981
Published on অক্টোবর 3, 2023মোঃ নজরুল ইসলাম:
বিএনপি চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দূর্নীতির মামলায় আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দন্ডিত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে আদালত জামিন দেননি। ফলে তার কারাগারে থাকার কথা। কিন্তু সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাড়ে তিন বছর কারামুক্ত স্বাধীন জীবনযাপন করছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মহানুভবতায়, সরকারের মানবিকতায় তিনি ২০২০ সালের ২৫ শে মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তির পর থেকে কখনো বাসায় আবার কখনো নিজের পছন্দের প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আত্মীয়স্বজন এবং নেতাকর্মীদের সাথে সাক্ষাত করছেন অবলীলায়! পৃথিবীর আর কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামির এ ধরনের সুযোগ প্রাপ্তির নজির আছে কি? কিন্তু তিনি কতটুকু কৃতজ্ঞ সরকারের কাছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে? কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো নয়-ই বরং যার কৃপায়, দয়ায় দন্ডিত আসামি খালেদা জিয়া মুক্ত জীবনযাপন করছেন; সভা, সমাবেশে তাকেই টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানোর প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছেন বিএনপি নেতারা।
শেখ হাসিনা জাতির পিতার কন্যা। মা, বাবা, ভাই, চাচা, ফুফা হারিয়ে বছরের পর বছর বুকফাঁটা আর্তনাদ আর চোখের জল ফেলেছেন। বিদেশে রিফুজি জীবন যাপন করেছেন। পরিবারের সদস্যদের পৈশাচিক হত্যাকান্ডের বিচার চেয়েছেন। লন্ডনের হাউস অব কমন্স সদস্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্তে গঠিত কমিশন যাতে বাংলাদেশে এসে ১৫ ই আগস্টের বর্বরোচিত হত্যার নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত করতে পারে সেটি চেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের তৎকালীন অবৈধ সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া তাদের বাংলাদেশে আসার ভিসা দেয়নি। অধিকন্তু এই হত্যাকান্ডে জড়িত স্বঘোষিত খুনিদের বিচার করা যাবে না মর্মে সংসদে আইন পাশ করেছেন। হত্যাকারীদের নিরাপদে বিদেশে যেতে সহায়তাই শুধু করেন নি, বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। শেখ হাসিনা সবকিছু দেখেছেন আর অশ্রুশিক্ত হয়েছেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি। তাই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বারবার দেশে আসতে চাইলেও তাদেরকে অবৈধ সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া বাধা দিয়েছেন। যদি গদি টলে যায়!
তবে কোনো বাধায় শেখ হাসিনাকে রুখে দিতে পারেনি। ১৯৮১ সালের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সকল বাধা উপেক্ষা করে ১৭ ই মে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলায় পদার্পণ করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। লাখো জনতার ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন। কিন্তু শাসকের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা এবং অমানবিকতা প্রত্যক্ষ করেছেন; হয়েছেন বেদনাসিক্ত। তিন ভাই এবং পিতা, মাতাকে হারিয়ে তাদের একমাত্র উত্তরসুরী হয়েও ধানমন্ডি-৩২ এর বাসভবনে প্রবেশ করতে পারেননি অবৈধ শাসকের বাধায়। ৩২ নম্বরের বাসায় সেদিন লম্বা তালা ঝুলেছিল সরকারের ইশারায়। জেনারেল জিয়ার পর আরেক অবৈধ শাসক জেনারেল এরশাদের শাসনামল ও ছিল মূদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এরশাদের ছত্রছায়ায় বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিরা প্রগশ এবং ফ্রিডম পার্টি নামক রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। ১৯৮৮ সালের ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা এদেশে এমপি হয়েছেন এরশাদের দয়ায়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারীর ভোটারবিহীন নির্বাচনে খালেদা জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা। পিতা, মাতা হত্যার বিচার তো পাননি, উল্টো খুনিদের বারবার পুরস্কৃত হতে দেখেছেন শেখ হাসিনা। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে বারবার কিন্তু ধৈর্য্য হারাননি। সুদিনের জন্য অপেক্ষা করেছেন, অপশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে সংগ্রাম করেছেন। গৃহবন্দি হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন; কিন্তু অন্যায়ের সাথে, অবৈধ শাসকদের সাথে আপোষ করেননি।
দীর্ঘ ২১ বছর আওয়ামী লীগকে কৌশলে বন্দুকের নলের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে দেয়নি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকেরা। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালের ১২ ই জুনের নির্বাচনে জনগণের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন শেখ হাসিনা। ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে সপরিবারে জাতির পিতা হত্যার বিচার শুরু করেন। রাষ্ট্রের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যার বিচার শুরু হয় নির্মম হত্যাকান্ডের ২১ বছর পর! শুরু হয় কারা অভ্যন্তরে নির্মমভাবে নিহত চার জাতীয় নেতা হত্যার বিচার। ২০০১ সালের ১ লা অক্টোবরের ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে পুনরায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং জেল হত্যা মামলার বিচার কৌশলে বন্ধ করে দেন বেগম খালেদা জিয়া। চাকুরি থেকে বরখাস্ত খুনি খায়রুজ্জামানকে পুনরায় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের চাকুরিতে পুনর্বহাল করা হয়। জেল হত্যা মামলার আসামি খুনি খায়রুজ্জামানকে জামিন দেওয়া হয়। অতপর জেল হত্যা মামলার রায়ের কিছুদিন পূর্বে তাকে প্রমোশন দিয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত করে পাঠায় খালেদা-নিজামীর জোট সরকার। রায়ের পূর্বে আসামিকে পুরস্কৃত করে সরকারের মনোভাব আদালতকে জানিয়ে দেওয়া হয়। ফলশ্রুতিতে ঐ মামলা থেকে খুনি খায়রুজ্জামান খালাস পান। শেখ হাসিনা এবং জাতীয় চার নেতার ছেলে-মেয়েদের সাথে বেগম খালেদা জিয়ার এর চেয়ে বড় অমানবিকতা আর কি হতে পারে?
২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট তৎকালীন খালেদা-নিজামী সরকারের মদদে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনা সহ দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার পৈশাচিক মিশন গ্রহন করে খালেদা পুত্র তারেক রহমান। শেখ হাসিনার দিকে ধেয়ে আসা বুলেট থেকে তাকে রক্ষা করতে গিয়ে তার দেহরক্ষী প্রাণ হারান। শেখ হাসিনা কে বাঁচাতে সেদিন মানববর্ম তৈরি করেন দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে ক্ষত-বিক্ষত হন প্রায় শতশত নেতাকর্মী। গ্রেনেড হামলায় বঙ্গবন্ধু কন্যার কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনো তিনি কানে কম শুনেন। হেয়ার এইড দিয়ে তাকে শুনতে হয়। গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমান সহ ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। গ্রেনেডের আঘাতে পঙ্গুত্ব বরণ করেন শত শত নেতাকর্মী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সহ বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক সেদিন খালেদা জিয়ার সরকারের নির্দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়। গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহতরা চিকিৎসার অধিকারটুকু সেদিন পাননি। এটি ছিল বেগম খালেদা জিয়ার মানবিক গণতন্ত্র! বেগম খালেদা জিয়ার এ রকম অসংখ্য অমানবিকতার উদাহরণ আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে। ১৫ ই আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডের দিনে তিনি বড় বড় কেক কেটে মিথ্যা জন্মদিন পালনের নামে বিকৃত আনন্দ উপভোগ করেন।
২০০১ সালের জুলাইয়ে জাতির পিতার কন্যা হিসেবে শেখ রেহানাকে ধানমন্ডিতে একটি বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। প্রতিহিংসা পরায়ণ বেগম জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে শেখ রেহানার নামে বাড়িটির বরাদ্দ বাতিল করে বাড়িটিকে ধানমন্ডি থানা হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক হুমায়ুন আজাদ সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হয়ে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। সেনানিবাসের গেটে শেখ হাসিনার গাড়ি আটকে দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে যেতে না দেওয়া। সেদিন পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে সিএমএইচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কেবলমাত্র জিঘাংসার বশবর্তী হয়েই বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি এরুপ অমানবিকতা দেখিয়েছেন খালেদা জিয়া। বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যুর পর 'মানবতার মা' শেখ হাসিনা সেদিন বেগম জিয়ার বাসায় ছুটে গিয়েছিলেন সন্তানহারা শোকসন্তপ্ত বেগম জিয়াকে সান্ত্বনা দিতে। সেদিন বেগম জিয়ার বাসভবনে তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
এভাবে বারবার বেগম জিয়ার চরম প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন শেখ হাসিনা এবং তার পরিবার। বিনিময়ে শেখ হাসিনা কি তেমনটি করেছেন তার সাথে? বিনা বিচারে একদিন ও খালেদা জিয়াকে কারান্তরীণ রাখেনি শেখ হাসিনার সরকার। ২০১৭ সালের অক্টোবরে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল আদালত। গ্রেফতারি পরোয়ানা আদালত থেকে গুলশান থানায় চার মাসেও পৌঁছেনি। এনিয়ে তখন অনেক হইচই হয়েছিল মিডিয়াতে। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার সরকার বেগম জিয়াকে গ্রেফতার না করায় অনেকেই উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন তখন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দন্ডিত হওয়ার পর খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হন। সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তিনি অসুস্থ হলে তার সর্বোচ্চ চিকিৎসা সু্বিধা নিশ্চিত করে সরকার। শেখ হাসিনার সাথে বারবার অমানবিকতা দেখিয়েছেন বেগম জিয়া অথচ তার দয়া, অনুকম্পা আর মানবিকতায় আজ সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও তিনি জেলের বাইরে। শেখ হাসিনার মানবিকতার কারনে কয়েকবার তার দন্ড স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সরকারের নির্বাহী আদেশে। জেলখানায় অন্তরীণ থাকা অবস্থায় জেলকোড ভঙ্গ করে তার আবেদনের ভিত্তিতে জেলখানায় তার ব্যক্তিগত গৃহপরিচারিকা নিযুক্তির সুযোগ দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
পরিবারের মানবিক আবেদনের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা সরকারের নির্বাহী আদেশে বেগম জিয়া এখন মুক্ত। বেগম জিয়া অনেকটাই অসুস্থ। পরিবারের জিম্মায় নিজের পছন্দের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অথচ বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থেকে বারবার শেখ হাসিনা কে হত্যার চেষ্টা করেছে। এখনো বিএনপির হাজারো নেতাকর্মীর হাতের উদ্ধত বন্দুকের লাখো সঙ্গিন শেখ হাসিনার বুকে তাক করা। বিএনপির নেতাকর্মীরা সভা, সমাবেশে শেখ হাসিনা পালাবার পথ পাবে না বলে হুংকার ছুড়ছেন। আরেকটি ১৫ ই আগস্ট ঘটানোর, শেখ হাসিনা কে কবরে পাঠানোর স্লোগান দিচ্ছেন প্রকাশ্যে! আবার রাতের টকশোতে তার কাছেই করজোড়ে মিনতি করছেন খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর জন্য, উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য। সরকারকে অনুরোধ করেন আর একটু মানবিক হওয়ার জন্য। বিএনপি নেতাদের এবং বেগম জিয়ার পরিবারের এখন চাওয়া শেখ হাসিনার মানবিকতায় দন্ডবিধির সকল ধারাকে উপেক্ষা করে সরকার নির্বাহী আদেশে তার বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুক! স্রষ্টার কি লীলাখেলা! যুগযুগ ধরে যাকে অমানবিকতার গ্রেনেড, বুলেটে বিদ্ধ করতে চেয়েছেন বেগম জিয়া আজ তার কাছেই মানবিক আবেদন করতে হচ্ছে নিজের চিকিৎসার জন্য! বিএনপির এক হাতে বন্দুক আর আরেক হাতে মানবিকতার আবেদন পত্র। বুকের দিকে তাক করে থাকা বিএনপির লাখো বুলেট কে তুচ্ছ করে শেখ হাসিনা মানবিকতার আবেদন গ্রহণ করবেন কি? করলেও অবাক হব না; কারণ তিনি তো মানবতার মা।
লেখক: কলামিস্ট ও তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা, খুলনা।