4657
Published on ডিসেম্বর 29, 2023বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে ভবিষ্যতে কী কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে চায় আওয়ামী লীগ, সেসব বিষয়গুলো তুলে ধরেছে নির্বাচনী ইশতেহারে । তার মধ্যে একটি হলো নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। নতুন করে সরকারে এলে দলটি আরও কী কী পদক্ষেপ নেবে তাও জানিয়েছে।
বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এ ইশতেহার ঘোষণা করেন।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইশতেহার দিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ‘দিন বদলের সনদ‘, ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ ‘তারুণ্যের শক্তি’, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’র পর এবার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ইশতেহার দিল। এ ইশতেহারে শুধু পাঁচ বছর নয়, ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ গড়ার কথাও উঠে এসেছে। এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের শ্লোগান হলো স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান।
উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যাপ্ত, নির্ভরযোগ্য ও ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মূল্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংস্থান একটি পূর্বশর্ত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে বিদেশি শোষণ চিরতরে বন্ধ এবং জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষা দিতে, দেশের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদসহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের সময় (১৯৯৬ থেকে ২০০১) জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের ব্যাপক লুটপাট, অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কারণে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার সরকারের তিন মেয়াদে দেশে যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক উন্নয়ন করা হয়। ফলে শিল্প ও বাণিজ্য খাত প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলসহ দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন ও অগ্রগতি-
ক. একক জ্বালানি উৎসের উপর নির্ভরতার অতীতের সরকারগুলোর ভ্রান্ত নীতি পরিহার করে শেখ হাসিনার সরকার জ্বালানি বহুমুখীকরণের নীতি গ্রহণ করেছে। মানসম্মত ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।
খ. দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে।
গ.মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২২৮ কিলোওয়াট (২০০৮ সালে) থেকে বৃদ্ধি করে ৬০৯ কিলোওয়াটে উন্নীত করা হয়েছে।
ঘ.বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৮ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়েছে; যেখানে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ৩ হাজার ২৬৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল।
ঙ.ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমাদের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার মাধ্যমে, ভারত থেকে মোট ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চ.ক্লিন এনার্জি অর্থাৎ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়েছে। বায়ুভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এবং বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে নিম্নলিখিত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে:
ক. পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র;
খ. রামপাল মৈত্রী সুপার থার্মাল ১ হাজর ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র;
গ. মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প।
ঘ.২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুতায়িত বিতরণ লাইন ৬ লাখ ২৯ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে, যা ২০০৯ সালের পূর্বে ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার।
ঙ.রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কার্যক্রম সফলভাবে শেষ হচ্ছে। ২০২৪ সালের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হচ্ছে।
চ.বিদ্যুতের বিতরণ সিস্টেম লস সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হয়েছে। ২০০৯ সালের পূর্বে সিস্টেম লস ছিল ১৮.৮৫ শতাংশ।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার-
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়া ও উন্নয়নশীল বিশ্বের একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়টিকে জাতীয় নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই নীতি অব্যাহতভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।
১.নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।
২.বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। পর্যায়ক্রমে ভাড়াভিত্তিক ও অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহ বন্ধ (রিটায়ারমেন্ট) করা হবে।
৩.পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে দশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। নবায়নযোগ্য ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য গ্রিড যুগোপযোগী করা হবে।
৪.নেপাল ও ভূটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি এবং এই অঞ্চলে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাণিজ্য তরান্বিত করা হবে।
৫.সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৪ হাজার সার্কিট কিলোমিটারে উন্নীত করা হবে।
৬.পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় সঞ্চালন লাইন নির্মাণ ও পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
জ্বালানি খাতে উন্নয়ন ও অগ্রগতি-
১.গ্যাসের উৎপাদন ২০২২ সালের জুন মাসে দৈনিক ২ হাজার ৭৫২ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে এটি ছিল দৈনিক ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট।
২.সরকার ‘প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১’ এর মাধ্যমে ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ যৌথভাবে ২০২৩ প্রণয়ন করেছে।৩.নতুন ৬টি গ্যাসক্ষেত্র (সুন্দলপুর, শ্রীকাইল, রূপগঞ্জ, ভোলা নর্থ, জকিগঞ্জ ও ইলিশা) আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া, প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে বৈদেশিক নির্ভরশীলতা কমানোর লক্ষ্যে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স-এর সক্ষমতা (১টি রিগ পুনর্বাসন, ৪টি নতুন রিগ ক্রয় ও অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ক্রয়) বৃদ্ধি করা হয়েছে।
৪.দেশের সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশব্যাপী গ্যাস নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য বর্তমান সরকারের সময়ে মোট ১ হাজার ৫২৩ কিলোমিটার ঘনফুট গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে।
৫. ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদা নিরসনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য প্রতিটি ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতার ২টি ভাসমান টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে।
৬. তৃতীয় ও চতুর্থটি যথাক্রমে কক্সবাজারের মহেশখালী ও পটুয়াখালীর পায়রাতে স্থাপন, মহেশখালীতে বিদ্যমান একটি এফএসআরইউ এর সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ এবং কক্সবাজারের মাতারবাড়ী এলাকায় দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল’ নির্মাণের লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
৭.জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ২০০৯ সালের ৯ লাখ মেট্রিক টন হতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩.০৯ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হওয়ার ফলে দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদা মেটানোর/মজুদের সময়কাল ৩০ দিন থেকে ৪০-৪৫ দিনে উন্নীত হয়েছে।
৮. দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ নির্বিঘ্নি করতে ভারতের নুমালীগড় রিফাইনারীর শিলিগুড়ি টার্মিনাল থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর, দিনাজপুর পর্যন্ত ১৩১.৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে।
৯.গভীর সমুদ্রে ভাসমান আনলোডিং ফ্যাসিলিটি ডাবল পাইপলাইনসহ একক পয়েন্ট মুরিং স্থাপনের মাধ্যমে আমদানিকৃত তেল জাহাজ হতে সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে দ্রুত, সহজ, নিরাপদ ও ব্যয় সাশ্রয়ীভাবে খালাস করা হচ্ছে। এসপিএম সিস্টেম চালুর ফলে তেল পরিবহন খাতে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
১০.বর্তমানে দেশের পেট্রোল এবং অকটেনের চাহিদার প্রায় সম্পূর্ণটুকুই অংশ সরকারি ও বেসরকারিভাবে স্থাপিত কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লান্ট ও অনুঘটক সংস্কার ইউনিটের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উৎস হতে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।
১১.জ্বালানি তেলের সরবরাহ নিশ্চিতকরণে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত তেল পাইপলাইন (২৪৯.৫৭ কিলোমিটার) নির্মাণ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এছাড়া ঢাকার হযরত শাহজালাল ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জ্বালানি তেল জেট-এ-১ সরাসরি ও নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহের জন্য প্রায় ২১ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।
১২. তরল জ্বালানি সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে। জানুয়ারি ২০০৯ এ লিক্যুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) মোট সরবরাহ ছিল ৪৫ হাজার মেট্রিক টন, বর্তমানে এর পরিমাণ প্রায় ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৪ লক্ষ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার-
১.নতুন কুপ খননের ফলে গ্যাস উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাফল্যের এই ধারাকে আরও বেগবান করা হবে।
২.দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে; গ্যাস ও এলপিজির সরবরাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হবে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে আরও দক্ষ করা হবে।
৩.জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রেখে কয়লানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই নীতির ভিত্তিতে কয়লা ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে।
৪.বিদেশি তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কুপ খনন ও উন্নয়নের চুক্তিতে দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখা হবে।
৫.প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের পরিমাণ নির্ধারণ, নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, উত্তোলন এবং গ্যাসের যুক্তিসংগত ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।
৬. জ্বালানি খাতে প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বিধি সম্পর্কে দেশের সক্ষমতা বিশ্বমানে উন্নীত করা হবে।
৭.ইস্টার্ন রিফাইনারির জ্বালানি তেল পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ মেট্রিক টন থেকে ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করা হবে।