গ্রেনেড ছুঁড়ে রাজনৈতিক অপশক্তি আর ফিরে আসতে পারেনি

973

Published on আগস্ট 22, 2022
  • Details Image

এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনঃ 

২১ অগাস্ট হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে থাকা সেই কথিত জাতীয়তাবাদী শক্তির পরাজয়ের দিন, যারা গ্রেনেড ছুঁড়ে মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে এবং চিহ্নিত রাজনৈতিক অপশক্তি হিসাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন-এর উপন্যাস হাঙর নদী গ্রেনেড। মলাটে বাঁধানো মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান হিসাবে আদৃত পুস্তক। এদিকে গ্রেনেড বার বার করে পিছু নেয়। ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ হারিয়েছে ত্যাগী নেতাদের। আইভি রহমান থেকে শুরু করে বজ্রকন্ঠ নিয়ে মাঠ মাতানো মোহাম্মদ হানিফকেও। ঢাকার রাজনীতির প্রাণপুরুষ সেই তিনিও আর সুস্থ হয়ে মঞ্চ কাঁপাতে পারেননি। আমরা প্রায় হারাতে বসেছিলাম, বাংলাদেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শাসক শেখ হাসিনাকেও। তাকে টার্গেট করেই মূলত ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলা। কিন্তু, ঈশ্বর বললেন, বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য একজন শেহ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। হলোও তাই।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার পাতা উল্টাতে থাকলে ইংলিশ ঔপ্যনাসিক জর্জ অরওয়েল-এর উক্তিকে জিতিতে দেয়। যখন তিনি ক্ষোভের সুরে লিখলেন, “পলিটিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ—ইজ ডিজাইনড টু মেক লাইজ সাউন্ড ট্রুথফুল অ্যান্ড মার্ডার রেস্পেক্টেবল, অ্যান্ড টু গিভ এন অ্যাপিয়ারেন্স অফ সলিডিটি টু পিওর উইন্ড।”

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট, ৩ নভেম্বর এবং ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট ছিল একই কালো সুতোয় বোনা একটি নেতিবাচক বন্ধন। যে কথিত বন্ধন বাংলাদেশের বিপক্ষে থাকে। অথচ জর্জ অরওয়েলের মতবাদকে জিতিয়ে একটি ছোট্ট রাজনৈতিক শ্রেণি বাংলাদেশবিরুদ্ধ শক্তিকে সম্মানিত করে। তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সম্মান দেয়। তারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধশক্তির গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে দিয়ে বলে, মন্ত্রণালয় চালাও।রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ভাষাকে তাই প্রজন্ম আস্থায় নিতে চায় না। কীভাবে নেবে? তাদেরকে অপশক্তি যা শিখিয়েছিল অতীতে, তাতে আঁতকে ওঠার উপলক্ষ তৈরি হয়।

সঙ্গত যুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভেসে থেকেও পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে সর্বজনীন সত্যটা নিয়ে গর্ব করতে চাইলেও, পেছন থেকে বাঁকা হাসির আওয়াজ টের পাই। একদিকে কটাক্ষের হাসি। অন্যদিকে রাজনীতির বাঁকা পথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে চাওয়ার অযাচিত মিশন। তেমন অপসংস্কৃতিকে টান দিয়ে রুখতে পারার জন্য সবিশেষ ধন্যবাদ একজনকে দিতে হবে। ঘুরেফিরে সেই শেখ হাসিনাকে। যিনি, শুধুই কি উন্নয়নের অভিযাত্রার সড়কে বাংলাদেশকে পথিক করেছেন? ফলত, শুধুই তা নয়। তিনি রাজনৈতিক অপশক্তি রুখতে সেই অদম্য সত্তা, ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার ভাড়াটে খুনীদের বিচার করতে পেরেছেন।

২১ অগাস্ট হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে থাকা সেই কথিত জাতীয়তাবাদী শক্তির পরাজয়ের দিন, যারা গ্রেনেড ছুঁড়ে মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে এবং চিহ্নিত রাজনৈতিক অপশক্তি হিসাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে। গভীর বাস্তবতায় আমরা অসংখ্য নেতাকর্মীদের ভুক্তভোগী হতে দেখেছি। তারা এখনো গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে নিয়ে ধুঁকছে। ডাকসাইটে রাজনীতিকদের হারিয়েছি। শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি দুর্বল হয়েছে— কিন্তু, দেড় যুগ পর এসে দেখা যাচ্ছে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা করে চলতেও শিখে গিয়েছে।

“মানুষ পরাজয়ের জন্য সৃষ্টি হয়নি। তাকে হয়তো ধ্বংস করা যায়, কিন্তু হারানো যায় না।” বলেছিলেন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। আমি অবশ্য মানুষ না বলে সত্তার নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিয়ে বলব, একজন নেতা পরাজয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে না। তাকে হয়তো হত্যা করা যায়, কিন্তু সত্যিই কি সেই অদম্য সত্তার পরাজয় হয়? হয় না। ঘাতকশ্রেণি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কী পেয়েছে? তার স্বপ্ন লালন করে ধারক হয়ে একজন যোগ্য উত্তরসূরী কি প্রকৃতির ইচ্ছায় চলে আসেননি? শেখ হাসিনা তো সব সময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থেকে বলছেন, “সত্য ও ন্যায়ের কঠিন পথ, আমি সেই কঠিন পথ বেছে নিয়েছি।”

শেখ হাসিনাকে হারানো কঠিন হবে ওই রাজনৈতিক অপশক্তির জন্য। তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে অসংস্কৃতি হিসাবে জাতি দেখতে পায়। তারা কীভাবে ১৫ অগাস্ট নকল জন্মদিন পালন করার কুকৃষ্টিকে আলিঙ্গন করতে পারে? প্রায় একযুগ ধরে বিবেকবান শ্রেণির প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে তা বলা হচ্ছে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি, কথিত জাতীয়তাবাদী শক্তির যে রাজনীতি, তা বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ করে না বলেই তো আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রীয় সেবায় টিকে থাকতে পারছে। গণতন্ত্রকে তোমরা তোমাদের নিজ দলে প্রতিষ্ঠিত করতে পারো নাই। কে তোমাদের নেতা? দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং-এর দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া চিরচেনা বেগম জিয়া ও তারেক রহমান? তোমরা তো দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাতেই যেতে পারো নাই। নিজের ঘরে গণতান্ত্রিক অনুশীলন ও জনস্বার্থ— দু-জায়গাতেই সেই শক্তি ৪৪ বছরে কাজ করেনি। ইতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে তারা আমাদের জন্য তথা আওয়ামী লীগের জন্য কার্যত প্রতিপক্ষ হতে পারনি। তারা তাই বিদেশি শক্তির ওপর আস্থা রেখে বারংবার করে আঘাত হেনেছে, আঘাত করতে চেয়েছে।

যে পরাক্রমেরা বাংলাদেশকে ভূরাজনীতির অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে দেখে তারা এই দেশে দুর্বল শাসক চাইত। বেগম খালেদা জিয়ার মতো করে! কিন্তু, গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর সেই দার্শনিক রাজার মতো করে একজন শেখ হাসিনা বৈশ্বিক রাজনীতির সমীকরণটি বদলে দিয়েছেন। তারা মনেই করে, বাংলাদেশ এখন আর সেই দেশ নেই। বরং, তাদেরকে আপস করেই শেখ হাসিনার মুখের দিকে চাইতে হয়।

আওয়ামী লীগ চায়, আমাদের বিরুদ্ধে একটি শক্ত রাজনৈতিক শক্তি জন্ম নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানাক। যারা জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনে আমাদের চিন্তার কাছাকাছি পর্যায়ে থাকবে। তখন রাজনীতিকে উপভোগ করাও যায়। আমাদেরকেও বিরোধী দল হতে হবে, ওই মানসিকতায় ভর করে শেখ হাসিনা প্রায়শই তাগাদা দেন। কিন্তু, আমাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো করে সেই রাজনৈতিক শক্তিটা কোথায়? দেশের আপামর নাগরিকও বলবে, নেই। যারা সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে ছল করে ছিল, তারা মূলধারার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে চূড়ান্তভাবে সরে যায়, যেদিন তারা ২০০৪ সালে ২১ অগাস্টের মতো ঘটনা ঘটায়। আবারো তারা এমন উদ্যোগে যেতেই পারে! ৯২ দিনের টানা হরতাল, অবরোধ করে আগুন সন্ত্রাসই তাদের কথিত অন্তিম আন্দোলন। তাদের সাথে জনমানুষের সম্পৃক্ততা নেই।

২১ অগাস্ট, অন্ধকার দিবসটি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যে বিকেলে ওই সময়ের শাসকশ্রেণি বাংলার ইতিহাসের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ নারী সত্তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় জানাতে সচেষ্ট ছিল, সেই শেখ হাসিনা বেঁচে গিয়েই নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছেন। তিনি এই গ্রহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আর তোমরা? কালো রাত্রির সন্ধান করে যাচ্ছো। আয়নার সামনে দাঁড়াও। খেয়াল করে দেখো যে, গ্রেনেড হামলার পর হতে তোমাদের রাজনীতি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? টানা দুই বছর লড়াই হয়েছিল। তোমাদের পতন হয়েছিল। রাজনৈতিক অপশক্তি হিসাবে হয়তো প্রেক্ষাপট বদলানো যায়। জনআস্থা অর্জন করা যায় না। গ্রেনেড ছুঁড়ে রাজনৈতিক অপশক্তি তাই আর ফিরে আসতে পারেনি।

লেখকঃ রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত