896
Published on ফেব্রুয়ারি 10, 2023পক্ষঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি) সাভার সদর দপ্তরের আদলে প্রথমবারের মতো রাজশাহী বিভাগে আঞ্চলিক পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠে কাটাখালি পৌরসভার কাপাসিয়ায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন মহোদয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে দান করা ১৫ বিঘা জমির উপর এই পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হবে। যার নাম হবে ‘সিআরপি-রাজশাহী শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান ও জাহানারা জামান সেন্টার’। কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হলে এখান থেকে প্রতি বছর এ অঞ্চলের ১২ হাজার রোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবা নিতে পারবে। একই সঙ্গে এখান থেকে ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি, বিএসসি ইন অকুপেশনাল থেরাপি, বিএসসি ইন স্পীচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি কোর্স করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।
বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত কাপাসিয়ায় ‘সিআরপি-রাজশাহী শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান ও জাহানারা জামান সেন্টার’ স্থাপনের লক্ষ্যে পরিচিত সভায় এসব তথ্য জানানো হয়। সিআরপি প্রতিষ্ঠায় জমি দান করায় অনুষ্ঠানের শুরুতে এলাকাখালী এলাকাবাসীর পক্ষে এবং কাটাখালি পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও কাউন্সিলরবৃন্দ রাসিক মেয়র মহোদয়কে ফুলেল শুভেচ্ছা ও সম্মাননা স্মারক প্রদান করেন। এছাড়া অনুষ্ঠানের শুরুতে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান সহ জাতীয় চার নেতা এবং মরহুমা জাহানারা জামানের স্মৃতি প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
পরিচিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। মেয়র মহোদয় তাঁর বক্তব্যে বলেন, মানুষের কল্যানে আমার পিতা শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান ও মাতা মরহুমা জাহানারা জামানের নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ার ইচ্ছে ছিল। রাজশাহীতে সিআরপি‘র আঞ্চলিক পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে। এখান থেকে রাজশাহী অঞ্চলের হাজার হাজার অসহায় মানুষ সেবা নিতে পারবেন।
রাসিক মেয়র মহোদয় আরো বলেন, এই পুনর্বাসন কেন্দ্র শুধু চিকিৎসা নয়, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রের গুরত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। এছাড়া এই পুনর্বাসন কেন্দ্রকে করে ছিপিয়ে পড়া কাটাখালি ও কাপাসিয়া এলাকা এগিয়ে যাবে।
সভায় সম্মানিত অতিথি ছিলেন সিআরপি‘র প্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়কারী ড. ভেলরী এন টেইলর। তিনি তাঁর বলেন, সিআরপিকে মূল্যবান ৫ একর জমি দানের মহতি উদ্যোগে মাননীয় মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও তাঁর পরিবারকে সিআরপি‘র পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
ড. ভেলরী এন টেইলর আরো বলেন, ‘সিআরপি-রাজশাহী শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান ও জাহানারা জামান সেন্টার’ হবে আঞ্চলিক পুনর্বাসন কেন্দ্র। মেরুরজ্জুতে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এখানে পরিপূর্ণ পুনর্বাসন সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। এখানে কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি ও সংযোজন, অর্থোপেডিক সু টেকনোলজি, হুইলচেয়ার ও অন্যান্য সহায়ক সামগ্রী তৈরি করা হবে। এটি প্রতিষ্ঠার কারণে সাভারে সদর দপ্তরের উপর চাপ কমে যাবে।
টিআরপি’র চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সাইদুর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে শহীদ কামারুজ্জামান ও জাহানারা জামান পরিবারের সদস্য বিশিষ্ট সমাজসেবী শাহীন আকতার রেণী ও আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে সিআরপি বিষয়ক উপস্থাপনা করেন সিআরপি‘র বিএইচপিআই এর প্রিন্সিপাল ডা. মোঃ ওমর আলী সরকার।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন টিআরপি‘র সদস্য মুশতাক আহমেদ, রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি রশিদুল হাসান, আরএমপি‘র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক, স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক এনামুল হক, উপ-পরিচালক শাহানা আখতার জাহান প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন কবিকুঞ্জ সভাপতি প্রফেসর রুহুল আমিন প্রামাণিক, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলীবঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর শামসুদ্দিন আহমেদ খোকন, রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. এসএমএ মান্নান, সাবেক মহানগর কমাণ্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মান্নান, কাটাখালি পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম, কাটাখালি পৌর সভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র আনোয়ার সাদাত নান্নু প্রমুখ।
কবিকুঞ্জ সভাপতি প্রফেসর রুহুল আমিন প্রামাণিক বলেন, মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন জীবনে যত ভালো কাজ করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও সদূরপ্রসারী কাজ হলো ‘সিআরপি-রাজশাহী শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান ও জাহানারা জামান সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করা। এই কাজ তাঁকে পরিপূর্ণতা দান করেছেন।
রামেক অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, সেবার ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন করলেন রাসিক মেয়র। অবহেলিত ও অসহায় মানুষেরা এখান থেকে সেবা পাবেন। অসহায় মানুষের আত্মাবিশ্বাস বাড়াবে, অক্ষমকে সক্ষম হিসেবে গড়ে তুলবে।
টিআরপির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, সাভারের আদলে রাজশাহীতে আঞ্চলিক পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করার উদ্যোগকে স্বাগত জানান। সারা দেশে ১২টি সেন্টারে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। কোন মানুষই চিকিৎসা নিতে এসে ফিরে যায় না। অসহায় গরীব মানুষ বিনা পয়সায় চিকিৎসা নিতে পারে।
রাজশাহী চেম্বার সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, ‘রাজশাহীতে সিআরপি আঞ্চলিক পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় জমিদান ও সার্বিক সহযোগিতা করে এ অঞ্চলের মানুষের চিকিৎসাসেবায় যে অবদান, মেয়র মহোদয় রাখলেন, তা মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমরা সবাই মেয়র মহোদয়কে ধন্যবাদ জানাই। সিআরপিকে আমাদের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হবে।
বিশিষ্ট সমাজসেবী শাহীন আকতার রেণী বলেন, জাতীয় চারনেতার অন্যতম শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের সহধর্মিণী মরহুমা জাহানারা জামান ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন এই রকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। মায়ের সেই ইচ্ছা থেকে এ প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন। মানুষ পারে না এমন কিছুই নাই। সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে হবে। ভালোবাসা থাকতে পারে। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে থাকব।
আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা বলেন, আমরা প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক-এসব শুনতে চাই না। আমরা চাই সুস্থ্য সমাজ। সুস্থ্য সমাজ গড়তে ‘সিআরপি-রাজশাহী শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান ও জাহানারা জামান সেন্টার’ উল্লেখ্যযোগ্য ভুমিক পালন করবে। এখানে রাজশাহী বিভাগ, রংপুর বিভাগ সহ দেশের বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ এসে চিকিৎসা নিবে। পঙ্গু, প্রতিবন্ধি, বিশেষ চাহিদা শিশুরা সমাজের কোন বোঝা নয়। তারাও একটি পরিবারের সদস্য। তাদের সকলকে এক সমাজের মনে করতে হবে। জন্য যারা কাজ করবে আমরা তাদের পাশে থাকব। আদর ভালোবাসা দিয়ে তাদের পাশে থেকে সুস্থ করে তুলতে হবে। আমরা একটা সুস্থ্য সমাজ এবং আরেকটা অসুস্থ্য সমাজ দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছি। কেন? কেন আমরা একটা সমাজ হতে পারছি না? আমরা চাই একটা সুস্থ্য সমাজ। প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক সকলকে আমাদের অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে। তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে।
প্রসঙ্গত, সিআরপি-রাজশাহী শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান ও জাহানারা জামান সেন্টারে যেসব চিকিৎসা সেবাসমূহ পাওয়া যাবে, সেগুলো হচ্ছে, অপারেশন সেবা। প্যাথলজি ও রেডিওলজি সেবা। অভ্যন্তরীণ সেবার মধ্যে থাকবে মেরুরজ্জুতে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য একটি পুনবার্সন কেন্দ্র, অটিজম ও সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষায়িত শিশুবিভাগ, স্ট্রোক রোগীদের জন্য পুনর্বাসন ওয়ার্ড, মেডিকেল কনসালটেন্সি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পীচ এন্ড ল্যাঙ্গুরেজ থেরাপি, শিশু বিভাগ, ক্লাব ফুট বা মুগুর পা চিকিৎসা, মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় ডে কেয়ার সেন্টার। পুনর্বাসন সেবাসমূহের মধ্যে থাকবে আর্থ-সামাজিক সহায়তা, সমাজভিত্তিক পুনর্বাসন, মনো-সামাজিক কাউন্সিলিং, ক্রীড়া ও বিনোদন। আর সহায়ক ও পুনর্বাসন সামগ্রীর মধ্যে থাকবে প্রস্থেটিক্স এবং অর্র্থোটিক্স (কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন), অর্থোপেডিক সু টেকনোলজি, সাপোর্টিভ সিটিং বিভাগ, হুইলচেয়ার ও অন্যান্য সহায়ক সামগ্রী।
এছাড়াও এখানে গড়ে তোলা হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১ বছরের ইন্টার্নশিপ সহ ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি, বিএসসি ইন অকুপেশনাল থেরাপি, বিএসসি ইন স্পীচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি কোর্স করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।
অবকাঠামো সুবিধার মধ্যে থাকবে মেরুরজ্জুতে আঘাতপ্রাপ্ত, অটিজম, সেরিব্রাল পালসি ও স্ট্রোক রোগীদের জন্য পুনবার্সন সেবাদান কেন্দ্র, ভর্তিকৃত রোগীদের আবাসন সুবিধা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসকদের জন্য আবাসন সুবিধা ও শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেল সুবিধা।
উল্লেখ্য, সিআরপি একটি অলাভজনক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। যা ট্রাষ্ট ফর দি রিহ্যাবিলিটেশন অফ দি প্যারালাইজড (টিআরপি) এর একটি বিশেষ প্রকল্প। ‘সৃষ্টির সেবাই স্রষ্টার সেবা’ এই স্লোগান নিয়ে ১৯৭৯ সালে একজন ব্রিটিশ ফিজিওথেরাপিস্ট ড. ভ্যালেরি এ টেইলর মাত্র ৪ জন রোগী নিয়ে ঢাকায় পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি) প্রতিষ্ঠা করেন। এরই ধারবাহিকতায় সারাদেশে সিআরপির মোট ১১টি উপকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আর্তমানবতার সেবায় রাজশহীতে পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তুলতে কাপাসিয়ায় মূল সড়ক সংলগ্ন ১৫ বিঘা জমি সিআরপি‘কে দান করেন রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও তাঁর পরিবার। ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সিআরপি প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি অ্যান টেইলর এর সঙ্গে চুক্তি ও জমিদান কার্যক্রম সম্পন্ন করেন রাসিক মেয়র। উক্ত জমিতে রাসিক মেয়র লিটনের প্রয়াত পিতা-মাতার নামে সিআরপি রাজশাহী-শহীদ এ.এইচ. এম কামারুজ্জামান ও জাহানারা জামান সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।