বঙ্গবন্ধু হত্যা: দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের নীলনকশার নটরাজ জিয়াউর রহমান

612

Published on আগস্ট 16, 2023
  • Details Image

১৯৭৫ সালের শুরু থেকেই সামরিক ও বেসামরিক কিছু সন্দেহভাজন ব্যক্তির সঙ্গে উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে। এমনকি সিনিয়র অফিসাররা সন্ধ্যায় সেনানিবাসের যেখানে লন টেনিস খেলতেন, খেলা শেষ হওয়ার পর সেই টেনিস কোর্টে নিয়মিত আড্ডা দিতে শুরু করে শৃঙ্খলাজনিত কারণে চাকরিচ্যুত মেজর নুর ও মেজর ডালিম। আগস্ট মাসে সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ বিষয়টি জানতে পেরে চাকরিচ্যুত জুনিয়র কর্মকর্তাদের সেনানিবাসে আড্ডা দিতে নিষেধ করার নির্দেশ দেন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার ম. হামিদকে। এরপর চাকরিচ্যুত মেজর নুর কর্নেল হামিদকে জানায় যে, তারা উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়ার অনুমতি নিয়েই এসেছে। এই তথ্য পরবর্তীতে সেনাপ্রধানকে জানালে তিনি কিছুটা বিব্রত বোধ এবং উপ-সেনাপ্রধানের এই কর্মে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট টেনিস কোর্টে ডালিম ও নুরের গতিবিধি অস্বাভাবিক মনে হয় তৎকালীন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল ম. হামিদের কাছেও। কিন্তু জেনারেল জিয়ার অনুমতি থাকায় তাদের কিছু বলতে পারেননি তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ৯ নম্বর সাক্ষী লে. কর্নেল ম. হামিদ আদালতকে এসব তথ্য জানান। এমনকি আসামিরাও বিভিন্ন সময় এই কথার সত্যতা স্বীকার করেছে।

এসব ব্যাপারে গণমাধ্যমকে দেওয়া সঘোষিত খুনি মেজর নুরের সাক্ষাতকার থেকে জানা যায়, একসময় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত স্টাফ অফিসার ছিল সে। তখন থেকেই জিয়াউর রহমান তাদের বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতো। আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে জিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করতো তারা। তবে জিয়া সরাসরি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে থাকতে অপারগতা প্রকাশ করে, কিন্তু পেছনে থেকে তাদের জন্য সবরকম সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।

উল্লেখ্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের নৃশংসভাবে হত্যার পর ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয় জিয়া। এরপর শৃঙ্খলাজনিত কারণে চাকরিচ্যুত ডালিম-নূরসহ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রমোশন দিয়ে চাকরিতে বহাল করে সে।

এদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চলাকালে আসামি মেজর ফারুকের আইনজীবী খান সাইফুর রহমান আদালতে বারবার দাবি করেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরেকটি তৃতীয় পক্ষ জড়িত। এমনকি বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে মেজর ফারুক নিজেও জানিয়েছে যে, শুধু জুনিয়র অফিসারদের পক্ষে এই ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জেনারেল জিয়া এই হত্যাকাণ্ডের কথা আগেই জানত। তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন অফিসারের পৃথক পৃথক আলোচনা হয়েছে এবিষয়ে।

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার আরেক ষড়যন্ত্রী তাহের উদ্দীন ঠাকুরের জবানবন্দি থেকে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের সময় দেওয়া লিখিত বক্তব্যে সে জানায়, ১৯৭৫ সালে কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে বিভাগীয় সম্মেলন চলাকালে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে দেখা করতে যায় কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা। তারা হলো- মেজর রশীদ ও মেজর বজলুল হুদা। সারাদিন মোশতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ওই দুই কর্মকর্তা। তাহের উদ্দীন ঠাকুরের আরো জানায়, ''আমি যখন খন্দকার মোশতাকের কাছে ওই কর্মকর্তাদের আসার কারণ জানতে চাই, সে কোনো উত্তর দেয় নাই। শুধু বলেছে যে, 'একজন সিনিয়র সেনাকর্মকর্তা'র হয়ে ওরা এসেছিল একটা বিষয়ে কথা বলতে। এরপর আর কিছু বলে নাই।''

তার সাক্ষ্য থেকে আরো জানা যায়, ৭৫-এর জুন মাসে গাজীপুরের শালনাতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মোশতাকের সঙ্গে কথা বলার জন্য কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা হাজির হয়। তাদের মধ্যে মেজর নুর, মেজর শাহরিয়ার, মেজর ফারুকের নাম মনে আছে। সেসময় মোশতাক তাদের জিজ্ঞেস করেছিল যে: তোমাদের আন্দোলনের কী অবস্থা। জবাবে তারা জানিয়েছিল: বস (সিনিয়র সেনা অফিসার) সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছেন, আমরা শুধু তার প্রতিনিধি মাত্র। পরবর্তীতে দেশে এবং বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া খুনিদের সাক্ষাৎকার থেকেই জানা যায়- তাদের সেই 'বস' এবং মোশতাকের বলা সেই 'সিনিয়র কর্মকর্তা'টি হলো তৎকালীন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

এমনকি খুনি ফারুকের সঙ্গেও জিয়াউর রহমানের ছিল অতি ঘনিষ্ঠ এক গোপন সম্পর্ক। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে ফেরার পথে লন্ডনে জুনিয়র অফিসার ফারুকের সু্টকেস বহন করেন তদানীন্তন উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান, যা সেনাবাহিনীর প্রটোকলে একেবারেই অকল্পনীয়। সেসময় লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসের অ্যাটাশে থাকা অবস্থায় কূটনীতিক শশাঙ্ক ব্যানার্জি বিষয়টি নোটিশ করেন। ভারতীয় এই কূটনীতিকের লেখা ‘ইন্ডিয়া, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ লিবারেশন অ্যান্ড পাকিস্তান’ (অ্যা পলিটিক্যাল ট্রিটিজ) গ্রন্থে এসব তথ্য উল্লেখ করেছেন তিনি।

৪ নভেম্বর বিশেষ বিমানে দেশত্যাগ করে থাইল্যান্ডে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। এরপর ১২ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে পরামর্শ করে তারা। মোশতাক ও জিয়ার নির্দেশে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্থানের সহযোগিতায় কয়েকজন খুনির পাসপোর্ট ঢাকায় এনে, লিবীয়ার ভিসা জোগাড় করে দেয়। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হয় এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর এই খুনিদের প্রমোশন দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে উচ্চ বেতনে চাকরিতে নিযুক্ত করে।

১৯৭৬ সালের ৩০ মে 'দ্যা সান ডে টাইমস'কে বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক রহমান এক বিবৃতিতে বলে যে, 'মুজিবকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার পর মোশতাক ও জিয়া আমাদের সঙ্গে সম্মত হন।'

একই বছরের খুনি ফারুক এবং রশীদ ইংল্যান্ডের আইটিভি টেলিভিশনে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানায় যে, 'উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ব্যাপারে জানালে জিয়া তাদের এগিয়ে যেতে বলেন এবং তাদের উৎসাহিত করে বলেন- তারা সফল হলে জিয়া তাদের সঙ্গেই থাকবে।' পরবর্তীতে খুনিদের বক্তব্যের বিষয়ে জিয়াউর রহমানের কাছে জানতে চাইলে সে কোনো জবাব দেয়নি বলে নিজের গ্রন্থ 'বাংলাদেশ: অ্যা লিগ্যাসি অব ব্লাড' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস।

পরবর্তীতে দেওয়া জবানবন্দিতে রশীদের স্ত্রী জোবায়দা রশীদও জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার কথা জানায়। জোবায়দা বলে, 'একদিন রাতে ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামী রশীদকে জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে জিয়া আরও বলে- এটি যদি সফল হয় তবে আমার কাছে এসো, আর যদি ব্যর্থ হয় তবে আমাকে জড়িত করো না।'

২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের গাড়িতে বোমা হামলার দায়ে পুলিশ আটক করে ফ্রিডম পার্টির সদস্য ও খুনি রশীদের মেয়ে মেহনাজ রশীদকে। এসময় খুনি খন্দকার আব্দুর রশীদের মেয়ে মেহনাজ রশীদ সবসময় তার পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ের বর্ণনা দিয়ে সে জানায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান অন্যান্য খুনিদের সঙ্গে তার বাবাকেও বিদেশে পাঠায়। তার বাবা আবদুর রশীদ লিবিয়াতে আশ্রয় নেয়। এরপর ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তার বাবা রশীদের অনুরোধে জিয়াউর রহমান তার স্ত্রী ও চার সন্তানকে (মেহনাজ রশীদসহ) থাইল্যান্ডে পাঠায়। সেখানে কয়েকমাস হোটেলে ছিল তারা। সেসময় জিয়াউর রহমান তার পরিবারের প্রতিদিনের হোটেল খরচ বাবদ ১০০ ডলার করে বরাদ্দ দিয়েছিল। এরপর দুবাই হয়ে তাদের লিবিয়াতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে জিয়াউর রহমান। এমনকি ঢাকার গুলশানে তাদের পরিবারের জন্য জিয়াউর রহমান একটি ডুপ্লেক্স বাড়িও উপহার দিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বাবার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং কখনো বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বাস্তবায়ন সম্ভব না বলে খালেদা জিয়া তাদের আশ্বস্ত করে রাজনীতি করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেই প্রেক্ষিতেই তারা ফ্রিডম পার্টির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর পরিচিত নেতারা দেশ ছেড়েছে বলেও জানায় মেহনাজ।

উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির কলঙ্কিত পাতানো নির্বাচনে এই খুনি রশীদকে কুমিল্লা-৬ আসন থেকে জিতিয়ে সংসদের বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু জনগণের তীব্র প্রতিরোধের কারণে সেই পাতানো একদলীয় নির্বাচন বাতিল করে আবারো নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় সরকার।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত