1053
Published on আগস্ট 15, 2022শহীদ কর্নেল জামিল আহমেদ। ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামরিক সচিব। নিশ্চিত বিপদ জেনেও ঘরে বসে থাকেননি এই সেনা কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধু ঘটনার রাতে যাদের ফোন করেছিলেন তাদের কেউই তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসেননি। একমাত্র কর্নেল জামিল ছুটে এসেছিলেন মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কর্নেল জামিলের মরদেহ দেখতে ঘাতকচক্র তার স্ত্রী, সন্তানদের শর্ত জুড়ে দিয়েছিল- শব্দ করে কাঁদা যাবে না! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই নির্মম, হৃদয়বিদারক দুর্বিষহ পরিস্থিতির কথা বলেন কর্নেল জামিলের মেজ মেয়ে আফরোজা জামিল কঙ্কা।
আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, আমার বড় বোন বাবার মরদেহ দেখে চিৎকার করেছিল। তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মা মুখে কাপড় গুঁজে বাবার মাথার কাছে বসে নীরবে চোখেল জল ফেলেন। এসব কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে আফরোজা জামিলের।
সেই ভয়াল রাতের ঘটনা বর্ণনায় তিনি জানান, সুবহে সাদেকের সময়। লাল টেলিফোনে ফোন এলো। ফোনটা মা রিসিভ করলেন। বাবা তখন পাশের রুমে ছিলেন। বাবাকে জানালেন বঙ্গবন্ধু ফোন করেছেন। বাবা ফোন ধরে বললেন- যেখানে, যেভাবে আছেন, থাকেন। আপনি কোনো টেনশন করবেন না। আমি আসতেছি। এই বলে তিনি ফোন রেখেই রওনা হওয়ার জন্য গাড়ি বের করতে বললেন। এ সময় তিনি সেনাপ্রধানকে ফোন করে বললেন- বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কারা যেন হামলা করেছে, শফিউল্লাহ ফোর্স পাঠাও, আমি যাচ্ছি।
আফরোজা জামিল বলেন, আমাদের বাসার পাশেই প্রেসিডেন্ট রেজিমেন্ট গার্ডের অফিস। তাদেরও খবর পাঠানো হলো। বাবা যখন বের হচ্ছিল তখন মা বললেন- তুমি যাবে? বাবা পেছন ফিরে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকালেন! বললেন- বঙ্গবন্ধু বিপদে আর আমি বসে থাকব।
তিনি জানান, আমাদের বাসা ছিল দোতলায়। বাবা যখন নিচে নামলেন, গাড়িতে ওঠার সময় আমার বড় বোনকে বললেন- এক গ্লাস পানি দিতে। বাবা পানি ও একটা সিগারেট খেয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। আমরা তখন সবাই উৎকণ্ঠায়। কী হবে, হতে যাচ্ছে।
আমরা অপেক্ষায়। সকাল দশটার দিকে গাড়িচালক আইনউদ্দিন কাকা এলেন। হাউমাউ করে অনেক কাঁদলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। এর কিছুুক্ষণ পর বাসায় ফোন এলো- মা ধরলেন। ওপাশ থেকে বলা হলো বাবা নেই। মা পড়ে গেলেন। আমরা..
আফরোজা জামিল জানান, আমাদের ওই বাসা থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো। লালমাটিয়ায় কাকার বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো। আমি তখন কিশোরী। ভেবেছিলাম কাকার বাসায় গিয়ে বাবার লাশ দেখতে পারব। কিন্তু সেই বাসায় গিয়ে আমি একে একে সব রুম খুঁজেও যখন বাবাকে পেলাম না, তখন ভেবেছিলাম বাবা বেঁচে আছেন।
তিনি আরও জানান, পরে আমরা জানতে পারি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে ব্যারিকেড ক্রস করে বাবা যখন যাচ্ছিলেন, তখন মেজর ফারুক গুলি করে বাবাকে মেরে ফেলে। বাবার লাশ পাশেই এক জায়গায় রাখা হয়। হত্যাকারীরা বাবার লাশ দিতে চায়নি। পরে খালেদ মোশাররফ কাকার হস্তক্ষেপে লাশ দিতে রাজি হয়। রাত ১২টার সময় একটা গাড়ির পেছনে করে বাবার লাশ কাকার বাসার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। বাবাকে দেখার জন্য শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়- শব্দ করে কান্না করা যাবে না!
গাড়ির কাছে গেলাম। বাবা অনেক লম্বা ছিলেন। গাড়ির জানালা দিয়ে বাবার পা বের হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে সেখান থেকে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হলো। পরে বাবাকে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। বাবার মরদেহ রাখা হলো, বাবার মাথার পাশে মা বসে মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদতে ছিলেন। কারণ শব্দ করা যাবে না। আমার বড় বোন বাবার লাশ দেখে চিৎকার করেছিল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর থেকে নির্মমতা আর কী হতে পারে।
তিনি জানান, কেউ যাতে টের না পায় সেজন্য গোপনীয়তা রক্ষা করতেই আমাদের সঙ্গে নির্মম আচরণ করা হয়। পরে একটা চাদরে মুড়িয়ে বাবাকে বনানীতে দাফন করা হয়।
আফরোজা জামিল বলেন, বাবার মৃত্যুর ৮ মাস পরে আমার ছোট বোনের জন্ম হয়। সে বাবাকে দেখতে পায়নি। এরপরেও আমাদের অনেক প্রতিঘাত সহ্য করে দিন পার করতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমার বাবা ছিলেন সৎমানুষ। বঙ্গবন্ধুকে বাবা হৃদয়ে ধারণ করতেন। আমারও বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করি। সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে দিতে হবে। এজন্য আমাদের যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে।
সৌজন্যেঃ আমাদের সময়