বিএনপি-জামায়াত আমলে রাষ্ট্রীয় মদদে বিরোধীদলের ওপর সন্ত্রাস-নির্যাতনের রক্তাক্ত ইতিহাস

612

Published on ফেব্রুয়ারি 14, 2024
  • Details Image

২০০১ সালের ১৩ই জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা ঘটে। ৫ বছর দেশ পরিচালনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এরপরই গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। সারাদেশে শুরু হয় হামলা-খুন-নির্যাতন। ১লা অক্টোবর নির্বাচনের দিন এর মাত্রা বাড়তে থাকে। ভোটকেন্দ্র ও আশপাশের এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগের সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিএনপি-জামায়াত। ৭১-এর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর আদলে সারাদেশে শুরু হয় হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের নারকীয় উৎসব। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে দেশ। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার নিয়ন্ত্রিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিথর মূর্তির মতো তামাশা দেখতে থাকে।

পরবর্তী ৫ বছর প্রতিহিংসার নির্মমতা দেখেছিল বাংলাদেশ, ভয়ে শিউরে উঠেছিল মানুষ। জার্মান নাৎসি বাহিনীর মতো প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার বন্য হিংস্রতার ভয়াবহ রূপ দেখেছিল বাংলাদেশ। চিরতরে আওয়ামী লীগকে খতম করার পরিকল্পনা হয়। দেশে আইনের শাসন ছিল না। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়কে তাই আখ্যা দেয়া হয়েছিল ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ নামে।

বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ নির্বিঘ্নে রক্তপাত ও বোমা-গ্রেনেড হামলামুক্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। এখন তো বিএনপি নিয়মিত লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় নামে, সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হুমকি, হুঁশিয়ারি দেন সমাবেশে। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে ভাঙচুর, অগ্নিসন্ত্রাস, নাশকতা করছেন। অথচ তাদের নেতারা মিডিয়ায় এসে দেবদূত সাজেন। বিএনপি দুই মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল। বিরোধীদলের ওপর যে অন্যায়, নির্যাতন, নিপীড়ন ও অত্যাচার চালিয়েছে তারা, তা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যায়নি।

বিএনপি-জামায়াত আসলে কেমন ছিল বাংলাদেশ?

২০০১ থেকে ২০০৬ সালের পত্রিকাগুলোর সংবাদ শিরোনামেই দেখা যায়, আওয়ামী লীগের সমাবেশ বা কর্মসূচির আগে গণগ্রেপ্তার করা হতো। একেক দিনে ৮-১০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০০২ সালের মার্চে আওয়ামী লীগ নেতা বাহাউদ্দিন নাছিমকে বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রাজধানী ঢাকায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কারাগারে বন্দিকালীন অবস্থায় তার হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। একটি ব্যাগ দিয়ে তার মাথা ঢেকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে উল্টো করে ঝোলানো হয়। পানিভর্তি বোতল দিয়ে তার নিতম্ব, হাঁটু, কোমর, বাহু ও যৌনাঙ্গে আঘাত করা হয়। ফ্যান চালু করে তার শরীর চারদিকে ঘোরানো হয়। বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। এভাবে ৫ দিন ধরে তাকে একটানা নির্যাতন করা হয়।’

শুধু বাহাউদ্দিন নাছিম একা নন, সাবের হোসেন চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সেলিম সামাদ, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনের মতো ব্যক্তিদের পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। সমাবেশে গ্রেনেড ছুড়ে আহসানউল্লাহ মাস্টার এবং শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যার মতো সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশ হলেই রাষ্ট্র্রীয় মদদে পুলিশি অ্যাকশন শুরু হয়ে যেত। কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক পেটানো হতো কুকুরের মত। এমনকি নারী নেত্রীদের শরীর থেকে কাপড় খুলে নেয়ার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে এই বিএনপি-জামায়াত।

২০০৪ সালের ২১শে আগস্টে আওয়ামী লীগের ডাকা সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা সারাবিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা-কর্মী এবং এর সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা নিহত হন এবং আহত হন ৫শ’ জনেরও বেশি নেতা-কর্মী। নিহতদের মধ্যে ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মরহুম প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ। এই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে বিএনপি নেতারা ঠাট্টাও করেছে। এই সময়েই আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ১৮ বারের বেশি চেষ্টা চালানো হয়। এজন্য বিএনপি-জামায়াত হুজি ও জেএমবির মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে এবং হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংসতার জন্য তাদের রাজনৈতিক নিরাপত্তাও প্রদান করে।

বরিশালে বিএনপির গডফাদার মজিবর রহমান সরোয়ারের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে আওয়ামী লীগ কোনো জনসভা দূরে থাক, সাধারণ সভা, সমাবেশ কিছুই করতে পারেনি বিএনপি-জামায়াত আমলে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে পলিয়ে বেড়াতে হয়েছে সেই সময়টায়। এই চিত্র শুধু বরিশালের নয়, সারাদেশে এই দৃশ্য ছিল অত্যন্ত সাধারণ। এতই সাধারণ ঘটনা ছিল যে, পত্রিকাগুলো এসব ঘটনাকে সংবাদই মনে করত না আর।

থানার ওসি নিজের প্রাণ বাঁচাতে জিডি করেছেন:

চট্টগ্রামের রাউজানের পকিস্থানি দালাল কুখ্যাত ফকা চৌধুরীর রাজাকার পুত্ররা পুরো চট্টগ্রামকে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলে। দিনে-দুপুরে সেখানে রাস্তা দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী হাঁটতে পারত না ভয়ে, এই বুঝি প্রাণ যায়! রাউজান পৌরসভা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক কর্মীসভায় বিএনপি নেতা সাবেক এমপি রাজাকার গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী (গিকা চৌধুরী) দম্ভের সাথে জানান, রাউজান থানার ভূতপূর্ব ওসি আবুল হোসেনকে হত্যার জন্যে তার মাত্র ৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল। পরবর্তী ওসিকেও হত্যার হুমকি দিয়ে গিকা চৌধুরী বলেন তাকে হত্যার জন্য হয়ত কিছু বেশি খরচ হতে পারে। অবস্থা দেখে নিজের জীবন রক্ষার্থে সেই ওসি থানায় জিডি করেন। যেখানে পুলিশের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নাই, সেখানে সাধারণ মানুষ আর কতটুকু আশা করতে পারে! এমনই ছিল সেসময়কার পরিস্থিতি।

সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর সন্ত্রাস:

২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্রদল ও শিবিরের দখলে চলে যায়। ২রা অক্টোবর ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল করে নেয় তারা। ১৮ই অক্টোবর দেশের দৈনিকগুলোর শিরোনাম ছিল- ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররা’। ২০০১ সালের ১৩ই অক্টোবর ক্যাম্পাসে ঢুকতে চাইলে ছাত্রলীগকে বেধড়ক পেটানো হয়। ছাত্রলীগের বহু কর্মী পরীক্ষা দিতে পারেননি। ৩রা নভেম্বর চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ কর্মীদের নির্বিচারে পেটানো হয়। এভাবেই বিএনপি-জামায়াতের ৫ বছর চলে ছাত্রলীগ নিধন কর্মসূচি। দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। পুরো ৫ বছরে আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়। অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরিসহ বহু শিক্ষককে হত্যা করে আন্তর্জাতিকভাবে কালো তালিকাভুক্ত ৩য় কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রশিবির।

আওয়ামী লীগকে সভা-সমাবেশে বাধা, নেতা-কর্মী, সমর্থকদের হত্যা, নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনায় মামলা নেয়া হতো না, বেশি আলোচিত হলে জিডি করা হতো। কিন্তু অপরাধী ধরা হতো না। উল্টো বাদীপক্ষকে পড়তে হতো পুলিশি হয়রানির মুখে, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ তুলে নিতে হুমকি, বাড়ির নারী সদস্যদের তুলে নেয়াসহ নানারকম নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিল। জাতীয় পর্যায়ের কোনো নেতা মামলা করতে পারলে কিছুটা আলোচনায় আসত। তবে বিএনপি-জামায়াত তথা সরকারের পক্ষ থেকে সেসব ফৌজদারি মামলা খারিজের জন্য বিচারকদের চাপ দেয়া হতো। বেকসুর খালাস পেয়ে যেত বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। উল্লেখ্য, বুয়েট ছাত্রী সনির হত্যাকারী দুই ছাত্রদল ক্যাডারের সাজা হওয়ার পরেও তাদের জামিনে বের করে এনে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল সেসময়।

আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো, পুলিশ তুলে নিয়ে যেত বাড়ি থেকে। শুধুমাত্র ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার প্রথম ৬ মাসেই পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে অন্তত ১৫ জন আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায় মানবাধিকা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে। যদিও প্রকৃত ঘটনা এরচেয়েও অনেক বেশি। পুলিশ সেসময় এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, আটককৃতদের ওপর নির্যাতন হয়নি। জোট সরকারের মদদে সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হত্যা, গুম, হাত-পা-রগ কেটে দেওয়া ছাড়াও, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে চাঁদাবাজি, লুটপাট, ডাকাতি করত, বাড়ির নারীদের শ্লীলতাহানি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় করত। এছাড়া হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণের মত জঘন্য কাজও করা হয়েছে। সংখ্যালঘু, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থক এবং ভিন্নমতালম্বীদের ওপর নেমে এসেছিল নির্যাতন-নিপীড়নের স্টিম রোলার। নির্যাতিতরা আইন ও প্রশাসনের আশ্রয় নিতে চাইলে কোনো ফল মেলেনি, উল্টো নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ।

বিএনপি-জামায়াত আমলে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর নৃশংস নির্যাতনের ৪০৯২টি ঘটনা

আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ততার দায়ে আটক সিনিয়র সাংবাদিক এনামুল হক চৌধুরী পুলিশ হেফাজত থেকে মুক্তি পেয়ে হুমকি সত্ত্বেও ফাঁস করে দেন, কীভাবে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল। অকথ্য শারীরিক নির্যাতন করা হয়, বৈদ্যুতিক শক দেয়ার পাশাপাশি মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে বারবার তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হতো। রাজশাহীর মৌগাছি এলাকার একবরপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী আব্দুল গাফফার ২০০২ সালের ৬ই মে পুলিশ হেফাজতে মারা যান। মিথ্যা সাক্ষী দেয়ার জন্য তাকে লাঠিসোটা ও রাইফেলের বাট দিয়ে মারধর করা হয়। গ্রামবাসীদের প্রতিবাদের মুখেও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

শুধু আওয়ামী লীগই নয়, যৌক্তিক দাবিতে রাস্তায় নামা যে কোনো সংগঠন বা গোষ্ঠীর ওপর চরম নির্যাতন করে রাস্তা থেকে হঠিয়ে দিত বিএনপি-জামায়াত সরকার। চাকরির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসা ৩৮টি নার্সিং প্রতিষ্ঠানের কর্মহীন নার্স ও শিক্ষার্থীর ওপর হামলা করে পুলিশ। যাতে গুরুতর আহত হন শতাধিক নার্স। অন্তত ৪০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, যাদের হাত-পা ভেঙে গিয়েছিল। এরমধ্যে ১১ জন ছিল মৃত্যুশয্যায়। সার ও বিদ্যুতের দাবিতের রাস্তায় নামা সাধারণ মানুষ ও কৃষকদের তো গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, এখনো সাধারণ মানুষ এসব ঘটনা ভুলে যায়নি।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত