842
Published on ফেব্রুয়ারি 21, 2024রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ‘একুশে পদক ২০২৩’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের জন্য বারবার কারাবরণ করলেও তার অবদান ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান, সেই অবদানটুকু কিন্তু মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।’
ইতিহাসের অমোঘ সত্য কখনো মুছে ফেলা যায় না। সত্য একসময় প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে বড় ভূমিকা ছিল, সে কথা এখন সবার কাছে স্পষ্ট। ভাষার জন্য তার এই লড়াই যখন শুরু তখন তিনি জাতির পিতা নন, বঙ্গবন্ধু নন। কেবলই শেখ মুজিবুর রহমান। কারো কাছে শেখ মুজিব। কারো কাছে শেখ সাহেব। কারো কাছে মুজিব ভাই। সেই সময়ের কথামূলে ধরে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার ‘ভাষাসংগ্রামের এক বিস্মৃত অধ্যায়’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ভাষাসংগ্রামে একটি বিস্মৃত অধ্যায় ভাষাসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা। অনেকের ধারণা, ১৯৪৮ সালে যে ভাষাসংগ্রামের শুরু তিনি বুঝি শুধু তাতেই জড়িত ছিলেন, তা নয়। ভাষার লড়াইয়ে তিনি যুক্ত হন অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতায় কলেজে পড়ার সময়। ...১৯৪৮ সালেই বাংলা ভাষার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয় তাতে শেখ মুজিবের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ...১৯৫৪ সালে যখন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের নামে তার নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে আবুল মনসুর আহমদ ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেন; তাতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি অন্তর্ভুক্ত করেন শেখ মুজিব। ...১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সার্বিকভাবে যুক্ত ছিলেন। ভাষার দাবিতে মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের লাঠিতে আহত হয়েছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি তিনি ছিলেন জেলে। তা সত্ত্বেও জেল থেকে গোপন চিরকুট পাঠিয়ে ছাত্রলীগকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রস্তাবে ভোট দেয়। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমগাছতলায় সব ছাত্রদলের যে সভা হয় তাতে ছাত্রলীগ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। না দিলে রক্তরাঙা একুশের ইতিহাস সৃষ্টি হতো না।’
আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদার দাবি, স্বাধিকার সংগ্রাম ও আর্থসামাজিক অর্জনের ভিত্তি মহান একুশ। ১৯৫৩ সালের নভেম্বরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে তাদের প্রতিশ্রুত ২১ দফার প্রথম দফায় ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। অন্য কোনো উপায় না দেখে বাঙালির ভাষার দাবি মেনে ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালে পাকিস্তানে প্রথম ও দ্বিতীয় সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। গৌরবোজ্জ্বল এই স্বীকৃতি আদায়ের পর ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন। তারপর ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান সম্পর্কিত আইন গৃহীত হয়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়: এই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসর গোলাম আযম-নিজামীগং কর্তৃক ধ্বংসকৃত শহীদ মিনার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে পুনর্নিমাণ, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রথম বাংলায় ভাষণ–এই সবই প্রমাণ করে বাঙালির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি বাংলা ভাষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপসহীন।
আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখনে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি ও সংগঠনের প্রধান স্থপতি–এ কথা আজ ঐতিহাসিক সত্য।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু তারও আগে, যখন পাকিস্তান সৃষ্টির কথাবার্তা চলছে, তখন বাংলাকে পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালের ৭ জুলাই কলকাতার ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর এই দাবি প্রকাশিত হয়েছিল। (বিশ্বজিৎ ঘোষ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তৃতা দিতে যান। সেই বক্তৃতা তিনি বাংলায় দেন। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনেও তিনি বাংলায় ভাষণ দেন। বাংলা ভাষাকে তিনি আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের পথে এগিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলা ভাষাকে এমন একটি স্তরে পৌঁছানো, যাতে বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা–সর্বত্র অভিন্নভাবে বিস্তার লাভ করে। বাংলাদেশ ভাগ হোক কিন্তু বাংলা ভাষার ভিত্তিতে যেন এক ভাষাভিত্তিক অখণ্ড বাঙালি জাতীয়তা গড়ে ওঠে।
‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমির এক সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘ভাষা যদি উন্নত না হয়, তাহলে বাংলাদেশের উন্নতিও ঘটবে না। বিদেশে গিয়ে আমরা বাংলা বলতে লজ্জাবোধ করি। এই লজ্জা ত্যাগ করতে হবে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ভালো ইংরেজি জানতেন। তবু বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলার সময় তার নিজ ভাষা উর্দুতে বলতেন। একজন দোভাষী তার কথা বিদেশিকে জানাতেন। আমি বিদেশিদের সঙ্গেও বাংলায় কথা বলতে চাই। আমাদের ঘরের পরিচারকদের ভাষা যদি উর্দু হয় আমরাও তার সঙ্গে উর্দুতে কথা বলার চেষ্টা করি। বাংলায় কথা বলি না। এটা হীনম্মন্যতা। বিদেশিরা ঘরের পরিচারকদের সঙ্গে নিজ ভাষায় কথা বলেন। তাদেরকে ওই ভাষা শেখান। আমি বিশেষভাবে লক্ষ করেছি, আমাদের ডাক বিভাগের বেশিরভাগ কর্মচারী উর্দুভাষী। আমরাও তাদের সঙ্গে ভাঙা উর্দুতে কথা বলার চেষ্টা করি। এই প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে। বাংলায় যেসব উর্দুভাষী অবাঙালি আছেন তাদের বাংলা বলতে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করতে হবে। তাহলেই তারা বাঙালি সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। বাঙালিদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য ও বিভেদ কমে আসবে।’
৪ মার্চ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটির পক্ষে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিসংবলিত এক লিফলেটে স্বাক্ষর করেন। ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করে সচিবালয়ে ছাত্র বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়ে তিনিসহ কিছু ছাত্র গ্রেফতার হন।
১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব বাংলার প্রথম অসাম্প্রদায়িক যুব প্রতিষ্ঠান ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’। সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব পাঠ করেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বলেন: ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক। এবং জনসাধারণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ (বিশ্বজিৎ ঘোষ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)।
১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে কি হবে না–এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যই এই সভার আয়োজন। বৈঠক চলাকালে বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মী-শিক্ষক-ছাত্ররা বর্ধমান হাউসে মিছিল সহকারে উপস্থিত হন। মিছিলে একটাই মাত্র স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান মিছিলে নেতৃত্ব দেন এবং বজ্রকণ্ঠে স্লোগান উচ্চারণ করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন গণতান্ত্রিক যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকরা নানা কৌশলে বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। হরফ পরিবর্তন ছিল তাদের চক্রান্তেরই একটা অংশ। ফজলুর রহমান আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করলে ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পূর্ববঙ্গের ১৪ জন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিসহ ২১ দফাসংবলিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। ওই পুস্তিকার ২১ দফার মধ্যে ষষ্ঠ দফাটি ছিল রাষ্ট্রভাষাসংক্রান্ত। এই পুস্তিকা প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং পুস্তিকায় ১৪ জনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।
বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অভিন্ন। তিনি বাংলা ভাষারও বান্ধব।
ভাষাশহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: এম. নজরুল ইসলাম, সভাপতি, সর্ব-ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ