2189
Published on এপ্রিল 7, 2023বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব যেমন দিয়েছে আওয়ামী লীগ, তেমনি স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে মানবিক সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সার্বিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে দলটি। বাঙালি জাতির প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত, মর্যাদাময় জীবন, নিরাপত্তা এবং অগ্রযাত্রা নিশ্চিতের জন্য সবসময় গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে অব্যাহত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার।
বাংলাদেশের জন্ম, স্বৈরাচার ও উগ্রবাদীদের শোষণ থেকে গণমানুষকে রক্ষা এবং উন্নয়নকামী রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হওয়ার পেছনে গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। একারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দিক নির্দেশক হিসেবে অভিহিত করা হয় মুক্তিসংগ্রাম এবং অগ্রযাত্রায় নেতৃত্বদানকারী এই দলকে।
স্বাধীনতার আগে, ১৯৫৮ সালের পর থেকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের ভয়ে যখন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দল রাজনীতি বন্ধ করে রেখেছিল, তখনও দলীয় সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম চালিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত রাখার জন্য স্বৈরাচার এবং উগ্রবাদীদের সাঁজোয়া ট্যাংক-বুলেট-বোমার মুখে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে জীবন বাজি রেখে কাজ করার কারণে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে এই দলটি। একারণে বারবার স্বৈরশাসক এবং উগ্রবাদীদের হামলার শিকার হয়েছে এই দলের নেতাকর্মীদের।
রক্তস্নাত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা
স্বাধীন বাংলাদেশ পুনগর্ঠনের মাঝপথে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে দেশে স্বৈরশাসন চালু করে ঘাতকরা। এরপর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করতে থাকে তারা। দেশের আপামর মানুষকে স্বৈরাচারের দুর্বিষহ থাবা থেকে রক্ষা করতে অবশেষে জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমে আসেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণমানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিশ্রুতি এবং সাহস দেন তিনি।
ফলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রেখে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেমে আসে সর্বোস্তরের জনগণ। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং ১৯৯১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে পায় বাংলাদেশ।
কিন্তু স্বৈরাচারের পতন হলেও, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের আগ্রহ ছিল না খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের। ওই নির্বাচনে দলের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র এবং সুক্ষ কারচুপির কারণে প্রায় ৫০টি আসনে সামান্য ভোটে হেরে যায় আওয়ামী লীগ, এরপর যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের সঙ্গে জোট করে সরকার গঠন করে বিএনপি, ফলে বিরোধী দলের আসনে বসতে হয় আওয়ামী লীগকে।
কিন্তু বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবেই গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য বিএনপি সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখেন শেখ হাসিনা। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার চাপের মুখে প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক মন্ত্রী-পরিষদ ব্যবস্থা প্রচলনে বাধ্য হন খালেদা জিয়া। ফলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হারলেও বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয় সেই আওয়ামী লীগই। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অব্যাহত আছে, তার মূলত আওয়ামী লীগেরই অবদান।
কিন্তু এজন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে অনেক। এমনকি ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের পৈতৃক বাড়িতে পর্যন্ত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে উঠতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ যাতে সক্রিয় হতে না পারে, সেজন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে বাস্তুহীন করে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার হীন অপচেষ্টা হয়েছে।
স্বৈরাচারবিরোধী তৎপরতার কারণে শেখ হাসিনাকে ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাকে আটক করে ১৫ দিন অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাকে দুবার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২রা মার্চ তাকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ১১ নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দি হন। ১৯৯০ সালে ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দমনে স্বৈরশাসকদের পেটোয়া বাহিনী হয়ে কাজ করে বঙ্গবন্ধুর খুনি রশিদ-ফারুক কর্তৃক গঠিত ফ্রিডম পার্টির ক্যাডাররা। এমনকি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাসায় শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য প্রকাশ্যে স্লোগান দিতে দিতে বোমা হামলা পর্যন্ত চালিয়েছিল তারা। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী ও দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়।
এমনকি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় মদতে একাধিকবার হত্যাচেষ্টা পর্যন্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এসময় কয়েকজন নেতাকর্মী নিহত হন। এমনকি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শেখ হাসিনাকেসহ তার গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে সরকারের পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এসময় ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শহীদ হন। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাকে লক্ষ্য করে দুবার গুলি বর্ষণ করা হয়। জনসভা শেষে ফেরার পথে আবারও তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। প্রায় এক দশক নিরলস সংগ্রাম এবং অজস্র আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী প্রাণের বিনিময় অবশেষে স্বৈরাচারের পতন ঘটে ও গণতন্ত্র ফিরে আসে বাংলাদেশে।
কিন্তু ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী লীগের বিজয় ঠেকাতে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয় বিএনপি সরকারের মদতে। গণমানুষের অধিকারের জন্য বিরোধীদলের গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর বন্ধ করে দেওয়ার জন্য এই নাশকতা চালায় খালেদা জিয়ার সরকার। ফলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পরপরই গণতন্ত্র হত্যার এই অপচেষ্টায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সারা দেশ।
১৯৯৪ সালে ঢাকার মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে চ্যালেঞ্জ করে হামলা
যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে গঠিত বিএনপি সরকারের অধীনে ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। টানা তিন বছর ধরে বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ মানুষের ঢল নামে আওয়ামী লীগের পক্ষে। ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের বিশাল জনসমাবেশে মোহাম্মদ হানিফকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তার জন্য ভোট চান দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। এরপরেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যালট বিপ্লব ঘটায় নাগরিক সমাজ। কিন্তু জনগণের ম্যান্ডেটকে মেনে নিতে পারে না বিএনপি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা ভোটারদের ওপর হামলা পরিচালনার মাধ্যমে গণমানুষের গণতন্ত্রের ওপর হিংস্র থাবা বসায়।
৩০ জানুয়ারি নির্বাচনে জেতার পর, ৩১ জানুয়ারি লালবাগের নবাবগঞ্জে আওয়ামী লীগের বিজয় মিছিলে বিএনপির পরাজিত প্রার্থীর হামলায় নিহত হন ৭ জন এবং আহত হন শতাধিক। এদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসা নিয়ে প্রাণে বাঁচলেও পঙ্গুত্ব বরণ করেন ২৩ জন। তৎকালীন অখণ্ড ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কমিশনার আওয়ামী লীগ প্রার্থী হুমায়ুন কবিরের বিজয় সমাবেশে বিএনপির পরাজিত মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস এবং বিএনপি নেতা আবদুল আজিজের ক্যাডাররা এই হামলা চালায়। হামলার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলের সিনিয়র বিএনপি নেতা এবং খালেদা জিয়া সরকারের খাদ্যমন্ত্রী লে. জে. (অব.) মীর শওকত আলী এবং বিএনপি নেতা শাহীন। পুরান ঢাকার শহীদ পার্কে এই হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর চকবাজারেও হামলা চালায় বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। দোকানপাট ভাঙচুর এবং সাধারণ মানুষের বাড়ির জানালা দিয়ে এসিড ছুড়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তারা।
মাগুরার উপনির্বাচনের আবারো গণতন্ত্র হত্যা
ঢাকার মেয়র নির্বাচনে পরাজয়ের পর, ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরার উপনির্বাচনেও পরাজয়ের মুখোমুখি হয় বিএনপি। ভোট গ্রহণের শুরু থেকে কারচুপি করলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে জনতার গণভোট পড়ায় স্তম্ভিত হয়ে যায় খালেদা জিয়ার সরকার। ফলে ভোট গণনার একপর্যায়ে নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে রাষ্ট্রীয় মদতে ব্যালট-বাক্র ছিনতাই করে তারা। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নিশ্চিত বিজয়ের ফলাফলকে পাল্টে দিয়ে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ইকোনো বলপেন কোম্পানির মালিক কাজী সলিমুল হককে কারচুপির মাধ্যমে জিতিয়ে আনেন স্বয়ং খালেদা জিয়া। এভাবেই গণতন্ত্রকে প্রকাশ্যে টুঁটি চেপে হত্যা করে বিএনপি-জাাময়াত জোট।
পরবর্তীতে তারেক রহমানের সঙ্গে জোট বেঁধে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজি করতেন এই বিএনপি নেতা। এমনকি পরবর্তীতে ২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপি-জামায়াতের শাসনামরে, বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকের ছেলেকে একটি মামলা থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য একশ কোটি টাকা নিয়েছিল খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপির অন্যতম শীর্ষ নেতা তারেক রহমান, সেটাও এই সলিমুল হকের মাধ্যমে।
এমনকি বিএনপি-জামায়াত সরকারের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী জনসভা করার সময় বারবার হামলা চালানো হয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর। এমনকি ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে শেখ হাসিনার কামরা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি ছোড়া হয় বিএনপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। তবুও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে কখনও পিছপা হননি শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে গেছেন তিনি।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে বিএনপি কর্তৃক ক্ষমতা দখল এবং খুনিদের নিয়ে সংসদ গঠন
দীর্ঘ পাঁচ বছর জনগণের ওপর নির্যাতন ও শোষণ চালানোর পর গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাহস হারিয়ে ফেলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তাই দলীয় ক্যাডারদের মাধ্যমে একটি একতরফা সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অগণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন তিনি। এমনকি সেই সাজানো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দল অংশ না নেওয়ায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের খুনি রশীদকে কুমিল্লা থেকে এমপি বানিয়ে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসান। কিন্তু আপামর বাঙালি জাতির তীব্র জনরোষের মুখে সেই একতরফা সাজানো নির্বাচন বাতিল হয় এবং গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা দখলকারী খালেদা জিয়া ও অবৈধ বিএনপি সরকারকে পদচ্যুত হয়।
এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল ভোটে জিতে সরকার গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এরপর সুষ্ঠুভাবে পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের একমাত্র সরকার হিসেবে একটি অবাধ নির্বাচনের উদ্দেশ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করে শেখ হাসিনার সরকার। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য এতো সুন্দরভাবে সরকারের মেয়াদ শেষ করে ক্ষমতা হস্তান্তরের নজির আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কারো নেই।
২০০৬ সালে ভুয়া ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে আবারো অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে বিএনপি-জামায়াত
২০০১ সালে ইতিহাসের ভয়াবহতম সহিংস নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত সরকারে থাকার সময় দেশজুড়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ, সাংবাদিক-বৃদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতি কর্মী হত্যা, নারী ও শিশু ধর্ষণ, চাঁদাবাজি-দুর্নীতি-অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে তারা। এমনকি তাদের এই পাঁচ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচবারই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। ফলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বাহিনীর প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ সৃষ্টি হয় জনমনে।
একারণে আবারো গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভীত হয়ে পড়ে বিএনপি-জামায়াত নেতারা। ফলে রাষ্ট্রীয় অপপ্রয়াসের মাধ্যমে তারা ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার তৈরি করে এবং প্রতিটি উপজেলায় নিজ দলের ক্যাডারদের নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়। কোনো পরীক্ষা ছাড়া সরাসরি তালিকার মাধ্যমে এই নিয়োগ দিয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং সরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রক্রিয়াকে কলঙ্কিত করে খালেদা জিয়ার সরকার। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে ৩০০ ছাত্রদল ক্যাডারকে নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ায় তোলপাড় শুরু হয় দেশে।
গণতান্ত্রিক নিয়মে ক্ষমতা না ছাড়ায় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়কের হাতে ক্ষমতা চলে যায় ২০০৭ সালে
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পাঁচ বছর সরকারের মেয়াদ শেষ করে আবারো কৌশলে অগণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করে বিএনপি। ফলে সামরিক বাহিনীর সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন দেশ পরিচালনার সুযোগ নেয়। খালেদা জিয়া যদি সঠিকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে, অবাধ নির্বাচন দিতেন তাহলে তত্ত্বাবধায়কের নামে অগণতান্ত্রিক শক্তির অধীনে দুই বছর থাকতে হতো না বাংলাদেশকে। বিএনপি-জামায়াত জোটের স্বৈরতান্ত্রিকতা ও উগ্রবাদীতার কারণেই দেশ থেকে গণতন্ত্র লুট হয়ে গিয়েছিল ২০০৭ ও ২০০৮ সালের জন্য।
খালেদা জিয়া ও বিএনপির স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বললেও, তারা টানা দুই বছর ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকে। এসময় তারা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জেলে নেয়। বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কারণে বিচারের মুখোমুখি হয়। একইসঙ্গে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদেরও গণগ্রেফতার করে। এসময় এই অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যোগ দিয়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য 'মাইনাস টু' ফর্মূলা ঘোষণা করে বাংলাদেশের প্রথম সারির গণমধ্যম প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। এই উত্তাল পরিবেশের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. ইউনুসকে শান্তিতে নোবেল দেয় পশ্চিমারা এরপর তাকে দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা করা হয়।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ড. ইউনুস 'মাইনাস টু' ফর্মূলার প্রণেতাদের সাহায্যে রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করে। কিন্তু দেশের জনগণ এই অগণতান্ত্রিক অপশক্তির সুযোগসন্ধানি ভূমিকাকে প্রত্যাখান করে। এসময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান। এরপর তাকে দেশে ফিরতে দিতে বাধা দেয় অগণতান্ত্রিক সেই অপশক্তি। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবি তোলেন তিনি। এসময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশের গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আটক নিজের পুত্র তারেক রহমানের নিরাপদে দেশত্যাগের বিষয়ে দেনদরবারে ব্যস্ত সময় কাটান।
কিন্তু দ্রুত অগণতান্ত্রিক সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনের দিন ঘোষণার দাবিতে দেশব্যাপী জনসাধারণকে একাট্টা করে তোলেন শেখ হাসিনা। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ নিবেদনের কারণে এসময় ৩৩১ দিন জেলে থাকতে হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে। এমনকি গণতন্ত্র এবং মেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হওয়ায় সারা দেশ থেকে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে জেল-জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়। অবশেষে আওয়ামী লীগের গণদাবির মুখে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
আওয়ামী লীগের কারণে ২০০৮ সালে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা এবং স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়
ভুয়া ভোটার তালিকা দিয়ে ২০০৭ সালে একটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের অপপ্রয়াস চালায় বিএনপি-জামায়াত উগ্রবাদী চক্র। কিন্তু জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনার অনড় অবস্থানের কারণে তা ব্যর্থ হয়। এরপর তত্ত্ববধায়ক সরকারের কাছে ভুয়া ভোটার তালিকা বাতিল করে ছবিযুক্ত নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ণ ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ছবিযুক্ত নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এরপর স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরদারিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিচালনা করা হয়। এই অবাধ সুষ্ঠু স্বচ্ছ নির্বাচনের পেছনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো কারণ নয়, বরং সেনাবাহিনীর ওপর আন্তর্জাতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর নজরদারির কারণে সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয়। ভোটে দুই-তৃতীয়াংশ ব্যবধানে ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আবারো সরকার গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আজ আমাদের সবার কাছে যে একটি করে ছবিযুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, সেটি এই ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকার ধারাবাহিকতাতেই আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে এসেছে।
অবাক করার মতো বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ যখন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সংগ্রাম করছিল। তখন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার দুর্নীতিগ্রস্ত, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কারণে অভিযুক্ত পুত্র তারেক রহমানকে নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য ব্যস্ত সময় কাটান। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে আটক তারেক রহমানের বিচার স্থগিত করে বিদেশ না পাঠালে নির্বাচনে অংশ নেবেন না বলেও জেদ ধরেন এই বিএনপি নেত্রী। দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার চাইতে নিজ পরিবারের দুর্নীতি ও সন্ত্রাস ঢাকতেই অধিক গুরুত্ব দেয় বিএনপি নেতানেত্রীরা। কিন্তু এরপরেও শুধু আওয়ামী লীগের অনঢ় অবস্থানের অবশেষে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
২০১৩-১৪ সালে দেশজুড়ে ভয়াবহ নাশকতার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করে বিএনপি-জামায়াত
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দেশের অভ্যন্তরে ট্রাইবুনাল গঠন করা হয় ২০১৩ সালে। এর পরেই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে বিএনপি-জামায়াত। ২০১৩ সালে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক সহিংসতার ৪১৯টি প্রধান ঘটনায় ৪৯২ জন মানুষ প্রাণ হারান এবং ২২০০ জন আহত হন।
এদিকে টানা পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নমুখী রাজনীতির কারণে গণমানুষ সরকারকে পুননির্বাচিত করবে বলে পূর্বাভাস দেয় আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থাগুলো। এছাড়াও মাঠ পর্যায়ে বিএনপির সন্ত্রাসের কারণেও মানুষ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সাল থেকেই দেশজুড়ে নাশকতার মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে ভোটের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বিএনপি-জামায়াত জোট। দেশজুড়ে অগ্নিসন্ত্রাস চালাতে এবার তাদের সঙ্গী হয় উগ্রবাদী ধর্মব্যবসায়ীদের সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। এমনকি নির্বাচন বানচালে ব্যর্থ হয়ে লন্ডনে পলাতক বিএনপি নেতা তারেক রহমানের নির্দেশে ভোট বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। যদিও ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত দেশব্যাপী ৫০০০ এর বেশি স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, কোথাও কোনো আপত্তিকর অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তারপরেও শুধু পরাজয় বুঝতে পেরে ভোট বাতিলের জন্য নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি-জামায়াত।
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতায় ২০ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন ২০১৪ সালজুড়ে। সহিংসতার সময় রাস্তার পাশে থাকা হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এছাড়া, ছোট দোকান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও আগুন দেয়। বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জা ভাঙচুর এবং পবিত্র কুরআনের শত শত কপি জ্বালিয়ে দেয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন, একজন প্রিসাইডিং অফিসারসহ মোট ২৬ জনকে হত্যা করে এবং সারাদেশে ৫৮২টি স্কুলে ভোটকেন্দ্রে আগুন লাগায় বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা।
বিএনপি ভোট বয়কট করলেও দেশের সাধারণ মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান করায়, জনসাধারণের ওপর ক্ষুব্ধ হয় বিএনপি-জামায়াত নেতারা। এরপর গণমানুষের চলাচলের জন্য গণপরিবহনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে গণহত্যা শুরু করে তারা। এমনকি ঘুমন্ত মানুষের বাড়িতে আগুন দিতেও দ্বিধা করেনি এই সন্ত্রাসীরা।
২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তির দিন আবারও জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে বিএনপি-জামায়াত জোট। এসময় চলন্ত বাসে ও মানুষের বাড়িতে পেট্রোল বোমা ছুড়ে ২৩১ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে তারা। অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হন আরো ১ হাজার ১শ’ ৮০ জন কর্মজীবী মানুষ। সেসময় ২,৯০৩টি গাড়ি, ১৮টি রেলগাড়ি এবং ৮টি যাত্রীবাহী জাহাজে আগুন দেয় বিএনপি-জামায়াত। এই সন্ত্রাসীদের ভাঙচুর এবং আগুনে পুড়ে ৬টি ভূমি অফিসসহ ৭০টি সরকারি কার্যালয়ের অবকাঠামো এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রাক-নির্বাচনি পরিস্থিতি: জরিপে আওয়ামী লীগের এগিয়ে থাকা এবং বিএনপি নেতাদের নাশকতার পরিকল্পনা
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত আবারো রাজনীতির ছদ্মবেশে নাশকতার ছক করে। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার এবার সতর্ক ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়। ফলে জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত বিএনপি নেতা তারেক রহমান লন্ডন থেকে বারবার নির্দেশ দিলেও, মাঠে নাশকতা করতে ব্যর্থ হয় বিএনপির সন্ত্রাসীরা। জনসাধারণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে সমর্থ হয় আওয়ামী লীগ সরকার।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রাক-নির্বাচনি মতামত যাচাইয়ের জন্য জরিপ পরিচালনা করা হয়। রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আরডিসি)-এর সেই জরিপের ফলাফলে আওয়ামী লীগের বড় বিজয়ের সম্ভাবনা উঠে আসে। আরডিসির হয়ে এই জরিপ পরিচালনায় যুক্ত মার্কিন পরামর্শক ফরেস্ট ই কুকসান ২৬ ডিসেম্বর জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন। ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৪৮টি আসনে জয়ী হতে পারে এবং বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৪৯টি আসনে জয় পেতে পারে বলে পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
এদিকে আরডিসি-এর আরেকটি জরিপের প্রসঙ্গ তুলে ধরে, ১৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুকে লেখেন- আরডিসি-এর জরিপে ৬৬ শতাংশ উত্তরদাতা এবার আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা রাখার কথা বলেছেন।
ফলে প্রাক-নির্বাচনি জনমত দেখার পর ঘাবড়ে যায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। তারা নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে নাশকতার পরিকল্পনা করে। ভোটকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের নির্দেশ দেয় নেতাকর্মীদের।
২৫ ডিসেম্বর সময় টিভির প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরিশালের উজিরপুরে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপির প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু। সান্টু বলেন, 'আমি বানারীপাড়া আসবো, আমার সামনে যেটা পড়বে- আমি গুলি করে দেবো, মাঠ ক্লিয়ার করো।'
রাজশাহী-৫ আসনের প্রার্থী ও বিএনপি নেতা নাদিম মোস্তফা এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মারার নির্দেশ দেয় কর্মীদের। ফোনালাপে শোনা যায়, নাদিম মোস্তফা বলছেন, 'সুযোগ পাইলে বসায় দাও, মাইরে ফালাও দাও.....।'
বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং নোয়াখালী-১ আসনের প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহাবুব উদ্দীন খোকন ভাড়াটিয়া বাহিনী নিয়ে ভোটের আগে কেন্দ্র দখলের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন তার ঘনিষ্ঠ এক নেতাকে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মেরে মাঠ ফাঁকা করার নির্দেশ দিয়ে তিনি নিজের লোকদের বলেন, 'কাল রওনা দেবে তো? বাঁশ-টাশ কেটে নিতে বলো, সব রেডি করতে বলো।'
২৭ ডিসেম্বর এটিএন নিউজের সংবাদ থেকে জানা যায়, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দীন আহমেদ শিবিরের ছেলেদের নির্বাচনি এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশনা দেন। জামায়াত নেতাদের হাফিজ বলেন, শিবিরের ছেলেদের এজেন্ট দেবো। আমাদেরগুলা তো একটু ভীতু। শিবির যতো এজেন্ট দেবে, আমরা নিয়ে নেবো। ভোটের দিন কাজে লাগবে। সেই ব্যবস্থা করো।'
এরপর আরেকটি ফোনালাপে বাবুল বিশ্বাস নামের একজনকে ভোটের আগের দিন অস্ত্রপাতি নিয়ে নাশকতা ওবং সন্ত্রাস সৃষ্টির নির্দেশ দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দীন আহমেদ।
২৮ ডিসেম্বর চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ধানের শীষের প্রার্থী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং কুমিল্লা তিতাস জামায়াতের আমির শামীম সরকারের একটি ষড়যন্ত্রমূলক আলোচনা প্রকাশ হয়।
এরআগে আইএসআই এজেন্ট মেহমুদের সাথে আরো একটি ফোনালাপ ফাঁস হয় খন্দকার মোশাররফের। ইসলামাবাদের একটি হোটেলে মেহমুদের সাথে পূর্বের সাক্ষাতের কথা মনে করিয়ে দিয়ে মোশাররফ বলেন, 'আমরা নির্বাচন নিয়ে একটু সমস্যায় আছি, দেখতে হবে....।'
লক্ষীপুর-৩ আসনে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র-রামদা নিয়ে প্রস্তুত থাকা এবং ভোটের আগেই আওয়ামী লীগে লোকদের ওপর সন্ত্রাস চালানোর নির্দেশ দেন বিএনপির প্রার্থী আবুল খায়ের ভুইয়া। তিনি বলেন, 'নিজেরা প্রিপারেশন নাও। কাল থেকে মারা শুরু করো।'
যেসব কারণে নির্বাচনে বিএনপির ব্যাপক ভরাডুবি
- এই কারণগুলোকেই প্রধান কারণ হিসেবে মনে করেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দলের সিনিয়র নেতারা যার যার নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ফলে সঠিক সময়ে সঠিক নির্দেশনা পায়নি দলের প্রার্থীরা। কেন্দ্রের নির্দেশনা না পেয়ে নির্বাচনের কয়েকদিন আগে অনেক প্রার্থী হাল ছেড়ে দেন।
প্রার্থী ও সিনিয়র নেতারা বারবার নেতাকর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের মাঠে নামার নির্দেশ দিলেও তারাই মাঠে নামেনি।
প্রার্থী ও সিনিয়র নেতাদের মাঠে না পেয়ে সাধারণ ভোটাররা ক্ষুব্ধ হন। তাই অনেকে ভোট কেন্দ্রে যাননি। যার প্রভাব পড়ে ফলাফলে।
ফলে নির্বাচনী মাঠে অনেকটা নেতাকর্মীশূন্য হয়ে পড়ে দলটির প্রার্থীরা। পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে মাঠে নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতিকেই দায়ী করছেন অনেকে। যেখানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভোটের মাঠে অলিগলি চষে বেড়িয়েছেন সেখানে বিএনপির নেতাকর্মীদের বেশির ভাগই এলাকায় সক্রিয় দেখা যায়নি। অনেক আসনের প্রার্থীকেই মাঠে দেখা যায়নি।
বিশেষ করে রাজধানীর আসনগুলোতে বিএনপির প্রার্থীদের তৎপরতা দেখা যায়নি। দু-চারজন ছাড়া কোনো প্রার্থীই সেভাবে গণসংযোগ করেননি। ফলে ধানের শীষের প্রার্থীদের সঙ্গে ভোটারদের একটা দূরত্ব থেকে যায়, যা নির্বাচনে প্রভাব ফেলে।
পোলিং এজেন্ট দিতে না পারাও নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের একটি কারণ । ২০১৮ এর নির্বাচনে বেশির ভাগ কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দিতে পারেনি দলটি। যাদের দেয়া হয়েছিল তারাও কেন্দ্রে যাননি।
বিজয়ের মাসে তাদের হাতে ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেয়াকে নতুন ভোটারদের বড় একটি অংশ ভালোভাবে নেয়নি। সুশীল সমাজসহ সচেতন নাগরকিও বিএনপির এই কৌশলকে গ্রহণ করেননি, যা ভোটে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
গণসংযোগেও ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারেনি বিএনপি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের সঙ্গে জনগণের সংযোগ ছিল না। এবারের নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের কোনো প্রকার গণসংযোগ করতে দেখা যায়নি।
যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজে এবং সিনিয়র নেতাদের দিয়ে যেভাবে গণসংযোগ করেছেন এর বিপরীতে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের নেতাদের একসঙ্গে গণসংযোগে তেমনটা দেখা যায়নি। বলতে গেলে নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো প্রচারণা ছিল না তাদের।
এসব কারণ ছাড়াও পরাজয়ের পেছনে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও দায়ী ছিল। নেতাকর্মীরা বলছেন, ভোটের মাঠে অনভিজ্ঞ-অপরিচিত, রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয় অনেককে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। যাতে ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
যোগ্য ও ত্যাগীদের বাদ দিয়ে সুবিধাবাদী, কথিত সংস্কারপন্থী ও অন্য দল থেকে এনে অনেককে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েও কোনো ফল পায়নি ত্যাগীরা।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো -
অধিকাংশ আসনে একাধিক প্রার্থী রেখে ধানের শীষের প্রাথমিক মনোনয়নের প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে বিএনপি।
“নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা প্রত্যেকটি আসনে দুইজন করে প্রার্থীকে প্রাথমিক মনোনয়ন দিচ্ছি। কোনো কারণে একজনের না হলে পরেরজন যাতে সুযোগ পান।"
- মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগিরের এই কথায় একটা বিষয় স্পষ্ট, বিএনপির মনোনয়নে প্রচুর বাণিজ্য হওয়ার ঘটনা ছিল। একাধিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিলে কর্মীরা কার জন্য কাজ করবে? কিভাবে মাঠে নামবে, তাদের প্রার্থী কে?
৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিন পর্যন্ত আসলে এইসব কারণ বিএনপি কর্মীদেরকে হতাশ করেছে, তারা প্রচার প্রচারণাতেও ছিল না, কোন গণসংযোগেও না।