901
Published on আগস্ট 5, 2023এম নজরুল ইসলামঃ
তিনি ছিলেন উদ্যমী পুরুষ। সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে খেলার মাঠ—সর্বত্রই সমান দাপট। অথচ তাঁকে দীর্ঘদিন রাখা হয়েছিল বিস্মৃতির আড়ালে! তাঁর শিল্পীমনের পরিচয় কয়জনের জানা আছে? অনেকেই হয়তো জানেন না শেখ কামাল চমৎকার সেতার বাজাতেন। ছায়ানটের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দেশের সংগীতজগতে পপসংগীতের যে উত্থান, তার নেপথ্যে শেখ কামালের অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে সেই সময়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন’ শিল্পীগোষ্ঠী, যে দলটি দেশের সংগীতজগতে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিল সেই সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে। দেশের নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে শেখ কামাল ছিলেন প্রথমসারির সংগঠক। ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও।
অভিনেতা হিসেবেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। শৈশব থেকে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় উৎসাহী শেখ কামাল স্বাধীনতার পর আবির্ভূত হন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে।
আমাদের মুখর তরুণবেলা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরিয়ে দেওয়া মানুষটির নাম শেখ কামাল, আমাদের কামাল ভাই। দীর্ঘ দেহ, ঋজু।
পুরু গোঁফ। চোখে কালো ফ্রেমের মোটা কাচের চশমা। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। ঠোঁটে প্রশ্রয়ের স্মিত হাসি। এ এক উচ্ছল তরুণের প্রফাইল।
হাস্যোজ্জ্বল সেই তরুণকে আজ আর কোথাও দেখি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণচঞ্চল ক্যাম্পাসে তিনি নেই। ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের অফিসে শোনা যায় না তাঁর কণ্ঠ। প্রাণময় সেই মানুষটির উপস্থিতি আর চোখে পড়ে না। কত দিন হয়ে গেল দেখি না তাঁকে।
শেখ কামালের মৃত্যু হয়েছে ৪৮ বছর হলো। আজ বেঁচে থাকলে শেখ কামাল কী হতেন? একজন রাজনীতিবিদ, একজন ব্যবসায়ী, না একজন সেনানায়ক? যেকোনো একটি হওয়ার যোগ্যতা তাঁর ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ আর্মি থেকে ওয়ার টাইম কমিশন পেয়েছিলেন। তিনি গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আবার প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্বও পালন করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ কামাল সেনাবাহিনী ছেড়ে শিক্ষাজীবনে ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি সমাপ্ত করেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্য রকম একটা জোয়ার আনার চেষ্টা করেছিলেন শেখ কামাল, বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতির গুণগত মানের পরিবর্তনের চেষ্টা ছিল তাঁর। সরকারের প্রধান নির্বাহী ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির ছেলে হয়েও দলের উঁচু পদের দিকে তাঁর কোনো মোহ ছিল না। সাধারণ কর্মী হিসেবেই কাজ করতেন তিনি।
তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, বেঁচে থাকলে শেখ কামাল রাজনীতিবিদ হতেন। রাজনীতিতে তাঁর ঝোঁক ছিল। তাঁর সহপাঠী, সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধব অনেকের মতে, শেখ কামাল পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডি এড়িয়ে বেঁচে থাকতে পারলে রাজনীতিকেই তাঁর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিতেন এবং আজ বাংলাদেশের অবক্ষয়গ্রস্ত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একটি নতুন আশার আলো হয়ে ফুটে উঠতে পারতেন।
অবশ্য ক্রীড়াবিদ ও সংগীতশিল্পী হিসেবেও তিনি ক্যারিয়ার গঠন করতে পারতেন। শুধু ক্রীড়াবিদ হিসেবে নয়, ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও তাঁর নাম ছিল। আবাহনী তাঁর নিজের হাতে গড়া সংগঠন। বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতে আবাহনী এখনো একটি উজ্জ্বল নাম। ক্রীড়ার মতো সংগীতেও তাঁর সমান আগ্রহ ছিল। ঢাকার বিখ্যাত সংগীত বিদ্যালয় ছায়ানটে কামাল সেতার বাজানো শিখতেন এবং সেতারের শিল্পী হিসেবে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন।
ব্যক্তিত্ব ও সাহস—দুয়ের সমন্বয় ছিল শেখ কামালের মধ্যে। তাঁর মধ্যে এই সাহস ও ব্যক্তিত্ব দেখেই সাবেক যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ টিটো বঙ্গবন্ধুকে বলে কামালকে নিজের কাছে নিয়ে কিছুকাল রেখেছিলেন। টিটো হয়তো চেয়েছিলেন কামালকে তাঁর মতো একজন যোদ্ধা-রাজনীতিক হিসেবে গড়ে তুলতে। জীবিত থাকলে শেখ কামাল হয়তো তা-ই হতেন। তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবেও রূপ নিতে পারত। টিটোর স্বল্পকালের সান্নিধ্যেই শেখ কামালের রাজনৈতিক বোধের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা দৃঢ় ভিত্তি লাভ করতে চলেছিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ কামাল যদি তাঁর নিজস্ব ভূমিকা রাখার সুযোগ পেতেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা আরো বেশি সহজ ও দ্রুততর হতো।
দেশে বর্তমানে রাজনীতি অস্থির। রাজনৈতিক অপশক্তি আস্ফাালন করছে। সন্ত্রাসের হুংকার দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শেখ কামালের মতো সাহস-দীপ্ত তারুণ্যের আজ প্রয়োজন ছিল।
আজকের দিনে যখন নতুন করে মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে সাম্প্রদায়িক শক্তি, যখন স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করেই চলেছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল, তখন শেখ কামালের মতো একজন দক্ষ সংগঠকের অভাব বোধ করি। আজ তাঁর মতো নেতৃত্ব বড় প্রয়োজন এই দেশে। তাঁর আদর্শ অনুসরণের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক একটি দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। রাজনীতি যখন কারো কারো কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি, তখন শেখ কামালের দেখানো পথ ধরে রাজনীতিকে সত্যিকারের মানবকল্যাণে ব্যবহার করা সম্ভব। সব সম্ভবের দেশেও কেমন করে নির্মোহ থাকা যায়, শেখ কামাল তারই অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। সরকার ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির সন্তান হওয়া সত্ত্বেও কেমন করে সাধারণ্যে মিশে যাওয়া যায়, শেখ কামাল তার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন।
আজ তাঁর জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃত করে শ্রদ্ধা নিবেদন করি তাঁকে, ‘তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর পূর্ণ করো,/...এই প্রভাতে দখিন হাতে বিজয়খড়্গ ধরো।’
লেখক : সর্বইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ