727
Published on অক্টোবর 11, 2022ড. প্রণব কুমার পান্ডে:
বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কোনো রাজনৈতিক দল বিরোধী দলে থাকলে সরকারের কোনো ভালো কাজ তাদের চোখে পড়ে না। এমনকি সরকারের কোনো অর্জন তারা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করতে পারে না। তারা সবসময় ব্যস্ত থাকে সরকারের সমালোচনা করতে। যে কোনো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলের গুরুত্ব অপরিসীম। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক আকার প্রদান করার ক্ষেত্রে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
আমরা যদি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে বিরোধী দল সরকারের ভালো কাজের যেমন প্রশংসা করে, ঠিক তেমনিভাবে মন্দ কাজের সমালোচনা করে। যুক্তরাজ্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যাবে যে যুক্তরাজ্যে বিরোধী দল ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ (শ্যাডো ক্যাবিনেট) গঠন করে। এই ধরনের ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের সব মন্ত্রণালয়ের কাজের ওপর কড়া নজর রাখা। সরকার যদি কোনো রকম নেতিবাচক কাজে লিপ্ত থাকে তখন শ্যাডো সরকারের মন্ত্রীরা সেগুলোর কঠোর সমালোচনা করে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি একেবারেই গুরুত্বহীন কারণ সরকারের প্রশংসা করা তো দূরের কথা, সরকারের ভালো কাজেরও সমালোচনা করে বিরোধী দল।
এতক্ষণে হয়তো অনেকেই ভাবা শুরু করেছেন যে কেন আমি উপরের কথাগুলোর অবতারণা করলাম? এর মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গত সাড়ে ১৩ বছরে আওয়ামী লীগের অর্জনগুলো বিরোধী দলের নজরে একেবারেই আসে না। তাই তারা সব সময় ক্ষমতাসীন দলকে সমালোচনা করতে ব্যস্ত রয়েছে। তাদের এত সমালোচনার মধ্যেও আওয়ামী লীগ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত এক দশকের বেশি সময় ধরে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন স্বীকৃতি লাভ করেছেন। সেই স্বীকৃতিগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কীসের ইঙ্গিত বহন করে? এর অর্থ হলো শেখ হাসিনার কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি দিয়ে চলেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য কখনোবা জাতি সংঘের ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ হয়েছেন, আবার কখনোবা ইউএন উইমেনের ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ বা গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরামের ‘এজেন্ট অফ চেঙ্গ’ পুরস্কার পেয়েছেন। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করতে দেওয়া, তাদের প্রতি মানবিক ও দায়িত্বশীল নীতি গ্রহণ করা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এইপিএস ইন্টারন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড এবং ২০১৮ স্পেশাল ডিস্টিঙ্কশন অ্যাওয়ার্ড ফর লিডারশিপ নামক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।
এই ধরনের পুরস্কার প্রাপ্তি তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়। কারণ শেখ হাসিনা প্রথম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ১৯৯৮ সালে যখন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে প্রায় দুই দশকের পুরোনো বিদ্রোহের অবসান ঘটানোর জন্য জাতিসংঘ তাকে ইউনেস্কো ‘ফেলিক্স হুফে বইনি’ শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত করে। সম্প্রতি করোনা অতিমারি সফলভাবে মোকাবিলা করার দেশেসমূহের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে দ্বিতীয় সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশ ও দেশের জনগণের জন্য একটি গর্বের বিষয়। একথা ঠিক যে আওয়ামী লীগের আমলে সবকিছু ভালোভাবে চলছে তা পুরোপুরি বলা যাবে না।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও হয়তো ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু যে মানুষটি নিরলসভাবে দেশের উন্নয়নের জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাঁর সেই পরিশ্রমকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি প্রদান করা হলেও দেশের একটি গোষ্ঠী সব সময় তাঁর সমালোচনায় ব্যস্ত। নিন্দুকেরা প্রশ্ন করতেই পারেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সব স্বীকৃতি দেশের জন্য আদৌ কোনো গুরুত্ব বহন করে কি না? এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর হচ্ছে দেশের প্রধানমন্ত্রীর এই ধরনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেশকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করে। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনকেন্দ্রিক এক ধরনের অচলাবস্থা রয়েছে বহুকাল ধরে বিধায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এটি খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কারণ আমাদের সব বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র এই ধরনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করতেই পারে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঠিক এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক জনগণ। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিভিন্ন সময়। তিনি আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আশাবাদী। একটি দেশের জন্য নির্বাচন যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, ঠিক তেমনিভাবে নির্বাচনের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় পৃথিবীর বড় বড় দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করার অর্থ হচ্ছে যে তারা শেখ হাসিনার রাজনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতির ওপরে আস্থা রেখেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর কার্যক্রমগুলো স্বীকৃতি প্রদান করা হচ্ছে। যে নীতির মাধ্যমে আজকের বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতি, শেখ হাসিনার সেই নীতি অনেক দেশের জন্যই রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নে শেখ হাসিনার মডেলকে অনুসরণ করে অন্যান্য দেশে এগিয়ে যাবে সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে।
এমনকি যে বিশ্বব্যাংক এক সময় কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই বিশ্বব্যাংক এখন বাংলাদেশের সাথে অন্যান্য প্রকল্পের যোগসূত্র স্থাপন করতে চায়। এমনকি বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রধান তাঁর মেয়াদ শেষে ফিরে যাওয়ার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে তাঁর সরকারের আমলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রশংসা করে গেছেন। ফলে, যারা সব সময় শেখ হাসিনার সমালোচনা করেন এবং তাঁর সরকারকে অবৈধ সরকার হিসেবে ব্র্যান্ডিং করতে চান আমি এই প্রশ্নগুলো তাদের কাছে রাখতে চাই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে খাটো করার অনেক অপপ্রয়াস আমরা ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করেছি। খুন ও গুমের আজগুবি তথ্য দিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে কোন কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রভাবিত হয়েছে। তবে পরে তারা তাদের ভুল শুধরে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেছে। আমি আমার এই লেখায় এটা দাবি করছি না যে বাংলাদেশে এ রকম খুনের বা গুমের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু সেই সব ঘটনার পেছনে কি সত্য লুকায়িত আছে-সেগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন না করে ঢালাওভাবে আজগুবি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই ধরনের তথ্য উপস্থাপন করার মাধ্যমে বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশকে খাটো করার প্রয়াস একটি জঘন্য কাজ।
আমি বিশ্বাস করি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দায়িত্বশীলতার সাথে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। জাতিসংঘের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোনো একটি মন্তব্য কিংবা রিপোর্ট প্রকাশিত হলে সেটির গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি থাকে। আবার সেই প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট যদি ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে তা হবে এই সংস্থার ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। ফলে, বিএনপি এবং তাদের শরিকদের উচিত বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে শুধু বিরোধিতার খাতিরে বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশ ও সরকারকে খাটো করার অপপ্রয়াস না চালিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকার গঠন করার চেষ্টা করা।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
সৌজন্যেঃ জাগো নিউজ