640
Published on মার্চ 26, 2024১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৯ মাস ধরেই চালিয়েছিল মানবেতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। নারী, শিশুসহ প্রাণ গিয়েছিল ৩০ লাখ বাঙালির। কয়েক লাখ নারী তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। গ্রামের পর গ্রাম, নগর, জনপদ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এত বেশিসংখ্যক মানুষ হত্যার ঘটনা দ্বিতীয়টি নেই।
পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায় পুরান ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও সংলগ্ন এলাকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানায় থাকা তৎকালীন ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স ও আশপাশের এলাকায়। কারফিউ জারি করা হয় সারা শহরে। জনবসতিতে দেওয়া হয় আগুন।
বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। প্রাণভয়ে ছুটে পালানো মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে মারা হয়। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে ওঠে লাশের শহর। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ হত্যার পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
অপারেশন সার্চলাইট ছিল পূর্বপরিকল্পিত। সেই রাতে ঢাকায় কত মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর কামান ও বন্দুকের গুলিতে মারা যায় তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায় না। ঢাকার অলিগলি, ফুটপাতে থাকা নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই রাতেই ঢাকা শহরে ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে বলে গবেষকদের অনেকের ধারণা। নির্বিচারে মানুষ হত্যার এই অভিযান পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধের ৯ মাস বন্ধ করেনি।
ঢাকাসহ অন্য শহরগুলো থেকে দলে দলে মানুষ প্রাণ নিয়ে গ্রামের দিকে যাওয়ার পথে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে, বুড়িগঙ্গায় নৌকাযোগে পার হতে গিয়ে অনেকেই নৃশংস হত্যার শিকার হয়, নদীর ওপারে আশ্রয় নিতে বা দিতে গিয়েও অনেকে হত্যার শিকার হয়। এই হত্যা অব্যাহত থাকে গ্রামে-গঞ্জে, সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময়—যেখানেই নিরস্ত্র মানুষকে দল বেঁধে কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে যেতে দেখেছে, সেখানেই নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এ ধরনের অসংখ্য গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
গণহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে রবার্ট পাইন ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ম্যাসাকার’ গ্রন্থে লিখেছেন, “মূলত ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলরা আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকদের খতম করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ফেব্রুয়ারি মাসের এক সেনা-বৈঠকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান—‘ওদের তিন মিলিয়ন খতম করে দাও। দেখবে বাদবাকিরা আমাদের হাত থেকেই খাবার নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে।’ সত্যি সত্যি তিন মিলিয়ন অর্থাৎ ৩০ লাখ নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে বর্বররা নির্মমভাবে হত্যা করে। ধর্ষণের শিকার হয় এ দেশের কয়েক লাখ নারী। নারীরা শিকার হয়েছিল ধর্ষণ, গণধর্ষণ শেষে হত্যার—যার সূচনা হয় ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং পিলখানায় ইপিআর সদস্য বাঙালি জোয়ানদের হত্যার মধ্য দিয়ে।”
সেদিনের সেই কালো স্মৃতি স্মরণ করে ‘বাংলা নামে দেশ’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে, ‘অন্যান্য দিনের মতোই দিনমজুর সারা দিন তার হাড়ভাঙা খাটুনির পর ক্লান্ত দেহখানি এলিয়ে দিয়েছিল বিছানায়, দোকানি তার দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরেছে, গৃহবধূ ঘরকন্না সেরে কেবল বিছানায় শুয়েছে। শিশুরা গভীর ঘুমে মগ্ন, ছাত্ররা পড়াশোনা রেখে এইমাত্র বিছানায় গিয়েছে, চাষি তার নতুন ফসলের স্বপ্নে বিভোর, ঠিক সেই মুহূর্তে ইয়াহিয়ার নরপিশাচরা তাদের হিংস্র থাবার আঘাত হানল বাংলার বুকে। শ্রমিক, দোকানি, গৃহবধূ, শিশু, ছাত্র, কৃষক, পুলিশ, ইপিআর সবার ওপরই নেমে এলো সেই কালরাতের নিষ্ঠুরতা। ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ কাউকে বাঁচাতে পারল না। ঘুমন্ত গৃহবধূ, শ্রমিক, শিশু, ছাত্র, দোকানি, পুলিশ, ইপিআর বুলেটের আঘাতে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে গেল। স্বাধীনতার রক্তসূর্য দেখার সৌভাগ্য আর হলো না। টিক্কা খানের ভয়াবহ রক্তস্নানের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ল বাংলার সর্বত্র। বইয়ে দিল রক্তবন্যা।’
এ যুগে বহু হত্যাকাণ্ড হয়েছে, যেগুলোকে বলা হয় বর্বর গণহত্যা। সব হত্যাকাণ্ড ও বর্বরতাকে ম্লান করেছে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বর্বর হত্যাকাণ্ড। একদিকে চলেছে গণহত্যা ও গণধর্ষণ, অন্যদিকে চলেছে তালিকাভুক্ত দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চিহ্নিত হয়ে আছে কালরাত হিসেবে।
প্রতিটি গণহত্যার একটি রাজনীতি আছে। বাংলাদেশে গণহত্যারও একটি রাজনীতি ছিল। সেই রাজনীতিকে রাজনীতি না বলে অপরাজনীতি বলা যায়, অজুহাত তৈরি করে গণহত্যার এবং গণহত্যা অস্বীকারের।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাঙালিকে একটি আত্মমর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে নতুন করে পরিচিত করেছে। বাংলাদেশ চায় আন্তর্জাতিক মহল দিবসটিকে স্বীকৃতি দিক। এর জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে তুলে ধরতে হবে একাত্তরের গণহত্যার ইতিহাস। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে এ জন্য তৎপরতা বাড়াতে হবে। সবার আন্তরিক সহযোগিতায় গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন হবে না।
লেখক: এম নজরুল ইসলাম; সর্ব-ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ