1301
Published on আগস্ট 15, 2022এম নজরুল ইসলামঃ
শ্রাবণের শেষরাত ছিল সেটা। সে রাতে কি বৃষ্টি হয়েছিল? সে রাতে কি কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল আকাশের চাঁদ? জোছনাকে কি গ্রাস করেছিল রাহুর অশুভ ছায়া? কেমন ছিল সে রাতের প্রকৃতি?
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যেমন সূর্য ওঠে, তেমনি কি সেদিনের সূর্য একটি সম্ভাবনার কথা বলেছিল? নাকি এক স্বপ্নভঙ্গের বিস্ময়-বেদনা নিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের দিন? আমরা কেউ কি ভাবতে পেরেছিলাম, ১৫ই আগস্ট সকালের সূর্য কোনো শুভ দিনের সূচনা নয়, একটি বেদনাবিধুর কালো ইতিহাসের জন্ম দিতে যাচ্ছে?
বাঙালির জাতীয় জীবনে অনেক কালো অধ্যায় আছে। কিন্তু ১৫ই আগস্ট রাতে রচিত হলো যে কৃষ্ণ অধ্যায়, বাংলার ইতিহাসে তার চেয়ে বেদনার আর কী আছে?
আসলে কেমন ছিল সেই রাত, যে রাতে নিহত হলেন পিতা, ঘাতকের নির্মম বুলেটে? সেই রাতের কল্পকাহিনি শীর্ষক কবিতায় কবি নির্মলেন্দু গুণ একটি চিত্রকল্প এঁকেছেন—
‘তোমার ছেলেরা মরে গেছে প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে,/তারপর গেছে তোমার পুত্রবধূদের হাতের মেহেদী রঙ,/তারপর তোমার জন্মসহোদর, ভাই শেখ নাসের,/তারপর গেছেন তোমার প্রিয়তমা বাল্যবিবাহিতা পত্নী,/আমাদের নির্যাতিতা মা। ’
নিজের বাড়িতে সপরিবারে নিহত হলেন জাতির পিতা।
জাতি পিতৃহীন হলো। যে জাতি মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে বুকের রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার সূর্য, সেই জাতিই কলঙ্কিত হলো পিতৃঘাতক হিসেবে। ইতিহাসের এই দায় কি কোনো দিন পরিশোধ করা যাবে?
১৯৭৫ থেকে ২০২২। ৪৭ বছর অতিক্রান্ত। আরো অনেক বছর কেটে যাবে। হাজার বছর যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সব সময় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক। আসলে বঙ্গবন্ধু এমন একজন মানুষ, যাঁকে তাঁর জীবনের প্রতিটি পরতে নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়। তিনি সেই মানুষ, যাঁর দুই চোখে সব সময় খেলা করেছে বাংলাদেশ। এক সুন্দর, সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির চিন্তায় ব্যয় করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তির পর লন্ডনে দেওয়া বিবৃতি ও দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি দেশের মানুষকে সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পা রাখার পর বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতায় তিনি কেবলই দেশ ও দেশের মানুষের কথা বলেছেন। মানুষের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত ছিল তাঁর জীবন। মহত্প্রাণ মানুষটি কেবলই মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবেছেন।
বঙ্গবন্ধু সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। মানুষের মধ্যে নিজের স্বপ্ন বপন করতে পারতেন। সাধারণ্যে মিশে সাধারণের মতোই জীবন যাপন করতে চেয়েছেন তিনি। নিজেকে কোনো ঘেরাটোপে বন্দি করতে চাননি। মানুষের সঙ্গে মিশতে চেয়েছেন। মানুষের দুঃখ ভাগ করে নিতে চেয়েছেন। দেশের শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়েও তাঁর বাড়িটি ছিল সাধারণ একটি বাড়ি। বাড়ির আটপৌরে পরিবেশের সঙ্গে বাংলার সাধারণ পরিবারের অন্দরমহলের সাযুজ্য। এখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্যদের তফাত। তিনি অসাধারণ হয়েও জীবন যাপনে ছিলেন অতি সাধারণ। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি দেশের মানুষকে নিয়েই ভেবেছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ মন্তব্য করেছিলেন, ‘মুজিব-নেতৃত্বের অভ্যুদয় এশিয়ার রাজনীতিতে এক নবযুগের সূচনা। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ মিলে অবিভক্ত ভারতে যে ধর্মান্ধতা ও বিভাজনের রাজনীতি ছড়িয়ে গেছে, বিবাদ ও সংঘাত সৃষ্টি করে রেখে গেছে, শেখ মুজিবের রাজনীতি ও অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি সেই বিভাজন, ধর্মান্ধতা ও সংঘাত-বিবাদের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের সুফল ভোগ করবে সারা উপমহাদেশ। ’ ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, তখন জয়প্রকাশ নারায়ণ লিখেছেন, ‘কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ভুল রাজনীতির বিপজ্জনক থাবা থেকে উপমহাদেশের মুক্ত হওয়ার যে শেষ আশা জাগ্রত হয়েছিল, তাও নিভে গেল। ’
বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে অসাম্প্রদায়িকতায় এবং অসাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে ধর্মনিরপেক্ষ-সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে উত্তরণ ঘটাতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর মৌলিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। এই মৌলিক আদর্শটি ছিল একটি সমাজতন্ত্রঘেঁষা এবং ধর্মনিরপেক্ষতাভিত্তিক, শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গঠন। বাংলাদেশে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, তাঁর এই উদ্যোগ সফল হলে শুধু বাংলাদেশের নয়, এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে যেত।
ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল তাঁর জীবনদর্শনের একটি অন্যতম দিক। ছাত্রজীবন থেকে তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতার মানবিক দর্শন নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। ’
ছয় দফা দাবি পেশ করার পর তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘ছয় দফা মুসলিম-হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমার আত্মপ্রকাশ আর নির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি। ’
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদন উপলক্ষে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সে ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘... বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। এই হলো চার দফা, চার স্তম্ভ। ’
বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছিলেন দেশের মানুষের জন্য। নির্যাতন-নিপীড়ন মেনে নিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই। তাঁর মতো নিঃস্বার্থ রাজনীতিবিদ বিরল। সব মতাদর্শের ঊর্ধ্বে থেকে বঙ্গবন্ধু আজ সমহিমায় অধিষ্ঠিত। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘দানবের মূঢ় অপব্যয়, গ্রন্থিতে পারে না কভু ইতিহাসে শাশ্বত অধ্যায়। ’ বঙ্গবন্ধু সমহিমায় ইতিহাসের অনন্য পুরুষ হিসেবে তাঁর স্থান করে নিয়েছেন। খলনায়করা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত।
পুরো বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের একটি সোনালি স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর চোখে। একটি শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ভিতটা প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। অনেকের ধারণা, সেই স্বপ্ন সফল হলে আজ বাংলাদেশ হতো সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার চেয়েও উন্নত ও পরিচ্ছন্ন একটি দেশ। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বঙ্গবন্ধু যদি তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অভিযাত্রা অবিচ্ছিন্নভাবে আরো দশক দুই চালিয়ে যেতে পারতেন, তাহলে তাঁর আরাধ্য সোনার বাংলা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতাম আমরা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আজ আমরা যে ভালো অবস্থানে আছি, তার কাঠামোটা বঙ্গবন্ধুই করে দিয়ে গেছেন।
বিশ্বজুড়ে বাঙালির পরিচয়সূত্র তিনি। আজ তাঁকে স্মরণ করি পরম শ্রদ্ধায়।
লেখক : সর্বইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি, অস্ট্রিয়া প্রবাসী
সৌজন্যেঃ কালেরকণ্ঠ