1558
Published on মে 31, 2023এম. নজরুল ইসলামঃ
অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ভিসানীতি ঘোষণা করার পর বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের পাশাপাশি নাগরিক সমাজেও বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়া ব্যক্তিদের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টিকে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছে সব পক্ষ। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সংশ্লিষ্ট সবাই যুক্তরাষ্ট্রের ওই হুঁশিয়ারি বার্তা আমলে নিয়েছে। এসব দলের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠকও করেছেন।
এক প্রেস ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে বার্তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বাংলাদেশের বন্ধু মনে করে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু ঢাকার একটি বেসরকারি টেলিভশন চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার দেশ নতুন এই নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তার সরকার, বাংলাদেশি নাগরিক সমাজ ও বাংলাদেশের জনগণের যে চেষ্টা-তাকে বেগবান করতে চায়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ডোনাল্ড লু উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, সামনের নির্বাচনে যদি যুক্তরাষ্ট্র দেখে যে বিরোধী দলের কেউ সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে বা ভোটারদের ভয় দেখিয়েছে, তাহলে সেই ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবে না। একইভাবে যদি সরকারের বা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কেউ ভোটারদের ভয় দেখায় অথবা সহিংসতায় জড়ায় অথবা বাকস্বাধীনতাকে অগ্রাহ্য করে, তবে সেই ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
অর্থাৎ বিষয়টি খুব পরিষ্কার। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার ব্রিফিংয়ের খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন হঠাৎ করে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার বিষয়টি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মাথা ঘামাতে হলো কেন?
চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে নয়াপল্টনের সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নেয়া না হলে নির্বাচন রুখে দেয়া হবে?’ কিভাবে? আবারও কি আগুন সন্ত্রাস? নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি রুখে দিতে কোনো অনিয়মের পথে যাবে দলটি?
বিস্তারিত আলোচনা করতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। সেদিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখব, বাংলাদেশে সবসময় নির্বাচন বিতর্কিত ও বাধাগ্রস্ত করেছে বিএনপি। নির্বাচনে ভোট কারচুপি থেকে শুরু করে সব অনিয়মের জন্মদাতা বিএনপি। বিবিসি ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মুখে যে কয়েকটি একতরফা এবং বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।’ ১৯৯৬ সালের ওই নির্বাচন নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের পাঁচ কোটি ভোটারের মধ্যে বেশির ভাগই ভোট দেননি।’ নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ১০ শতাংশের কম হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয় নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনে। এর আগে আরো একটি নির্বাচন আছে। সেটি হচ্ছে, ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ, মাগুরা উপনির্বাচন। কারচুপি এবং জালিয়াতির নিকৃষ্ট উদাহরণ ছিল এই উপনির্বাচন।
নির্বাচন নিয়ে আমরা আরো একটু পেছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সব রকমভাবে দূষিত করেছেন যে ব্যক্তি, তার নাম জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাজনীতিতে বৈধতা দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাজনৈতিক বিরোধিতাকারী ব্যক্তি, যারা পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুগত ছিলেন, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তাদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়।
আর, বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয় ১৯৭৭ সালের ৩০ মে। সেদিন অদ্ভুত এক নির্বাচন প্রত্যক্ষ করে বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির প্রতি আস্থা ভোট বা গণভোট নামে একটি ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এই ভোটে ভোটারদের কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি কি রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের (বীর উত্তম) প্রতি এবং তার দ্বারা গৃহীত নীতি ও কার্যক্রমের প্রতি আস্থাশীল? ভোটের ফল দেখানো হয় ৯৮.৯ শতাংশ- হ্যাঁ। মোট ভোট দেখানো হয় ৮৮.১ শতাংশ। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এই ভোটকে বলা হয়ে থাকে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট। এই ‘হ্যাঁ-না’ ভোট নিয়ে আমার এক বন্ধুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা এখানে তুলে ধরি। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও সাংবাদিক। তিনি তার ১৩ জন বন্ধুকে নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যান ভোট দিতে। গিয়ে দেখেন ভোট দেয়া হয়ে গেছে। তারা ভোটকেন্দ্রে হৈচৈ শুরু করে দেন। তখন তাদের প্রত্যেককে একটি করে ব্যালট পেপার দেয়া হয়। তারা ধরে নিলেন ওই কেন্দ্রে অন্তত ১৩টি না ভোট তো নিশ্চিত। সন্ধ্যায় তারা জানতে পারলেন, ওই কেন্দ্রে মোট না ভোট পড়েছে মাত্র তিনটি। এই হচ্ছে জিয়াউর রহমানের ‘হ্যাঁ-না’ ভোট; যে ভোট বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।
আরো একটু পেছনে তাকাই। বন্দুকের নলের মুখে রাষ্ট্রপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল। জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেই এক সামরিক ফরমান জারি করে তিনি নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক তো ঘোষণা করেছিলেন। আবার নিজেই আরেক ফরমান জারি করে ঘোষণা দেন তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি। তাকে ভোট দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। তার ইচ্ছে হয়েছে, তিনি চেয়ার দখল করেছেন। এক সময় তার মনে হয়েছে, বিষয়টা হালাল করা দরকার। তিনি ‘হ্যাঁ-না’ ভোট দেন। নিজেকে দেয়া নিজের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ বৈধ করার জন্যই এই গণভোট বা আস্থা ভোটের আয়োজন। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও সুষ্ঠু ভোটে দুষ্ট ক্ষত ১৯৭৭ সালের ৩০ মে তারিখের গণভোট বা ‘হ্যাঁ-না’ ভোট। এই ভোটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে বৈধ প্রমাণের চেষ্টা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। কী আশ্চর্য একদল বিদ্রোহী সেনা সদস্যের হাতে তার নিহত হওয়ার দিনটিও ৩০ মে।
লেখক : সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি