অধিকারী হবে। আর এটি ছিল তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রধান লক্ষ্য। তার বিভিন্ন বক্তৃতায় উঠে আসে গ্রামের পরিবেশ, কৃষি, প্রকৃতি, আর সেইসঙ্গে কৃষকের কথা। নিজস্ব সংস্কৃতি, স্থাপত্য ও পরিকল্পনাকে বুঝতে হলে প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনার সমন্বয় এবং সেগুলোকে সঠিক পন্থায় অনুধাবন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বক্তৃতার মধ্যে এভাবেই বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনে তার মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি সর্বস্তরের বৃক্ষরোপণের ডাক দিয়েছিলেন, উপকূলীয় বনায়ন করেছিলেন, বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন প্রণয়ন করেছিলেন, জলাভূমি রক্ষার রূপরেখা প্রণয়ন করে বহুমুখী কর্মকাণ্ড করেছিলেন, যা ছিল সুস্থ সমাজ এবং পরিবেশবান্ধব সমাজব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সর্বত্রই তখন ছিল ধ্বংসলীলা। বাঙালির খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, কৃষির উৎপাদন এমনকি পুনর্বাসনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে তিনি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছিলেন এবং দেশের সার্বিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে দুর্ভিক্ষকে প্রতিহত করেছিলেন। প্রাথমিক সংকটগুলোকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। কলকারখানার উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো সম্ভব, পুনর্বাসনের ব্যবস্থাপনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কেমন রূপ ধারণ করবে এসব বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ চিন্তা ও বিশ্লেষণ তার কর্মধারার মধ্যে বিশদভাবে ছিল। তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। যার লক্ষ্যগুলো ছিল মূলত দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান, আর্থিক উন্নয়ন, পণ্যের চাহিদা, কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক এবং প্রযুক্তিগত কাঠামোতে সমসাময়িক রূপান্তর ইত্যাদি। এমনকি তার ভাবনার মধ্যে ছিল দেশের খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং কৃষিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। সেইসঙ্গে আরেকটি বিষয় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা হলো শ্রমশক্তির শহরমুখী অভিবাসন বন্ধ করা, যা বর্তমানে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ টেকসই উন্নয়নের জন্য দেশের শহরগুলোকে নিয়ে ভাবছি।
বর্তমানে আমরা শহর ও গ্রামের টেকসই উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। বিভিন্ন সভা-সেমিনার করছি। লেখালেখি করছি। নতুন পরিকল্পনা করছি। নতুনভাবে নগর এবং শহরের প্রস্তাবনা করছি। সেতু, ভবন, কারখানা এককথায় নগরায়ণ শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের কথা ভাবছি। কিন্তু যে বিষয়টিকে এখানে গুরুত্বারোপ করছি সেটি হলো আমাদের এই স্মার্ট-টেকসই উন্নয়নের ধরন কেমন হবে কিংবা গ্রাম-নগরায়ণ-শিল্পায়ন কেমন হবে সেসব বিষয় যদি বঙ্গবন্ধুর দর্শন থেকে আরও নিবিড়ভাবে নেওয়া যেত গবেষণার মাধ্যমে তাহলে হয়তো টেকসই উন্নয়নের আরও একটি ধাপ স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা এগিয়ে নিতে পারতাম। তাদের ভাবনা এবং চিন্তার জায়গাগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে স্থাপত্য, প্রকৌশল আর নগরায়ণের দিক থেকে বিশদভাবে গবেষণার মাধ্যমে নতুন কোনো পরিকল্পনা করা সম্ভব হলে হয়তো দেশের চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের জন্য বিরাট একটি প্রাপ্তি হতো। কী তার নগরায়ণ, গ্রামোন্নয়নের অথবা শিল্পায়নের ভাবনা? এ সম্পর্কে আরও বিশদ পরিকল্পিত গবেষণার প্রয়োজন অবশ্যই। এজন্য প্রয়োজন একটি স্বতন্ত্র জাতীয় ‘বঙ্গবন্ধু গ্রাম ও নগর উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র’ কিংবা প্রতিষ্ঠান, যেখানে শুধু বাস্তবায়িত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ।
লেখক: সজল চৌধুরী; স্থপতি, শিক্ষক ও স্থাপত্য পরিবেশবিষয়ক গবেষক