সাদিকুর রহমান পরাগ:
রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকবে- এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। মানুষ তার পছন্দের দলকে ভোট দিবে- এটিই স্বাভাবিক। মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে- এটিই কাক্সিক্ষত। কিন্তু গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়ে যখন কোনো রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের পরিবর্তে অগণতান্ত্রিক পথকে বেছে নেয়। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে যখন মানুষের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করবে এবং গণতন্ত্রের মূল্যবোধ বিকশিত হবে- এটিই তো স্বাভাবিক। আর এগুলো নিশ্চিত করার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত করা। আর এজন্যই স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই দ্রুততম সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সংবিধান তৈরি, নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠাসহ নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। ১৯৭২ সালে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক আশা-আকাক্সক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সূতিকাগার নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। যে কোনো গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে নির্বাচন কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সংবিধানের সপ্তম ভাগের শিরোনাম হচ্ছে ‘নির্বাচন’ এবং এই ভাগের প্রথম যে অনুচ্ছেদ (১১৮), তা নির্বাচন কমিশন সম্বন্ধীয়। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২-এর আওতায় নির্বাচন কমিশনকে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়, যা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে নেই। ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতার মাত্র দুই বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বাচনব্যবস্থাসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
কিন্তু যদি রাজনৈতিক দলসমূহ গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে কোনো আইন কিংবা প্রতিষ্ঠান তৈরি করাটাই যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের ইতিহাস অন্তত সেই শিক্ষাটা দেয়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কার্যত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মৃত্যু ঘটে। জনগণের সাংবিধানিক অধিকারগুলোকে হরণ করে শুরু হয় স্বেচ্ছাচারিতা আর স্বৈরশাসনের যাত্রা। আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যমার বিভাজন ও পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্টের মধ্য দিয়ে একটি সদ্য-স্বাধীন দেশের সকল সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়।
সামরিক স্বৈরশাসকের ইনকিউবিটরে তৈরি করা হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। যে দলটি তৈরি হয়েছে সামরিক স্বৈরশাসনকে বৈধতা দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে, সেই দলটি গণতন্ত্রের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল হবে সেটি সহজে অনুমেয়।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি। গণতন্ত্রের বাতাবরণে থেকে বরাবরই তারা অগণতান্ত্রিক চর্চা এবং অসাধু পন্থায় যেনতেনভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছে। এটি নিছক কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত সবগুলো নির্বাচনে বিএনপির আচরণ এবং কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলেই এই বক্তব্যের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে বিএনপি তার কর্মকাণ্ড দিয়ে প্রমাণ করেছে যে তারা গণতন্ত্রে বিশ^াস করে না, মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করে না। জনগণের রায়, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ- তাদের কাছে এসব কথার কোনো মূল্য নেই, কোনো গুরুত্ব নেই। জনগণের রায় কিংবা নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপির কখনোই ন্যূনতম আস্থা বা শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। যেনতেনভাবে ক্ষমতা দখল তাদের মূল লক্ষ্য বলে দেশ বা জনগণ বা জনসেবা তাদের কাছে কোনো মানে বহন করে না, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে সম্প্রীতি বিনষ্টে তারা পিছপা হয় না, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস করতে তারা একদমই দ্বিধা করে না, ভোট ডাকাতি করে নির্বাচনী পদ্ধতিকে ধ্বংস করতে তারা মোটেও কুণ্ঠাবোধ করে না, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটাতে তাদের হাত একটুুও কাঁপে না, মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে তাদের বিবেকে বাধে না, নারী নির্যাতন ও গণধর্ষণ করতে তাদের লজ্জা লাগে না, জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়ে দেশে অরাজকতা তৈরি করতে তারা দ্বিধা করে না।
গণতন্ত্রের নামে বিএনপি যে অগণতান্ত্রিক চর্চাগুলো করে থাকে
নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করা, দলীয় নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া, ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিতর্কিত করা, সেনাবিদ্রোহ উসকিয়ে নির্বাচনকে বানচালের চেষ্টা করা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বিরুদ্ধ মতকে দমন করা, কালো টাকার মাধ্যমে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করা, ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা, ভোটদানে বিরত থাকার জন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করা, নারী ভোটারদের ওপর হামলা করা; বিরুদ্ধ মত দলনে উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীকে ব্যবহার করা, সারাদেশে নির্বাচনী ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেওয়া; নির্বাচনী কর্মকর্তাদের হত্যা করা, নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা, মনোনয়ন বাণিজ্য করা।
বিভিন্ন নির্বাচনে বিএনপির ভূমিকা ও আচরণ
আমরা লক্ষ করলে দেখব যে উপরোক্ত অপকর্মগুলো বিএনপি কোনো-না-কোনো নির্বাচনে প্রয়োগ করেছে। বিভিন্ন নির্বাচনে বিএনপির আচরণ ও ঘটনাপ্রবাহ খেয়াল করলেই এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। এবার সংক্ষেপে একটু দেখে নিই বিভিন্ন নির্বাচনে বিএনপির ভূমিকা ও আচরণ কেমন ছিল-
- অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধতা দিতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ৩০ মে নজিরবিহীন এক ‘হ্যাঁ-না’ ভোট আয়োজন করে। এই নির্বাচনে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ২ শতাংশের নিচে থাকলেও দেখানো হয় ৮৮ শতাংশ। আর প্রদত্ত ভোটের ৯৮ শতাংশই দেখানো হয় জিয়ার পক্ষে।
- ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত হয় প্রহসনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশ ১৯৭৮ অনুযায়ী কোনো সরকারি চাকরিজীবী ও সরকারি বেতন গ্রহীতার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও আইন ভঙ্গ করে জিয়া একাধারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের পদে থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হয়।
- ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে এদেশে ভোট ডাকাতির যাত্রা শুরু হয়। ভোট ডাকাতি ও মিডিয়া ক্যু’র মাধ্যমে বিএনপিকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ২২০টি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। পক্ষান্তরে সরকারের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে জিয়ার মন্ত্রীদের মধ্যে কাউকে পরাজিত হতে হয়নি, কারণ জিয়া সেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। এই নির্বাচনে ১০ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বিএনপির প্রার্থী হয়েছিল এবং তাদের সবাইকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যে সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে কবর দেওয়া হয়েছিল, এই নির্বাচনে জিয়া তা কবর থেকে তুলে এনে নতুন জীবন দেয়। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং নেজামে ইসলামের যুদ্ধাপরাধীদের সমন্বয়ে গড়া সম্পূর্ণ নতুন জোট ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগকে ২০টি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করে। মুসলিম লীগ নেতা কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সবুর খানকে ৩টি আসন থেকে জয়ী করে আনে। পরবর্তীতে সবুর খানের ছেড়ে দেওয়া একটি আসনে উপনির্বাচনে বিজয়ী করে আনা হয় বেগম রাজিয়া ফয়েজকে। বেগম রাজিয়া ফয়েজ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং পাকিস্তানের পক্ষে বিশ^জনমত সৃষ্টির জন্য জাতিসংঘে ছুটে গিয়েছিল।
- ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আন্দোলনের কৌশল হিসেবে বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বিএনপি শেষ মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতকতা করে নির্বাচন বয়কট করে। আপসহীনতার খোলসে নির্বাচন বয়কটের নামে জনগণকে বিভ্রান্ত করে বিএনপি জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনকে প্রলম্বিত করেছে এবং গণতন্ত্রের পিঠে ছুরিকাঘাত করেছে।
- ১৯৯১ সালের ২৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জাতিকে অসুস্থ ধর্মীয় বিভাজনের দিকে ঠেলে দেয়। নির্বাচনী প্রচারণায় খালেদা জিয়া পাকিস্তানিদের মতোই ধর্র্ম এবং ভারতকে ইস্যু হিসেবে তুলে আনে। আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করে বিভিন্ন জনসভায় খালেদা জিয়া বলতে থাকে, “একটি দল আল্লাহ্র নামে বাদ দিয়ে ’৭২-এর সংবিধান বহাল রাখতে চায়।… এই দলকে ভোট দিলে দেশে ধর্ম থাকবে না, দেশ বিক্রি হয়ে যাবে…।” এভাবে খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় শুধু ভারত-বিরোধিতা নয়, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পও ছড়িয়েছে। বিএনপি নির্বাচনী সেøাগান তুলল ‘বিসমিল্লাহ কায়েম রাখ, ধানের শীষে সিল মার’, ‘শেখ হাসিনার অপর নাম, হরে কৃষ্ণ হরে রাম’, ‘জয় বাংলা জয় হিন্দ, লঙ্গি খুইল্যা ধূতি পিন্দ’। বিএনপি এ ধরনের স্লোগান দিয়ে সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বিএনপি কলেমা তৈয়বকে প্রায় বিকৃত করে নির্বাচনী স্লোগান তৈরি করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ধানের শীষে বিসমিল্লাহ’। আর বিএনপির দোসর, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী খুনি ফারুক-রশীদের দল ফ্রিডম পার্টির স্লোগান ছিল ‘ভোট দিলে কুড়ালে, খুশি হবে রাসূলে’। আর বিএনপির আরেক দোসর জামায়াতে ইসলামী বলেছিল, ‘জামাতকে ভোট না দিলে, মুসলমান কাফের হয়ে যাবে…।’
- স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির অশুভ নির্বাচনী আঁতাত, বিভ্রান্তিকর উগ্র-ধর্মীয় প্রচারণা এবং নগদ অর্থের ছড়াছড়ি নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারপরও সংসদে প্রয়োজনীয় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সরকার গঠনে বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিতে হয়। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৪ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় দুবাইভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘খালিজ টাইমস’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, ’৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করতে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টিলিজেন্স (আইএসআই) বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ৫ কোটি রুপি দিয়েছিল।
- ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বিরোধী দলের আহ্বানে নির্বাচনের দিন স্বতঃস্ফূর্ত গণকার্ফু পালিত হয়। সর্বস্তরের জনগণ এই নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনে ভোটের হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। যদিও বিদেশি সাংবাদিক পর্যবেক্ষকরা এই হারকে কোনো কোনো কেন্দ্রে ৭ থেকে ৮ শতাংশ বলে মন্তব্য করেছিল। অথচ ভোটারবিহীন এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত ফলাফলে নির্লজ্জভাবে বলা হয়েছে, প্রার্থীরা লাখ লাখ ভোট পেয়েছে।
- ১৫ ফেব্রুয়ারির অবৈধ নির্বাচনের কারণে জনগণের কাছে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নেমে এসেছিল। বিএনপি আঁচ করতে পেরেছিল যে নির্বাচন হলে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসা আর সম্ভব হবে না। যেহেতু বিএনপির রাজনীতি হচ্ছে, যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার চেষ্টা। তাই ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিতব্য সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টায় তাদের কোনো রাখঢাক ছিল না। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে তারা পরিকল্পিতভাবে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সেনাবিদ্রোহ ঘটানোর অপচেষ্টা করে। এই অপতৎপরতা সম্পর্কে জনগণ অত্যন্ত সজাগ ছিল বিধায় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হন এবং বিএনপির সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ ঘটনার পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও বিএনপির মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর তাই পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে লক্ষ করলে দেখা যায়, বিএনপি যে কোনো উপায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তাদের অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং তাদের ব্যবহার করে নির্বাচনে অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছে। এভাবে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকেও বিতর্কিত করেছে।
- ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় নির্বাচনটির সঙ্গে বাংলাদেশে সংঘটিত অতীতের যে কোনো নির্বাচনের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যাপকতা ও তীব্রতায়। এই নির্বাচনে বিএনপি তার খোলস থেকে বেরিয়ে জামাতের সঙ্গে প্রকাশ্য নির্বাচনী ঐক্য গড়ে তোলে। এই নির্বাচন ছিল বিএনপি-জামাতের বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রের ফসল। জনগণের রায়ের ওপর বিএনপির আস্থা ছিল না, তাই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রভাবিত করার অপকৌশল গ্রহণ করে। যেহেতু আগে থেকে জানা ছিল কে হচ্ছেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান, সেহেতু তারা আগেভাগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানকে আস্থায় নিয়ে তার মাধ্যমে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে তড়িঘড়ি করে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের বদলি এবং ওএসডি করে বিএনপির অনুগত একটি নির্বাচনী প্রশাসন তৈরি করে। এভাবে তত্ত্বাধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রক্রিয়া শুরু হয়। নির্বাচনের আগে থেকে একটি পরিকল্পিত সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। এ সময় বিএনপি-জামাতের সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের মদদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে প্রায় ৩ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করে। বারংবার বলা সত্ত্বেও এই সন্ত্রাস প্রতিরোধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। উপরন্তু নির্বাচনের দিন যেন নৌকার ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না যায় সেজন্য একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে সারাদেশে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে বিনাবিচারে গ্রেফতার করা হয়। ভীত হয়ে যাতে ভোটকেন্দ্রে না যায়, সে-লক্ষে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা বিএনপি-জামাতের হামলার মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। নৌকা মার্কার ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্ত করতে নির্বাচন কমিশন থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ভুল ভোটার তালিকা সিডির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এই নির্বাচনে নজিরবিহীন কালো টাকার ছড়াছড়ি দেখা যায়। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া হয়।
- ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামাতের যে সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু হয়, নির্বাচনের পরে এর ব্যাপ্তি, মাত্রা, তীব্রতা ও ধরন বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থক আর সংখ্যালঘুদের ওপর চলে ন্যক্কারজনক বর্বরোচিত হামলা ও নির্যাতন। হত্যা, অগ্নিসংযোগ, বাড়িঘর লুটপাট, সম্পত্তি দখল, চাঁদা দাবি, এমন কী নারী ধর্ষণের অজস্র ঘটনা ঘটে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এ সময়ে দেশের ২৮টি জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। দেশের ৪৩টি জেলায় চলেছে বিএনপি-জামাতের নির্বিচার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এসব সহিংসতায় যেসব ব্যক্তির ওপর হামলা, লুটপাট, গণধর্ষণ করা হয়েছিল, তারা থানায় বা আদালতে অভিযোগ দায়ের পর্যন্ত করতে পারেনি। কেউ অভিযোগ করতে পারলেও রাজনৈতিক কারণে তদন্ত হয়নি। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে এসব হামলা-সন্ত্রাস লুটতরাজসহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়ে ৫ হাজার ৮৯০টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ফলে এসব মামলার ১২ হাজার অপরাধী শাস্তি ছাড়াই বীরদর্পে ঘুরে বেড়াতে থাকে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে গঠিত তদন্ত কমিশন ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে সংঘটিত অপরাধের ৫ হাজার ৫৭১টি অভিযোগ পায়। তদন্তসাপেক্ষে ১ হাজার ৯৪৬টি অভিযোগ বাতিল করা হয়। দায়েরকৃত অভিযোগের মধ্যে ৩৫৫টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, গুরুতর আঘাত, চিরতরে পঙ্গু করা, সম্পত্তি দখল ও অন্যান্য গুরুতর অপরাধের ৩ হাজার ২৭০টি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। তদন্ত করা ৩ হাজার ৬২৫টি ঘটনায় ১৮ হাজারেরও বেশি লোক জড়িত বলে চিহ্নিত হয়।
- ২০০৭ সালের অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতায় থেকে বিএনপি ভোট ডাকাতির ছক সাজাতে শুরু করে দলীয় নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগ, ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি, সংখ্যালঘুদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়াসহ বিভিন্ন অসাধু পন্থা অবলম্বন করে। সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হওয়ার কথা। মানুষের ভোটাধিকার হরণের রাজনৈতিক অসুস্থতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে বিএনপি কোনো রাখঢাক না রেখেই তাদের আস্থাভাজন কিংবা আজ্ঞাবহ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বানানোর জন্য উদ্যোগী হয়। এরই অংশ হিসেবে জাসাসের সাবেক নেতা বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বানাতে ২০০৪ সালে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়। এই অসৎ উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ শুরু থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। প্রবল প্রতিবাদ ও আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করে বিএনপির কূটচালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি বিরোধী দলবিহীন সাধারণ নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। এই প্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে সমর্থন করে সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অনির্বাচিত সরকারের অধীনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবারও মুখ থুবড়ে পড়ে। আর এর জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী বিএনপি-জামাত জোটের ক্ষমতার লালসা। বলা যায়, বিএনপির বেসামাল উন্মত্ত আচরণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামোকে শুধু অকার্যকর করেনি, এর কফিনেও শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে।
- ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচনে আগুন সন্ত্রাস এবং বিএনপির প্রতিশোধের রাজনীতির শিকার হয় দেশের সাধারণ মানুষ। জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং বিদেশে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নির্বাচনব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। জনগণের ওপর প্রতিশোধ নিতে প্রতিহিংসার পথকে বেছে নেয় বিএনপি। বে-আইনিভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে ২০১৩ সালে আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশজুড়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার এক বীভৎস উৎসব শুরু করে বিএনপি ও জামাতের সন্ত্রাসীরা। ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি-জামাত দেশজুড়ে পেট্রোল বোমার মাধ্যমে আগুন সন্ত্রাসের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা করে। এই অগ্নিতাণ্ডব থেকে নারী-পুরুষ-শিশু, চিকিৎসক-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য-পরিবহন শ্রমিক-স্কুলশিক্ষক-দিনমজুর-ছাত্রছাত্রী কেউ রেহাই পায়নি। এসব নারকীয় হামলায় অনেকে নিহত হয়েছে, অনেকে অগ্নিদগ্ধ হয়েছে, অনেকে চিরতরের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। ১৪টি মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক জানান, ‘পেট্রোল বোমায় দগ্ধদের কারও চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, কারও হাত কারও পা কেটে ফেলতে হয়েছে। কারও মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে গেছে।’ এই আগুন সন্ত্রাস কতটা ভয়াবহ ছিল তার জন্য ছোট্ট একটি পরিসংখ্যানের উল্লেখ করাই যথেষ্ট। আগুন সন্ত্রাসের প্রথম তিন মাসে বিএনপি-জামাত সন্ত্রাসীরা প্রতিদিন গড়ে তিনজন সাধারণ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। এই অগ্নিসন্ত্রাস এতটা ভয়াবহ ও নারকীয় ছিল যে ২০১৭ সালে কানাডার ফেডারেল আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছিল।
- তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হওয়া, খালেদা জিয়ার সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যাওয়া, তারেক রহমানের বিদেশে পালিয়ে থাকা, ইত্যাদি কারণে বিএনপির তৃণমূল স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা দেখা দেয়। সেই প্রেক্ষিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ কাক্সিক্ষত ফলাফল বয়ে আনবে না। তাই নির্বাচনে ভরাডুবি নিশ্চিত জেনে তারেক রহমান ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখে। কিন্তু একদিকে দলের নেতৃত্বহীনতা, অন্যদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ভুল সিদ্ধান্ত বিএনপির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। সরাসরি কেউ কিছু না বললেও দলের অভ্যন্তরে জিয়া পরিবারের ভূমিকা নিয়ে শুরু হয় কানাঘুষা ও সমালোচনা। এ অবস্থায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কথা বললে বিএনপির অভ্যন্তরে আরও ক্ষোভের সঞ্চার হবে এবং বিএনপিতে খোদ জিয়া পরিবারের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে- এ বিবেচনা থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসে বিএনপি ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের নাটক সাজায়। কূটচালে সিদ্ধহস্ত জিয়া পরিবার ‘সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না’ কৌশল থেকেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, যাতে নির্বাচনের ব্যর্থতার দায় জিয়া পরিবারের ওপর না আসে এবং দলের নিয়ন্ত্রণ জিয়া পরিবারের হাতে অপ্রশ্নবিদ্ধভাবে সুরক্ষিত থাকে।
শেষ কথাটা জনগণই বলে
সংগত কারণে প্রশ্ন ওঠে যে কেন? কেন একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচন প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি নিয়ে এত অ্যালার্জি? নির্বাচনকে কেন এত ভয়? কেন তাদের এত অস্বস্তি? নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কেন এ ধরনের আচরণ, কেন এই মাইন্ডসেট? এটি কি বিএনপির এক ধরনের রাজনৈতিক অসুস্থতা?
এর উত্তরটি নিহিত রয়েছে দলটির জন্ম-ইতিহাসে। ক্যান্টনমেন্টে সৃষ্ট বিএনপি নামের এ দলটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিষফোঁড়া। জনগণের মধ্য থেকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেনি বলে এ দলটি কখনোই একটি রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারেনি। এটি গড়ে উঠেছে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, চিনপন্থি বাম নেতা, চিহ্নিত রাজাকার, মুসলিম লীগ ও বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দলের দলছুট নেতাদের সমন্বয়ে অবৈধ ক্ষমতার শক্তিতে। এটি তো সবারই জানা যে জিয়াউর রহমানই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে এ দলটি তৈরি করেছিল। ফলে দলটির আদর্শিক জায়গাটি ছিল সবসময় ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। দেশ বা জনগণের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা কখনও ছিল না এবং এখনও নেই। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন, জনগণ, জনমত, জনরায়, আইনের শাসন, ভোটাধিকারÑ এসব শব্দের প্রতি জন্মগতভাবে তাদের এলার্জি আছে। আর এর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন নির্বাচনে তাদের আচরণ ও মানসিকতায়, দেখতে পাই তাদের কর্মকাণ্ডে।
গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে এ-রকম একটি অপশক্তি যখন গণতন্ত্র বিনাশেই সক্রিয় থাকে, তখন সেই গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক বেশি সতর্ক ও তৎপর থাকতে হয়। কেননা এরা গণতন্ত্রের লেবাস পরে মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়িয়ে নিজেদের প্রকৃত স্বরূপটি আড়াল করে রাখে। আর একদল সুশীল তাদের উৎসাহ জুগিয়ে যায় এবং তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার কাজে সহায়তা করে। ফলে এই দলের কথায় অনেকে সহজে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। না-বুঝেই অনেকে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে দেয়। আর এর সুযোগ নিয়ে বিএনপি দেশে এবং দেশের বাইরে নির্বিচারে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ এর থেকে উত্তরণের উপায় কী? কীভাবে এই অপশক্তির কবল থেকে জাতি মুক্ত হবে?
এখানে একটি বিষয় আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সঙ্গে আমাদের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের পার্থক্য রয়েছে। এসব দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দেশের মানুষের ম্যান্ডেটের জন্য কাজ করে, যাতে তারা ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের সেবা করার সুযোগ পায়। আর আমাদের জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে জনসেবার সুযোগ তৈরির জন্য লড়তে হচ্ছে অগণতান্ত্রিক অপশক্তির বিরুদ্ধে। ফলে লড়াইটা একদম সহজ কিংবা সরলরৈখিক নয়; কিন্তু অসাধ্যও নয়।
আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে শক্ত ও সংহত করার জন্য এই অপশক্তির মুখোশ উন্মোচন অত্যন্ত জরুরি। কারণ, বিএনপির কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করে যে বিএনপি কোনো সুস্থধারার রাজনৈতিক দল নয়। আর নির্বাচনকে ঘিরে এই অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে চরম মাত্রায়। আর এর নজির আমরা দেখেছি প্রতিটি নির্বাচনে বিএনপির আচরণে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান প্রমাণ করে যে তারা কতটা স্ববিরোধী রাজনীতি করে। আজকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছে। অথচ ১৯৯৬ সালে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া স্বয়ং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করে বলেছিল, ‘পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা অবান্তর।’
বিএনপির এই রাজনৈতিক অসুস্থতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে, কারণ শেষ কথাটা জনগণই বলে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে, সেদেশের লড়াকু জনগণ শত চক্রান্ত, অপপ্রচার ও মিথ্যাচারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ বিএনপি-জামাতের কর্তৃত্ববাদী ও অপকৌশলের রাজনীতি কখনোই মেনে নিবে না। কারণ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এদেশের জনগণ অতীতেও করেছে। আগামীতেও করবে। বাংলাদেশের ইতিহাস সে-কথাই বলে।
সৌজন্যেঃ উত্তরণ